কম-বেশি হুল অভিযাত্রীদের সবার শরীরেই ফুটল। জেলিফিশের এলাকা থেকে সরে আসার পরেও অনেকক্ষণ থাকল ওই হুলের জ্বালা। আশার গায়ে লেগে আছে থিকথিকে জেলির মত জিনিস, জেলিফিশের গা থেকে লেগেছে, ওগুলোও বিষাক্ত।
পরদিন দেখা গেল একটা পাখি। মৃত্যুদ্বীপ থেকে আসার পর এই প্রথম পাখি চোখে পড়ল ওদের। কিছুক্ষণ পর উড়ে এল আরও অনেক পাখি, নডি, বুবি। পাক খেয়ে খেয়ে উড়তে লাগল ভেলাটাকে ঘিরে।
এরমানে, কুমালো বলল। ডাঙা দূরে নয়।
রক্তলাল উৎসুক চোখ মেলে ডাঙা খুঁজল চারজোড়া চোখ। কিন্তু দিগন্তের কোথাও নারকেল গাছের একটা মাথাও চোখে পড়ল না।
কোন কিছুই আর ভাল লাগছে না এখন ওদের। সব কিছুতেই বিরক্তি। এমন কি নিজেদের সান্নিধ্যও খারাপ লাগছে, সইতে পারছে না একে অন্যকে। বুঝতে পারছে কিশোর, এই অবস্থা আর দুদিন চললেই পাগল হয়ে যাবে সবাই।
মুসা বলল, রবিনকে একই ভেলায় আর সইতে পারছে না সে। রবিন ঘোষণা করে দিল, হাতের কাছে কিছু একটা পেলেই মুসার মুখে ছুঁড়ে মারবে ওটা।
প্রত্যেকেই ভাবছে, সে ছাড়া বাকি তিনজন পাগল। আবোল-তাবোল কথা বলছে। দেশী ভাষায় অনর্গল বকবক করে যাচ্ছে কুমালো। কিশোর বলল, আর পানিতে থাকছি না আমি। এবার সৈকতে উঠব।
হেসে উঠল মুসা। ডুব দিয়ে কিশোরের পা টেনে ধরে তাকে ডুবিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। ভেসে উঠে হা হা করে হেসে বলল, কেমন উঠলে সৈকতে? দিলাম তো ঠেকিয়ে।
মেঘ দেখতে পেল কিশোর। অথচ মেঘের চিহ্নও নেই কোথাও। তারপর দেখল নারকেল গাছের মাথা। সবুজ গাছপালায় ছাওয়া দ্বীপ। পাহাড়ের ওপর থেকে বনের মাথায় ঝরে পড়ছে জলপ্রপাত।
খেয়ালই করল না ওরা, কখন বাতাসের বেগ বাড়ল, কালো মেঘ জমল, ফুCে উঠল সাগর। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হল। ওপরের দিকে হা করে পানি খাওয়ার কথাও মনে এল না কারও। তবু করল, শরীরের স্বাভাবিক তাগিদেই বোধহয়। অনেক দিন পর পাকস্থলীতে ঢুকল মিষ্টি পানি।
কুঁসে উঠল সাগর। ছোট্ট ভেলাটাকে ঠেলে নিয়ে চলল দক্ষিণ-পশ্চিমে। নিজেদের অজান্তেই অনেকটা, কাণ্ডগুলো আঁকড়ে ধরে রইল ওরা।
ঝড়ের অন্ধকার মিশে গেল রাতের অন্ধকারের সঙ্গে। ঘোরের মধ্যে থেকে যেন কিশোরের কানে আসছে বাতাসের গর্জন, অনুভব করছে ঢেউয়ের দোলা।
তারপর শুনতে পেল আরেকটা গর্জন। বাতাসের নয়। তীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার।
বিচিত্র কাণ্ড শুরু করেছে ভেলাটা। কিসের টানে যেন দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে আবার, আবার এগোচ্ছে…
কয়েকবার এরকম করে হঠাৎ টান লেগে ছিঁড়ে গেল বাঁধন। আলাদা হয়ে গেল দুটো কাণ্ড। আর আঁকড়ে ধরে রাখতে পারল না কিশোর। ডুবতে শুরু করল। পায়ের তলায় ঠেকল মাটি!
