তিন ফুট খোঁড়ার পর কিশোর বলল, এবার থাম। দেখা যাক কি ঘটে?
চুইয়ে পানি উঠতে শুরু করল গর্তে। দেখতে দেখতে ভরে গেল তিন চার ইঞ্চি।
মিষ্টি পানি? মুসার জিজ্ঞাসা।
কি জানি, বলল কিশোর। আশা করছি। অনেক অ্যাটলেই ঘটে এটা। জাহাজডুবি হয়ে নাবিকেরা দ্বীপে ওঠার পর এমনি করে পানি বের করেই খেয়ে বেঁচেছে, শুনেছি।
দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলেও?
তা বলতে পারব না।
আমি পড়েছি, রবিন বলল। বষ্টি না হলেও পাওয়া যায়। সাগরের পানিই বালির স্তর ভেদ করে ওঠার সময় ফিলটার হয়ে যায়। লবণ অনেকখানি নষ্ট হয়ে যায় তাতে। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। পাথর আর বালির ফাঁকফোকর দিয়ে চলে যায় তলায়, জমা হয়ে থাকে।…হ্যাঁ, যথেষ্ট উঠেছে। এবার খেয়ে দেখ। সাবধান, বেশি নেড় না। নোনা পানির চেয়ে মিষ্টি পানি হালকা, থাকলে ওপরেই থাকবে।
খানিকটা পানি তুলে মুখে দিল মুসা। তারপর আরও দুই আঁজলা তুলে গিলে ফেলল। মাথা দুলিয়ে বলল, লবণ আছে, তবে ততটা নয়। সাগরের পানির চেয়ে কম।
খানিকটা তুলে কিশোরও মুখে দিল। হতাশ মনে হল তাকে। মুখ থেকে ফেলে দিয়ে বলল, খেয়ো না আর, ভাল না। পেটে সহ্য হবে না।
কিশোরের না বললেও চলত। কপাল টিপে ধরল মুসা। ওয়াক ওয়াক শুরু করল। মোচড় দিচ্ছে পেট। হড়হড় করে বমি করে ফেলল। সকালে নাস্তা যা খেয়েছিল বেরিয়ে গেল সব।
রাগ করে কিশোর আর রবিনের দিকে তাকাল। ধেত্তের তোমাদের মিষ্টি পানি! বইয়ে কি সত্যি কথা লেখে নাকি? ব্যাটারা জানে না শোনে না…মরা দ্বীপে কখনও আটকা পড়েছিল ওরা যে জানবে?
তা হয়ত পড়েনি, স্বীকার করল কিশোর। কিন্তু ইউ এস নেভির সারভাইভাল বুক-এও একথাই লিখেছে, আমরা যা করলাম ওরকম করেই পানি বের করতে বলেছে।
তাহলে বেরোল না কেন?
হয়ত এখানকার বালি মোটা বেশি, লবণ ঠিকমত ফিল্টার করতে পারে না। কিংবা হয়ত খুব বেশি বৃষ্টি হয়নি এখানে। আর হলেও হয়ত ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে।
অত সব হয়ত হয়ত শুনে তো লাভ নেই। সত্যি সত্যি হয় ওরকম কিছু কর।
মুসা, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু ভুলে যাচ্ছ, এই দ্বীপে তুমি শুধু একাই তৃষ্ণার্ত নও।
চুপ হয়ে গেল মুসা।
থেমে থাকল না ওরা। চলল পানির ক্লান্তিকর খোঁজে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল প্রাচীরের সব চেয়ে সরু জায়গাটায়, এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যাবার সেতু তৈরি করেছে যেটা। দেয়ালের একপাশে সারাক্ষণ আছড়ে পড়ে সাদা ফেনা সৃষ্টি করছে সাগরের ঢেউ, আরেক পাশে নীল ল্যাগুনের সাদা সৈকত ঢালু হয়ে নেমে গেছে পানিতে। কাঁচের মত মসৃণ ল্যাগুনের পানি। এখানটায় গভীরতা বারো ফুটের বেশি নয়। নিচে যেন গজিয়ে উঠেছে এক পরীর, শহর, তাতে গাঢ় লাল প্রাসাদ, স্তম্ভ, প্যাগোডা, মিনার, সবই রয়েছে, তৈরি করেছে খুদে প্রবাল-কীট।
