আর আছে ফুল। নানা জাতের অর্কিড আঁকড়ে রয়েছে গাছের ডাল, কাণ্ড। বুগেনভিলিয়া, হিবিসকাস আর কনভলভুলাসের বাগানে যেন বসন্ত এসেছে।
সচল রঙেরও অভাব নেই এখানে। গাছে গাছে উড়ছে আর কর্কশ চিল্কার করছে লাল-সবুজ কাকাতুয়া। ঝিম মেরে বসে রয়েছে ঘন নীল মাছরাঙা। পড়ন্ত রোদে চিকচিক করছে ঘুঘুর পালক। আরও অনেক পাখি আছে, বেশির ভাগের নামই জানে না সে। বিচিত্র ওগুলোর রঙঃ লাল, সবুজ, কালো, সাদা, নীল, হলুদ।
পাখির ডাকে মুখরিত হয়ে আছে গ্রামটা। তার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে যেন লোকের মৃদু আলাপ। কাছেই কোথাও গিটার বাজিয়ে গান গাইছে কারা যেন।
ফিরে তাকাল কিশোর কুমালো, মুসা আঃ রবিনেরও ঘুম ভেঙেছে। উঠে বসেছে। অবাক হয়ে দেখছে, কান পেতে শুনছে।
স্বপ্ন দেখছি, তাই না? মুসা বলল।
হয়ত, বলল কিশোর। ঘুম ভাঙলে হয়ত দেখব এসব কিছুই নেই। নারকেলের কাণ্ড আঁকড়ে ধরে সাগরে ভাসছি…
ঘরের ভেতরে কথা শোনা গেল। কয়েকটা মেয়ে আর একজন বয়স্ক মহিলা বেরিয়ে এল পানি আর খাবারের পাত্র নিয়ে। সেগুলো রাখল অভিযাত্রীদের সামনে। নানারকমের মাছ, কবুতরের রোস্ট, মিষ্টি আলু সেদ্ধ আর একঝুড়ি ফল।
ওরা খাবার সময় কাছে এসে বসল বৃদ্ধ মোড়ল। হাসি হাসি মুখ।
এ-জায়গাটার নাম কি? খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল কিশোর। জিভের ফোলা আর এখন নেই।
কুয়াক ট্রাক দ্বীপপুঞ্জের একটা দ্বীপ।
ট্রাক, যাকে দক্ষিণ সাগরের স্বর্গ বলা হয়। এর নাম অনেক শুনেছে কিশোর। বিশাল এক ল্যানকে ঘিরে রেখেছে একশো চল্লিশ মাইল লম্বা প্রবালের দেয়াল।
দেয়ালের ভেতরে ল্যাণ্ডনের বুকে গজিয়ে উঠেছে দুশো পঁয়তাল্লিশটা দ্বীপ।
এই দ্বীপটা কি ল্যাগুনের মধ্যে?
না। দেয়ালের ওপর। ওই যে, ওদিকে সাগর। আর এদিকে ল্যাগুন।
আমেরিকান নেভির লোক আছে এখানে?
