পার্সলেইনও বলে অনেকে, রবিন বলল।
নাম যা-ই হোক খুব আগ্রহের সঙ্গে গাছটা নিল কুমালো। পাতাগুলো চিবিয়ে শেষ করল। তারপর একে একে শেষ করল কাণ্ড আর শেকড়ের রস।
দারুণ, বলল সে। নিশ্চয় আরও অনেক আছে। খেয়েছ তো?
মাথা কাত করল মুসা।
সরি, কিশোর বলল। আর কোন খাবার-টাবার দিতে পারব না তোমাকে।
কুমালো হাসল। পানিই দরকার ছিল আমার। পেয়েছি। এখন ঘুমাতে পারব, বলেই চোখ মুদল সে।
আরও পিগউইডের সন্ধান করল কিশোর। পেল না। পাতার দুএক ফোঁটা রস পিপাসা না কমিয়ে বরং বাড়িয়েই দিয়েছে। খুনী সূর্যটাকে দিগন্তের ওপাশে হারিয়ে যেতে দেখে আন্তরিক খুশি হল সে। স্বাগত জানাল রাতকে। ভেবে শঙ্কিত হল, ভয়ঙ্কর দিন আসবে কয়েক ঘন্টা পরেই, আরেকটা, তারপর আরেকটা…আসতেই থাকবে একের পর এক, যতক্ষণ না ক্ষুধায় পিপাসায় মারা যাচ্ছে ওরা…
এভাবে মরতে চায় না কিশোর। কিন্তু বাঁচতে হলে পানি চাই। এক নম্বর সমস্যা এখন পানি। কোথায় পাওয়া যাবে? ভাবতে বসল সে। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে ঘন ঘন। হঠাৎ পাথরে হাত পড়তে চমকে উঠল। ভেজা ভেজা!
শিশির! শিশির পড়ছে। সন্ধ্যার ছায়া নামতেই হালকা বাষ্প জমেছে ল্যাগুনের ওপরে। যদি কোনভাবে ধরা যেত ওই শিশির…
শুনেছে, পলিনেশিয়ানরা শিশির ধরার কায়দা জানে। মনে করতে পারছে না কিভাবে। কুমালো হয়ত জানে, কিন্তু ও ঘুমাচ্ছে, এখন জাগানো উচিত হবে না।
ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে রবিন আর মুসা। কিন্তু কিশোরের চোখে ঘুম এল। শুয়ে গড়াগড়ি করল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে পড়ল। একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।
ল্যাগুনের সৈকতে চলে এল সে। বালিতে একটা ছোেট গর্ত করল। তলায় রাখল নারকেলের মালাটা। গর্তের মুখ ঢেকে দিল কাপড় দিয়ে, শার্ট ঘেঁড়া কাপড়, যেটা দিয়ে কুমালোর মাথায় পট্টি দিয়েছিল। ঠাণ্ডা এখন বাতাস, পট্টির আর দরকার নেই। নারকেলের মালার মুখে কাপড়টার যে গোল অংশটুকু পড়েছে, তার ঠিক মাঝখানে একটা ফুটো করল। তারপর গর্তটা ঢেকে দিতে লাগল পাথর দিয়ে। ছোট ছোট পাথরের তিন ফুট উঁচু একটা পিরামিড তৈরি করে ফেলল গর্তের ওপরে।
উদ্দেশ্যঃ পাথরে ধরা পড়বে শিশির। ভিজবে। তারপর আরও শিশির পড়ে পাথরের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামবে নিচে, শার্টের কাপড়ে জমা হবে, সেখান থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়বে মালায়। সকাল নাগাদ একমালা পরিষ্কার পানি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ফিরে এসে দেখল সে, রবিন আর মুসা কুমালোর পাশে মড়ার মত ঘুমোচ্ছে। কিশোরও শুয়ে পড়ল আবার, মাথার নিচে দিল প্রবালের বালিশ।
