এই অবস্থাকে বলে ইমারসন ফুট, কিশোর বলল। এরপর দেখা দেবে ফোঁড়া। নোনা পানির ফোঁড়া।
রোদে পুড়ে গেছে চামড়া। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে চোখ, ভীষণ জ্বালা করছে।
পানির অভাবে শুকিয়ে ঠোঁট ফেটে গেছে। ফুলে উঠেছে জিভ, মুখগহুর ভরে দিয়েছে যেন। কথা বলতে অসুবিধে হয়। নোনাপানি দিয়েই গরগরা করল মুসা, গিলেও ফেলল খানিকটা।
সাবধান, হুঁশিয়ার করল কিশোর। পেটে খুব সামান্য গেলে ক্ষতি নেই। কিন্তু একবার খাওয়া শুরু করলে আর লোভ সামলাতে পারবে না।
শরীরের লবণ দরকার হয়, প্রতিবাদের সুরে বলল মুসা। খেলে ক্ষতিটা কি বুঝি না।
বেশি খেলে প্রথমে জ্ঞান হারাবে, রবিন বলল। তারপর দুটো ব্যাপার ঘটতে পারে। হুঁশ ফিরে পাবে, তবে মাথায় গণ্ডগোল হয়ে যাবে। কিংবা একেবারেই আর ফিরবে না।
তাতেই বা কি? তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। এমনিতেই পাগল হব, কিংবা মরব। তারচে খেয়েই মরি। কপালে হাত রেখে সামনে তাকাল সে। পাগল বোধহয় হতেই শুরু করেছি। নানারকম গোলমেলে জিনিস দেখছি।
কি দেখছ? মেঘ করেছে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। ওই তো, দক্ষিণ-পশ্চিমে দেখাল সে। আমি জানি, চোখের ভুল…
ভুল নয়! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। সত্যি বৃষ্টি হচ্ছে, আধ মাইল দূরেও হবে না। চল চল, জলদি চল!
চারজনে মিলে ঠেলতে শুরু করল ভেলাটাকে। দ্রুত সাঁতরে চলল মেঘের দিকে।
কিন্তু হতাশ হতে হল ওদেরকে। ওরাও পৌঁছে সারল, বৃষ্টি থেমে গেল। হেসে উঠল রোদ, যেন ব্যঙ্গ করল অভিযাত্রীদের।
দেখ দেখ, ওই যে আরেকখানে হচ্ছে? রবিন দেখাল এবার। সিকি মাইল পশ্চিমে। কাছেই, ওটাতে সময়মত পৌঁছানো যাবে এই আশায় ভেলা ঠেলে নিয়ে চলল ওরা। হালকা বাতাসে ভেসে এসেছে একটুকরো কালো মেঘ, ওটা থেকেই। বৃষ্টি পড়ছে।
সাঁতরে চলেছে ওরা। মেঘটাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস। ওরা যতই জোরে সাঁতরায়, বাতাসও ততই জোরে বয়। যেন খেলা জুড়েছে ওদের সঙ্গে। ওরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, কিন্তু বাতাসের ক্লান্তি নেই। তবু আশা ছাড়তে পারল না ওরা। : অবশেষে ঝরে ঝরে শেষ হয়ে গেল মেঘটা। রোদ দেখে বিশ্বাস করার উপায় নেই কয়েক মিনিট আগেও কেঁপে বৃষ্টি হচ্ছিল ওখানে।
কি মনে হয়? মুসা জিজ্ঞেস করল। সবই কি আমাদের কল্পনা?
নিশ্চয় না, বলল কিশোর। আমরা সবাই দেখেছি, তাই না? কেউ জবাব দিল না দেখে কুমালোকে বলল, কথা বলছ না কেন? দেখিনি?