অতি চমৎকার দৃশ্য, মন ভরে যেত যদি গরম, ক্লান্তি, চোখ জ্বলা, এবং খাবার আর পানির ভাবনা ভুলে থাকা যেত। কিন্তু তা থাকা সম্ভব নয়।
সেতুর ওপাশেই আবার চওড়া হতে শুরু করেছে দেয়াল। ঘন্টাখানেক ধরে অন্য দ্বীপটায় খোঁজাখুঁজি করল ওরা। পানি পাওয়া গেল না। পাথরের খাঁজে, গর্তে পানি জমে রয়েছে, সবই নোনা। নারকেলের গোড়া আছে, কাণ্ড আছে, কোনটারই মাথা নেই, ফলে পাতা বা ফলও নেই। কোন কোন গুঁড়ির মাঝে গর্ত হয়ে আছে, ওগুলোতেও জমে-থাকা পানির খোঁজ করল ওরা। পেল না। শুকিয়ে গেছে।
অবশেষে পাওয়া গেল একটা নারকেল! আটকে রয়েছে পাথরের খাঁজে। ঢেউও ভাসিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ছোবড়া ছাড়াল ওরা। মাথার ওপরের দিকে ফাটা। ফাঁকের ভেতরে ছুরি ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে ওপরের অংশটা তুলে ফেলল কিশোর। ভেতরের জিনিস দেখে গুঙিয়ে উঠল তিনজনেই।
খাইছে! বিলাপ শুরু করবে যেন মুসা। এক্কেবারে পচা!
ফাটা দিয়ে মালার ভেতরে নোনা পানি ঢুকে নারকেলের পানি আর শাঁসের সর্বনাশ করে দিয়েছে।
ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে শাস ফেলে মালা পরিষ্কার করতে করতে কিশোর বলল, যাক, একটা কাপ পাওয়া গেল।
লাভ কি? বলল রবিন, কি রাখব এটাতে?
দেখা যাক। কিছু না কিছু পাওয়া যাবেই।
খোঁজ চালিয়েই গেল ওরা। পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে সূর্য। খাবার লাগবে, জানান দিল ওদের পেট, পানির তাগাদা দিতে শুরু করল।
এই যে পানি! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
কি পেয়েছে দেখার জন্যে তাড়াতাড়ি কুঁকে এল রবিন আর মুসা। পাথরের ফাঁকে মাটিতে শেকড় গেড়ে আছে চ্যাপ্টা এক ধরনের উদ্ভিদ।
হুঁহ, পানি! হতাশ হল মুসা।
মুসার কথায় কান দিল না কিশোর। নরম একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে মুখে পুরে চিবাতে শুরু করল। ঠাণ্ডা রসে ভরা পাতাটা। শুকনো মুখ আর খসখসে জিভে ভিজে পরশ বোলাল। হাসি ফুটল তার মুখে।
একটা পাতা ছিঁড়ে মুসাও মুখে পুরল। বলল, হুঁ, ভালই। কিন্তু আর হেঁড়ার জন্যে হাত বাড়াল না।
রবিনও ছিঁড়ল একটা। বেশি না। তিনজনের মনেই এক ভাবনা। গাছটা তুলে নিয়ে যেতে হবে তাদের দ্বীপে। ওদেরই যখন এত পিপাসা, আহত কুমালোর নিশ্চয় আরও অনেক বেশি।
ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছে কুমালো। চোখ মেলল। জ্বরে লাল টকটকে।
সামান্য পানি নিয়ে এসেছি, কুমালো, কিশোর বলল। তবে এই পানি গিলতে পারবে না, চিবাতে হবে। তোমরা একে কি বল, জানি না, বইয়ে এর নাম পড়েছি পিগউইড।