কিন্তু ঘুমাতে পারল না। জীবন বাঁচানোর জন্যে অতি প্রয়োজনীয় তিনটে শব্দ শুধু ঘুরছে মাথায়—পানি, খাবার, ছাউনি।
বাড়িতে নিঝঝাট জীবন জাপনের কথা ভাবল সে। নরম বিছানা, মাথার ওপরে ছাত। পানির ভাবনা নেই। বিছানা থেকে নেমে কয়েক পা গিয়ে ট্যাপের মুখ ঘোরালেই হল। খিদে পেলে শুধু ফ্রিজের ডালা খোলা, ব্যস…।
বাড়িতে জীবন এত সহজ, যারা থাকে ধরে নেয় এত সহজেই কাটে জীবন, সব জায়গায়। কষ্ট যে করতে হয় অনেক জায়গায়, বোঝেই না যেন। তাই অচেনা সঙ্কটময় কোন জায়গায় গিয়ে পড়লে ভাবে, এই বুঝি মরলাম! ওখানেও যে বাঁচা সম্ভব, বিশ্বাসই করতে চায় না।
ওর গলা শুকিয়ে খসখসে সিরিশ কাগজ হয়ে গেছে। পেট যেন শূন্য একটা ড্রাম। তন্দ্রা নামল চোখে। স্বপ্নে দেখল বৃষ্টি। চমকে জেগে গেল সে। তাকাল আকাশের দিকে।
মেঘশূন্য আকাশ। বড়বড় একেকটা উজ্জ্বল তারা যেন খুদে খুদে সূর্য, কিশোরের মনে হল ওগুলোর তাপ এসে লাগছে তার গায়ে। ছায়াপথটাকে দেখে মনে হচ্ছে লম্বা পথের ওপর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে কাচের গুঁড়ো।
এরকম রাত বিকিনিতেও কাটিয়েছে। রাতের বেলা ছোট জীবের হুটোপুটি শুনেছে ঝোপের ভেতরে। এখানে এই মৃত্যুদ্বীপে ওরকম কিছু নেই, একেবারে নীরব, শুধু দেয়ালে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের বিচিত্র গুমরানি ছাড়া। বাতাসে ভেসে আসছে মৃত্যুর গন্ধ, দ্বীপের ওপাশ থেকে, পচা হাঙরের।
আবার অস্থির ঘুম নামল কিশোরের চোখে।
৩
কাক-ভোরের ফ্যাকাসে আলোয় ঘুম ভাঙল তার। পিঠে আর শরীরের এখানে ওখানে ব্যথা। চোখা প্রবালের খোঁচা যেখানে যেখানে লেগেছে সবখানে। বাতাস খুব ঠাণ্ডা, পরিস্কার। ঘুমানর আগে যতটা ক্ষুধা আর তৃষ্ণা ছিল, ততটা নেই। খারাপ লক্ষণ। তারমানে দেহের যন্ত্রপাতিগুলো অবশ হয়ে আসছে।
তবে তাজা বাতাস নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করল তার মধ্যে। যেভাবেই হোক, যে-কোন উপায়েই হোক, এই মৃত্যুদ্বীপকে পরাজিত করবে ওরা, সেই সাথে পরাজিত করবে ডেংগু পারভিকে। মনে পড়ল একটা কবিতার দুটো চরণঃ
দি মরনিংস ডিউ পার্লড,
অলস রাইট উইথ দ্য ওয়ার্ল্ড।
খুশি মনে উঠে সৈকতে চলল সে। দেখার জন্যে, তার শিশির-ধরা-ফাঁদে কতখানি শিশির আটকা পড়েছে।
পানি জমেছে মালার অর্ধেকের কম। আরও বেশি পড়বে আশা করেছিল সে। শিশির বোধহয় হালকা ছিল। যাকগে, যা পড়েছে তাই লাভ। অতি মূল্যবান তরলটুকু নিয়ে ক্যাম্পে ফিরল সে।
কুমালো নড়াচড়া করছে। চোখ মেলে তাকাচ্ছে ও, তবে কেমন যেন হতবুদ্ধি একটা ভাব। তার মাথাটা তুলে ধরে অর্ধেকটা পানি গলায় ঢেলে দিল কিশোর। বাকি অর্ধেক মুসার হাতে দিয়ে বলল, তোমরা দুজনে ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেল।