দুটোই আছে বোটে, বলল রবিন। নিয়ে আসব গিয়ে?
না। ওকেই নিয়ে যেতে হবে বোটে। বাংকে শুইয়ে দিতে হবে। কিন্তু, নেয়াই হয়ে যাবে মুশকিল। মুসা, তুমি বরং গিয়ে বোটটা কাছে নিয়ে এস। দাঁড়াও দাঁড়াও, ইঞ্জিনের শব্দ…
ঠিকই শুনেছে সে। চালু হয়েছে বোটের ইঞ্জিন। ডেংগুই বোধহয় নিয়ে আসছে, রবিন বলল। অনুশোচনা হয়েছে তাহলে।
প্রাচীরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বোটটা। ল্যাগুন পেরিয়ে এসে ঢুকল উপসাগরে। ইতিমধ্যে নিজের শার্ট দিয়ে পেঁচিয়ে কুমাােের জখমের ওপরে টর্নিকেট বেঁধে ফেলেছে কিশোর। তার জানা আছে পনেরো মিনিট পর পর ঢিল দিয়ে আবার বাঁধতে হবে।
ডেংগু বোটটা নিয়ে আসছে বলে তার ওপর থেকে রাগ অনেকখানি কমল কিশোরের। মুসা, ওকে দেখিয়ে দাও কোন জায়গায় বোট রাখবে।
ইঞ্জিন থেমে গেছে। মুখ তুলে তাকাল কিশোর। অবাক হল। তীর থেকে এখনও একশো ফুট দূরে রয়েছে বোটটা।
এই-ই, আরেকটু সামনে আনতে হবে, চেঁচিয়ে হাত নেড়ে বলল মুসা।
জবাবে খিকখিক হাসি শোনা গেল। হুইল মোরাল ডেংগু। বোটের নাক ঘুরে গেল আরেক দিকে।
ভুল করছ, বাবা, হেসে বলল ডেংগু। তীরে ভেড়ানর জন্যে আনিনি। যাবার আগে শুধু কয়েকটা কথা বলতে এলাম তোমাদের সঙ্গে।
বোকা হয়ে গেল কিশোর।
হাঁ করে ডেংগুর দিকে তাকিয়ে আছে তিনজনে।
যাবার আগে মানে? কিশোর বলল। কি বলতে চাইছেন? গলা কাঁপছে তার।
বুঝলে না? একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, মানতে পারনি। কাজেই একাই যেতে হচ্ছে আমাকে। সোজা পোনাপেতে চলে যাব। একটা জাহাজ আর ডুবুরি ভাড়া করে নিয়ে ফিরে আসব।
পারবেন না। নেভিগেশনের কিছু জানেন না।
তাতে কি? পোনালে অনেক বড় দ্বীপ। সোজা দক্ষিণে চলতে থাকব। এক সময় না এক সময় পেয়েই যাব দ্বীপটা।
কিন্তু কুমালোকে ডাক্তার দেখানো দরকার। এখানে থাকলে ও মরে যাবে। এভাবে একজন মানুষ মরবে, ভাবছেন না সে কথা?
কেন ভাবব? ও তো একটা কানাকা।
বলেন কি! এরকম একটা জায়গায়…,হারিক্যানে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দ্বীপটার ওপর চোখ বুলিয়ে আতঙ্কিত হল কিশোর। এখানে ফেলে যেতে পারেন না আমাদেরকে। আপনি ফেরা পর্যন্ত বাচব না। কোন খাবার নেই। একটা কাঁকড়াও দেখিনি এতক্ষণে। ছায়া নেই, উড়ে যে বানাব তারও উপায় দেখি না। পানি নেই। পিপাসায়ইরে যাব। আর এতগুলো খুনের দায়ে সারা জীবন জল খাটতে হবে আপনাকে।
একবার খেটেছি, ডেংগু বলল। আর ঢাকার ইচ্ছে নেই ওখানে। এজন্যেই গুলি করে মারলাম না তোমাদের। যদি কেউ তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করে-করবে বলে মনে হয় না—যদি করেই, বলব আমি না ফেরাতক দ্বীপে থাকবে ঠিক করেছিলে তোমরা। বাঁচতে পারনি, কোন কারণে মরে গেহ, তার আমি কি করব?
