ভেলার নিচ দিয়ে কয়েকবার আসা-যাওয়া করল ওগুলো। কুমালাৈর মত মুসাও ছুরি বের করে তৈরি হয়ে আছে।
ভেলায় এসে উঠবে না তো? জিজ্ঞেস করল সে।
উঠতেও পারে। অনেক সময় নৌকায়ই উঠে পড়ে চুরি করে। ওঠার সময় লেজটাকে কাজে লাগায় ওরা। দুনিয়ার বেশির ভাগ প্রাণীই আক্রান্ত না হলে হামলা করে না। কিন্তু মোরের ওসব দ্রতা নেই। অযথাই লাগতে আসে। এক ইঞ্চি লম্বা দাঁতের সারি, ছুরির মাথার মত চোখা আর ধারাল।
ছুরির বাঁট শক্ত করে চেপে ধরল মুসা। আসুক। প্রথম যে ব্যাটা আসবে, মুণ্ড কেটে ফেলব।
তাতে আরও খারাপ হবে। রক্তের গন্ধে হাজির হয়ে যাবে হাঙর। তাছাড়া ঘাড়ের চামড়া সাংঘাতিক শক্ত ওগুলোর। সহজে কাটবে না। তবে লেজের চামড়া নরম।
চলে গেল একটা বান। খানিক পরেই আলতো ছোঁয়া লাগল মুসার পিঠে। সে ঘাড় ফেরার আগেই ছুরির বাঁট দিয়ে গায়ের জোরে বাড়ি মারল কুমালো।
যাক, বলল সে। এই একটা আর জ্বালাতে আসবে না।
মুহূর্ত পরেই এল আরেকটা। মুসার প্রায় মুখে লেজ বুলিয়ে গেল। তার দিকেই বানগুলোর নজর কেন, বোঝা গেল না। পিঁপড়েরাও তার প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হয়। আমাজানের জঙ্গল আর আফ্রিকাতেও সেই প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন শুরু করেছে। বান মাছগুলো। কাণ্ডের ওপর দিয়ে সাপের মত গড়িয়ে এল লেজ, আলতো ছোঁয়া লাগল মুসার মুখে। তারপরই উঠে এল মোটা শরীরটা, কুৎসিত মুখটা এগিয়ে আসছে নিঃশব্দে। হাঁ করা চোয়ালে তীক্ষ্ণ দত। তারার আলোয় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কুমালোর মতই ছুরি দিয়ে লেজে বাড়ি মারল মুসা। যন্ত্রণায় মোচড় দিয়ে উঠল বানের শরীর, লাফ দিয়ে নেমে গেল পানিতে।
চন্দ্র মাছের কাছে আর কোন সর্পিল ছায়াকে চোখে পড়ল না।
দুর্বল লাগছে মুসার। বান মাছগুলো আতঙ্কিত করে দিয়েছে তাকে, কাহিল। লাগছে সে-জন্যেই। ভেলায় উঠে শুয়ে পড়ল। ঘুম এসে গেল সঙ্গে সঙ্গে, কিন্তু পরমুহূর্তেই জেগে উঠল নাকে-মুখে পানি ঢুকে যাওয়ায়।
সবাই বুঝল, এখন ঘুমাতে না পারলে হয়ত মাথাই খারাপ হয়ে যাবে মুসার।
ওঠ, উঠে বস, কুমালো বলল। ঘোর। আমার কাঁধে মাথা রাখ…হ্যাঁ, ঘুমাও এবার।
তর্ক করতেও ইচ্ছে হল না মুসার। কুমালোর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। ঢেউ এখন আর তার নাক ছুঁতে পারছে না।
বাতাস বাড়ছে। শীত করতে লাগল ওদের। ভোরের দিকে অসহ্য হয়ে উঠল ঠাণ্ডা। দিগন্তে সূর্যের আগমনে তাই খুশি হল খুব। তরে ঘন্টাখানেকও লাগল না, দূর হয়ে গেল খুশি। ভাবল, এর চেয়ে ঠাণ্ডা রাতই আরামের ছিল।