মূল দ্বীপটাতে আছে। সকালে গিয়েছিলাম তোমাদের খবর জানাতে। সঙ্গে সঙ্গেই আসতে চাইছিল ওরা, আমি বারণ করেছি। বলেছি কাল সকালে যেন আসে, ততক্ষণ আমার মেহমান হয়ে থাকবে তোমরা। ওরা বলল, পোনাপে থেকে নাকি বোট নিয়ে বেরিয়েছিলে তোমরা, তারপর নিখোঁজ হয়েছ। কাল নেভির একটা হসপিটাল শিপ যাবে পোনাপে আর মার্শাল দ্বীপে, ইচ্ছে করলে ওটায় করে যেতে পার। হাসল বৃদ্ধ। কিংবা থেকেও যেতে পার এখানে, যতদিন ইচ্ছে। আমরা খুর খুশি হব।
চোখে পানি এসে গেল কিশোরের। আপনাদের দয়ার কথা কোনদিন ভুলব না। থাকতে পারলে খুশিই হতাম। কিন্তু পোনাপেতে জরুরি কাজ আছে। আমাদের।
পরদিন সকালে ক্যানুতে করে ট্রাকের মূল দ্বীপে পৌঁছে দেয়া হল অভিযাত্রীদের।
হসপিটাল শিপটা আধুনিক যন্ত্রপাতি সজ্জিত একটা সত্যিকারের হাসপাতাল। এক্স-রে মেশিন আছে, চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আছে, আছে ফার্মেসী, ল্যাবরেটরি। দ্বীপ থেকে দ্বীপে ঘুরে বেড়ায়, অসুস্থের সেবা করে, দেশী মেয়েদেরকে নার্সের ট্রেনিং দেয়।
ধবধবে সাদা বিছানায় শোয়ানো হল অভিযাত্রীদের। চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল সাথে সাথেই। কুমালোর জখম দেখে ডাক্তার বললেন, ঘা প্রায় শুকিয়ে এসেছে।
তিন দিন পর পোনাপেতে পৌঁছল জাহাজটা। রেডিওতে আগেই খবর পাঠানো হয়েছে। তৈরিই হয়ে ছিল কমাণ্ডার ফেলিকস ম্যাকগয়ার। জাহাজের নোঙর পড়তে
পড়তেই ওটার গায়ে এসে ঘেঁষল তার বোট।
অভিযাত্রীদের সঙ্গে দেখা হতেই প্রশ্ন শুরু করল, কোথায় ছিলে তোমরা? কি হয়েছিল? অ্যাটলে থেকে গেলে কেন? কেন ফিরলে না বোটে করে?
হেসে উঠল কিশোর। আহা, একটা করে প্রশ্ন করুন। নইলে জবাব দিই কি করে? আচ্ছা, আগে বলুন, ডেংগু ফিরেছে?
ডেংগু? ডেংগুটা আবার কে?
ওহহো, ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনি তো আবার তাকে চেনেন রেভারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশন নামে।
ওঁকে উদ্ধার করেছে একটা মাছধরা নৌকো। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। খাবার পানি সব ফুরিয়ে গিয়েছিল, পরে সাগরের পানি খেয়েছেন। তাতেই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একটু সুস্থ হলে তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললেন, তোমরা নাকি ইচ্ছে করেই অ্যাটলে থেকে গেছ। তিনি আবার ফিরে গেলে তারপর আসবে।
সব মিথ্যে কথা, কিশোর বলল। কুমালোকে গুলি করেছে। আমাদের ওখানে ফেলে রেখে এসেছে মরার জন্যে। ওই লোক মিশনারি নয়, মুক্তো ব্যবসায়ী। আর তার নামও রাইডার ভিশন নয়, ডেংগু পারভি। ওই অ্যাটলে একটা মুক্তোর খামার আছে। ওটাই লুট করতে চেয়েছিল সে।
হাঁ করে তাকিয়ে রইল ম্যাকগয়ার। তাই নাকি? আশ্চর্য!
এখন কোথায় সে? এখানেই?
না। বড় একটা বোট ভাড়া করে, মাঝিমাল্লা নিয়ে আবার বেরিয়েছে। আমরা তো ভাবলাম তোমাদের আনতে গেছে। পরে যখন শুনলাম, তোমরা প্রায় মরতে মরতে, এসে ট্রাক দ্বীপে উঠেছ, শুনে তো চমকে গেলাম।
গেছে কতদিন হল?
এই হপ্তাখানেক। কখন ফিরবে বলেনি। আবোলতাবোল কথা বলছিল। সে নাকি রামধনুর দেশ থেকে সোনার সিন্দুক তুলে আনতে যাচ্ছে। এখনও নব্বই ভাগ পাগল। একটা লগবুক সারাক্ষণ বগল তলায় চেপে রাখত, কাউকে ছুঁতেও দিত। না। কেউ দেখার কথা বললেই খেপে যেত। কোন জায়গায় যাচ্ছে, অবস্থান জানতে চেয়েছিলাম আমরা, বলেনি। ভাল নেভিগেশন জানে, এরকম একজন পলিনেশিয়ানকে নিয়ে গেছে। এক মুহূর্ত থেমে বলল ম্যাকগয়ার, এখন বুঝতে পারছি কোথায় গেছে। অ্যাটলেই যাবে।