থ্রটলের দিকে হাত বাড়াল ডেংগু।
দাঁড়ান! মরিয়া হয়ে বলল কিশোর। একটা কথা অত রাখুন। ফার্স্ট এইড কিট থেকে পেনিসিলিনের টিউব আর সালফার কৌটাটা দিয়ে যান। কাছে আসার দরকার নেই। ছুঁড়ে মারুন।
হেসে উঠল ডেংগু। ওগুলো আমারও দরকার হতে পারে, খোকা। দূর যাত্রায় যাচ্ছি তো। কখন কি ঘটে যায়, বলা যায় না। তখন পাব কোথায়? চলি। গুড় বাই।
হালকা বাতাস ঠেলে বোটটাকে অনেকটা কাছে নিয়ে এসেছে। হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিল মুসা। জোরে সাঁতরে চল বোটের দিকে। দেখাদেখি কিশোরও গিয়ে পানিতে পড়ল। প্রথমবারের চেষ্টায় ইঞ্জিন স্টার্ট না নিলে হয়ত বোটটাকে ধরে ফেলতে পারবে ওরা। খালি হাতে পারবে না ডেংগুর সঙ্গে, পারেনি চারজনে মিলেও, তার ওপর ওর কাছে রয়েছে রিভলভার। কি করে কাবু করবে এত শক্তিশালী শত্রুকে, একবারও ভাবল না ওরা।
চালু হয়ে গেল ইঞ্জিন। ঘুরতে শুরু করে প্রপেলার। খুব ধীরে গতি নিতে লাগল ভারি বোটটা। একসময় আশা হল ছেলেদের, ধরে ফেলতে পারবে। কিন্তু পরক্ষণেই গতি বাড়ল, ওদের চেয়ে দ্রুত চলতে শুরু করল ওটা।
আর চেষ্টা করে লাভ নেই, থেমে গেল কিশোর আর মুসা। তাকিয়ে রয়েছে বোটের দিকে।
ল্যাগুনের প্রবেশমুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওটা। দেয়ালের কাঁধের ওপাশে হারিয়ে যাবার আগের মুহূর্তে ওদের দিকে ফিরে হাত নাড়ল ডেংগু।
আর কিছু দেখার নেই। শুধু বোটের রেখে যাওয়া ঢেউ ছাড়া। চিৎকার করে উঠল সেই গাংচিলটা। ওই একটা পাখি ছাড়া জীবন্ত আর কোন প্রাণী যেন রেখে যায়নি রিক্যান।
আর কি করব! চল, বলে তীরের দিকে সাঁতরাতে শুরু করল কিশোর।
আস্তে আস্তে সাঁতরে তীরে ফিরে এল ওরা। ডাঙায় উঠে এসে ধপ করে প্রায় গড়িয়ে পড়ল কুমালোর পাশে।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দা। যা ঘটে গেছে, বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও। রুক্ষ প্রবালের স্কুপের ওপর ঘুরে এল ওদের দৃষ্টি।
হঠাৎ হাসতে শুরু করল মুসা। হতাশার দুর্বল হাসি। রবিনসন ক্রুসসা পড়ার পর কতবার ভেবেছি, ইস, ওরকম কোন দ্বীপে গিয়ে যদি থাকতে পারতাম, কি মজা হত। কিন্তু মরুভূমির চেয়ে খারাপ এরকম একটা জাগায় আটকা পড়ব, কল্পনাও করিনি কোনদিন!
২
নড়েচড়ে গুঙিয়ে উঠল কুমালো। যন্ত্রণার ছাপ চেহারায়, ভাঁজ পড়ল কপালে। চোখ মেলল সে। একে একে দেখল কিশোর, রবিন আর মুসার মুখ। কি ঘটেছিল, মনে পড়ল সব।
সরি, বেহুশ হয়ে গিয়েছিলাম, উঠে বসার চেষ্টা করল কুমালো। পারল না। চিত হয়ে শুয়ে পড়ল আবার। বিকৃত করে ফেলেছে চেহারা।