ঘুমিয়ে বেশ ঝরঝরে হয়েছে মুসার শরীর। ফলে ক্ষুধাও লেগেছে, পিপাসাও। অনন্যরা ঘুমাতে পারেনি, ফলে এই অসুবিধেটা দেখা দেয়নি এখনও।
তবে ক্ষুধার কথাটা কাউকে বলল না সে।
নিজের হাতের তালু দেখল, অন্যদেরগুলোও দেখল। নোনা পানিতে ভিজে কুঁচকে গেছে চামড়া।
।মরেছি, বলল মুসা। চামড়ার যা অবস্থা, আর বেশিক্ষণ এই অবস্থা চললে খসে যাবে। রসিকতা করল, দাও দাও, কোল্ড ক্রীমের কৌটাটা দাও।
অন্যেরা ক্লান্ত। কাজেই ভেলার বড় মোটরটা হল এখন মুসা। জোরে জোরে ঠেলতে লাগল। আশা তাদেরকে নিরাশ করবে বলেই মনে হচ্ছে।
বেলা যতই বাড়ল, বাড়ল ক্ষুধা আর পিপাসা, সবারই। পানিতে থাকায় একটা উপকার হয়েছে, রোমকূপ দিয়ে আর্দ্রতা ঢুকছে, ফলে দ্রুত পানিশূন্যতার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে শরীর। ডাঙায়থাকলে আরও অনেক আগেই প্রচণ্ড পিপাসা পেত। এখানে ধীরে ধীরে আসছে পিপাসা, কিন্তু আসছে তো। রাত নাগাদ এত বেড়ে গেল, এখন যদি কেউ বলে এক গেলাস পরিষ্কার পানি দেবে, বিনিময়ে মুক্তা তিনটে দিয়ে দিতে হবে, সামান্যতম দ্বিধা করবে না কিশোর।
এই রাতে নিজেকে বালিস বানানর প্রস্তাব দিল মুসা। সবাই তার কাঁধে পালা করে মাথা রেখে ঘুমিয়ে নিক। প্রথমে ঘুমাল রবিন। তারপর কুমালো। সব শেষে কিশোর। শেষ দিকে নিজের চোখও আর খুলে রাখতে পারল না মুসা। কুমালে আর রবিন ভেলা ঠেলছে। কাণ্ড ধরে ভেসে রয়েছে সে। কাঁধের ওপর কিশোরের মাথা।
ঘুমিয়ে পড়ল মুসা। প্রায় একই সঙ্গে চমকে জেগে উঠল সে আর কিশোর। দুজনেই নাকেমুখে পানি ঢুকে গেছে। কাশতে আরম্ভ করল।
পরদিন সকালে কোথা থেকে এসে হাজির হল একঝাঁক বোনিটো। ভেলার সঙ্গে সঙ্গে চলল। বার বার ছোঁ মারল অভিযাত্রীরা, কিন্তু একটাকেও ধরতে পারল না।
বড়শির সুতো বানাতে পারলে কাজ হত, কাণ্ডের দিকে তাকিয়ে বলল। কুমালো। নারকেলের ছোবড়া দিয়ে তো বানানো যায়। কাণ্ডের আঁশ দিয়েও বোধহয় হবে।
দিনের অনেকটা সময় ব্যয় করল ওরা আঁশ বার করতে। জোড়া দিয়ে, পাকিয়ে তৈরি করে ফেলল একটা সুতো, যদিও মাত্র পাঁচ ফুট লম্বা। তবে শক্ত। বাকল কেটে একটা বড়শি বানাল কুমালো। সুতোর মাথায় বাঁধল সেটা। কিন্তু টোপ নেই।
টোপ ছাড়াই বড়শিটাকে পানিতে ঝুলিয়ে রাখল ওরা। আশা করছে, যদি কোন একটা বোকা বোনিটো খাবার মনে করে গিলে ফেলে?
চলে গেল বোনিটোর ঝক। অন্যান্য মাছ এল গেল, বড়শির দিকে নজর দিল কেউ।
আরেকটা ভয়ঙ্কর রাত পেরোল, কাটল দুঃসহ দিন। নোনা পানিতে ভিজে আর কাণ্ডের সঙ্গে ঘষা লেগে ঘা দেখা দিতে লাগল শরীরে। পা ফুলে যাচ্ছে। একধরনের ঝিনঝিনে অনুভূতি। লাল লাল দাগ পড়ছে, কোথাও কোথাও ফোসকা।