মনে তো হল…, দ্বিধা করছে কুমালো। আসলে, কোন কিছুকেই আর বিশ্বাস করতে পারছি না।
এই যে আরেক কাণ্ড, এটাকেও বিশ্বাস করতে পারছি না! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। অথচ হাতে লাগছে। ধরতেও পারছি। বড়শিটা বেঁধে রাখা হয়েছে কাণ্ডের সঙ্গে, তাতে আটকা পড়েছে একটা অ্যালবাকোর মাছ। মাছটা তুলে দেখাল সে। কালো, চকচকে শরীর। বেশি বড় না, মাত্র দেড় ফুট। তবে বেশ মোটাসোটা, ভাল মাংস।
ছুরি নিয়ে ক্ষুধার্ত হায়েনার মত মাছটাকে আক্রমণ করল ওরা। দেখতে দেখতে কাঁটাগুলো ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। ছোট একটা টুকরো সরিয়ে রাখল কুমালো, বড়শির টোপের জন্যে।
অনেকটা সুস্থ বোধ করল ওরা, পিপাসাও কমল সামান্য। অ্যালবাকোরের রসাল মাংসে পানি আছে। তবে একেকজনের ভাগে যেটুকু পানি পড়ল, বড় এক চামচের বেশি না।
বড়শিতে টোপ দেয়ায় তাড়াতাড়িই আকৃষ্ট হল শিকার, একটা বাচ্চা করাত মাছ। ধরা পড়ার পর আর রেহাই নেই, তুলে ওটাকে যত দ্রুত পারল সাবাড় করে দেয়া হল, টোপের জন্যে খানিকটা মাংস রেখে।
শিশু করাত যেখানে আছে, ধাড়িও থাকতে পারে। একটু পরেই দেখা গেল। ওটাকে। আলোড়ন তুলল পানিতে।
ওই দে! কুমালোকে দেখাল মুসা।
ছোট মাছের ঝাঁককে আক্রমণ করেছে বিশাল এক করাত মাছ। যোলো ফুটের কম হবে না। করাত দিয়ে দুটুকরো করে ফেলছে মাছগুলোকে, তারপর গপাগপ গিলছে। মারাত্মক ওদের করাত। তিমিকেও ছেড়ে কথা কয় না। অনেক সময় হারেও তিমি।
বিশাল করাতের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করল ওরা। কাটা মাছের টুকরো ভেসে উঠছে পানিতে। নিয়ে আসছে ওগুলো মুসা আর কুমালো। জমাচ্ছে জেলার ওপর।
রক্তের গন্ধে এসে হাজির হল মস্ত এক টাইগার শার্ক। কাটা মাছগুলো খেতে শুরু করল।
এটা মোটেই পছন্দ হল না করাত মাছের। সোজা গিয়ে করাত চালিয়ে দিল হাঙরের গায়ে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোল হাঙরের। পালাবে না পাল্টা আক্রমণ করবে ঠিক করতে পারছে না যেন।
দশ মিনিটের মধ্যে হাজির হয়ে যাবে হাঙরের পাল, শঙ্কিত হয়ে বলল কুমালো। চল, এখানে থাকা আর নিরাপদ না।
ভেলা ঠেলে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে এল ওরা। পেছনে তাকিয়ে দেখল, খানিক আগে যেখানে ছিল ওরা সেখানকার পানি যেন টগবগ করে ফুটছে। অসংখ্য হাঙর এসে হাজির হয়েছে। রক্তাক্ত হয়ে গেছে পানি।
আরও দূরে সরে এল ওরা। তারপর কাঁচা মাছ খাওয়ায় মন দিল।
বড় উপকার করল করাতটা, চিবাতে চিবাতে বলল মুসা। নাহ, ততটা দুর্ভাগা নই আমরা। কপাল মাঝে মাঝেই ভাল হয়ে যায়।
কিন্তু তারপর যতই সময় গেল কপাল আবার খারাপ হতে লাগল। মাছ আর চোখেই পড়ে না এখন। শুধু জেলিফিশ। ঘন হয়ে ছড়িয়ে আছে মাইলের পর মাইল জুড়ে। খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে ওগুলোর ভেতর দিয়ে। জেলিফিশের শুড়ে মারাত্মক বিষ। বড় বড় মাছকেও অবশ করে ফেলে।
জেলিফিশের সব চেয়ে খারাপ প্রজাতিগুলোর একটা সী ব্লাবার। লাল রঙ, সাত ফুট পুরু, একেকটা শুঁড় একশো ফুট লম্বা। সাঁতার কাটার সময় সাঁতারুর শরীরে অনেক সময় জড়িয়ে যায় ওই শুঁড়, বিষাক্ত হুল ফুটতে থাকে চামড়ায়। তখন অন্যের সাহায্য ছাড়া ওই শুঁড় খোলা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।