ধাক্কা দিয়ে আবার তাকে ভাসিয়ে ফেলল ঢেউ। আবার ভোবাল। আবার ভাসাল। অবশেষে দেখল, কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে আছে সে।
হ্যাঁচকা টানে তাকে চিত করে ফেলল আবার পানি। টেনে নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলল বালিতে।
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে আরও কিছুদূর উঠে গেল কিশোর। ঢেউ পৌঁছতে পারছে না এখানে। চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বালিতে।
তারপর শুধুই অন্ধকার।
১০
চোখ মেলে একটা বাদামী মুখ দেখতে পেল কিশোর। কালো খোঁপায় লাল হিবিসকাস গোঁজা। হাতে একটা কচি ডাব। কাত করে ধরল তার ঠোঁটের কাছে।
ঠাণ্ডা মিষ্টি পানি পড়ল হাঁ করা মুখের ভেতর। ফোলা জিভের জন্যে গিলতে কষ্ট হল তার। কোনমতে গিলে নিল কয়েক ঢোক।
সূর্য উঠেছে, কিন্তু রোদ লাগছে না তার গায়ে। সে শুয়ে আছে ঘুন নারকেল
কুঞ্জের ছায়ায়। ফলে বোঝাই গাছগুলো। বাতাসে ভেসে আসছে ফুলের সুবাস।
তার পাশেই শুয়ে আছে রবিন, মুসা আর কুমালো। তাদের সেবাযত্ন করছে আরও কয়েকটা মেয়ে। গাছপালার ভেতরে কয়েকজন পুরুষকে দেখা যাচ্ছে। এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে কিশোর, আবার চোখ বুজে ফেলল। বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে, টের পাচ্ছে। আস্তে শুইয়ে দেয়া হল। কানে আসছে অনেক কণ্ঠস্বর। কাঠের ধোঁয়া আর খাবারের জিভে-পানি-আসা গন্ধ নাকে এল।
চোখ মেলল আবার কিশোর। গাঁয়ের একটা কুঁড়ের বারান্দায় শুইয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। বেড়া বেয়ে ছাতে উঠে গেছে লতা, নানা রঙের ফুল ফুটে আছে। বড় বড় আম গাছে আম ধরে আছে, ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে ডাল।
বারান্দায় ভিড় করে আছে অনেকগুলো বাদামী মুখ। কৌতূহলী দৃষ্টিতে, তাকিয়ে আছে অভিযাত্রীদের দিকে।
তার ওপর ঝুঁকল একটা মুখ, সেই মেয়েটা। হাসল কিশোর। কাঠের একটা পাত্র থেকে কাঠের চামচ দিয়ে খাবার নিয়ে বাড়িয়ে ধরল। কিশোর হাঁ করতেই ঢেলে দিল তার মুখে। রুটিফল, কলা আর নারকেল দিয়ে বানানো এক ধরনের মণ্ডের মত খাবার।
খুব ধীরে ধীরে গিলতে লাগল কিশোর।
পাশে এসে তার মাদুরের ওপর বসল এক বৃদ্ধ। তাকে অবাক করে দিয়ে ইংরেজিতে কথা বলে উঠল, আমি নুলামা। এ-গাঁয়ের মোড়ল। অনেক ভুগেছ তোমরা। আমাদের এখানে যখন আসতে পেরেছ, আর ভাবনা নেই। খেয়েদেয়ে ঘুম দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।
.
আবার যখন চোখ মেলল কিশোর, দেখল গাছপালার লম্বা ছায়া পড়েছে। নিশ্চয় শেষ বিকেল। শান্ত স্নিগ্ধ গাঁয়ের দিকে চোখ বোলাল সে। নির্দিষ্ট কোন রাস্তা নেই। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কুঁড়েগুলো।
গাছে গাছে ছেয়ে রয়েছে! আম তো আছেই। আছে রুটিফল, কলা, কমলা, লেবু, নারকেল, ডুমুর, পেঁপে, তুঁত। ফলে ফলে বোঝাই।