অত ভাবনার কিছু নেই, শান্তকণ্ঠে বলল কুমালো। এখনও বেঁচে রয়েছি, আমরা! দুটো কাণ্ড আছে। চারটে প্যান্ট আছে। তিনটে ছুরি আছে। আর আছে তিনটে মুক্তো…..
চট করে পকেটের ওপর হাত বোলাল কিশোর। বলল, আছে।
বেশ। তাহলে ওগুলো জায়গামত পৌঁছে দেয়া এখন আমাদের দায়িত্ব। এক কাজ করতে হবে। ভেলায় উঠে একজন করে জিরাব আমরা। অন্য তিনজনে পেছন থেকে ঠেলে নিয়ে এগোব। সোজা দক্ষিণে। ঠিক আছে?
এতে খুব একটা লার্জ হবে বলে মনে হল না কারও কাছেই। তবু, চুপচাপ একজায়গায় ভেসে থেকে মরার চেয়ে কিছু করা ভাল। কুমালোর কথা মতই কাজ শুরু করল ওরা।
খুবই ধীর গতিতে আবার দক্ষিণে এগিয়ে চলল দুই কাণ্ডের আশা।
৯
পালা করে ভেলায় উঠে বিশ্রাম নেয় ওরা। শক্ত কাণ্ডের ওপর শুয়ে থাকা, মুখের ওপর ঢেউ ভেঙে পড়া, মোটেই আরামদায়ক নয়। ঘন্টাখানেক পর সাগরে নেমে বরং আরামই লাগে।
আবার অনেকক্ষণ ধরে সাঁতার কেটে ভেলায় উঠতে পারলে সেটাও খানিকটা স্বস্তি।
তবে যতই সময় কাটতে লাগল এই আরাম আর স্বস্তি কোনটাই থাকল না।
দিনটা তো কাটল যেমন তেমন, রাতটা বড় বেশি দীর্ঘ মনে হল। ঘুমানো অসম্ভব! সারাক্ষণ জেগে থাকা, সতর্ক থাকা, ঢেউ এসে নাকে ঢোকে কিনা সে। খেয়াল রাখা, এক মহা বিরক্তিকর ব্যাপার। তন্দ্রা এলে, সামান্য অসতর্ক হলেই নাকেমুখে ঢুকে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ করে দিতে চায় পানি।
তার ওপর রয়েছে জলজ জীবের ভয়। আতঙ্কিত করে রেখেছে ওদের। চেনাঅচেনা অদ্ভুত সব প্রাণী নিচ থেকে উঠে আসছে আজব ভেলাটাকে পরীক্ষা করে দেখতে। সাগরে এত প্রাণী আর কখনও দেখেনি ওরা।
সাগরে অবশ্য এত প্রাণীরই বাস। কিন্তু জাহাজে কিংবা নৌকায় থেকে সেগুলো খুব কমই দেখা যায়। ওপর থেকে বড়জোড় কিছু ডলফিন আর উড়ুক্কু মাছ, ব্যস। গভীর পানির জীবেরা দানবীয় জলযানের কাছে আসতেই ভয় পায়।
এমনকি দুই কাণ্ডের প্রায় ডুবো ডুবো ভেলার চেয়ে সাত কাণ্ডের ভাসমান। ভেলাটাও অনেক বেশি ভয়াল ছিল ওগুলোর কাছে। এ দুটোকে নিজেদের মতই কোন প্রাণী ভাবল বোধহয় মাছেরা, তাই দেখতে এল।
নিচে তাকালেই দেখা যায় অসংখ্য আলো। যেন ওপরের তারাজ্বলা আকাশের মতই নিচেও আরেকটা আকাশ রয়েছে।
বেশি দেখছে মুসা। ওই যে গেল একটা লণ্ঠন মাছ।…একটা তারাখেকো।…খাইছে! ওটা কি?
বিশাল দুটো চোখ অলস ভঙ্গিতে অনুসরণ করে চলেছে ভেলাটাকে। প্রায় এক ফুট ব্যাস, জ্বলছে, হলদে-সবুজ আলো।
ওটা আমাদের পুরানো দোস্ত, কিশোর বলল। জায়ান্ট স্কুইড।
কেঁপে উঠল রবিন। ও দোন্ত হতে যাবে কেন! শুঁড় বাড়িয়ে ধরবে না তো ব্যাটা?
ধরতেই পারে,মুসা বলল। থাক, এসব অলক্ষুণে কথা বল না। বল, ও খুব ভাল মানুষ, এখুনি চলে যাবে। বলে ভেলায় ঠেলার জোর কিছুটা বাড়াল সে।
পেছনে পড়ল চোখ দুটো।
উদয় হল আরও বিচিত্র একটা জীব। স্কুইডের চোখের মতই অনেকটা, জ্বলন্ত, আরও অনেক বড়। ওটার ব্যাস আট ফুটের কম না। রূপালি আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ভেলার একেবারে নিচে চলে এল ওটা। ছয় ফুট নিচ দিয়ে অনুসরণ করে চলল। মস্ত এক পূর্ণিমার চাঁদ যেন।
বোবা হয়ে গেছে যেন ছেলেরা। মুসার বাহুতে হাত রাখল কুমালো। কাপছে মুসা। অন্য দুজনের অবস্থাও ভাল নয়। চোখই যার এতবড়, সেই দানবটা কত বড়!
চোখ নয় ওটা, কুমালো বলল। ওটা চন্দ্র মাছ। চাঁদের মতই গোল আর জ্বলে তো, সেজন্যে ওই নাম।
গোল মাছ? মুসা বলল। যাহ, বানিয়ে বলছ, আমরা যাতে ভয় পাই।
না, বানিয়ে বলছি না। মাথাটা দেখতে পাচ্ছি আমরা।
তাহলে বাকি শরীরটা কোথায়?
বাকি কোন শরীর নেই। মাথা ছাড়া আর কিছু নেই ওটার। সেজন্যেই অনেকে বলে মাথা মাছ। আরও একটা নাম আছে ওটার, সূর্য মাছ। দিনের বেলা, প্রায়ই ভেসে থেকে রোদ পোয়ায় তো।
মাথা ছাড়া আর কিছু নেই? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।
থাকে, ছোট বেলায়। লেজ। ধীরে ধীরে খসে যায় ব্যাঙের পোনার মত। আসলে মাথা ঠিক নয় ওটা, পুরো শরীরটাই। ওটার ভেতরেই রয়েছে ওর পেট আর শরীরের অন্যান্য যন্ত্রপাতি। সাঁতার কাটার জন্যে পাখনাও আছে।
বেশ বড়। ওজন নিশ্চয় টনখানেকের কম না।
হ্যাঁ। আরও বড় হয়। মাঝে মাঝে ক্যানুর তলা ঠেকে যায় পানির নিচে ভেসে থাকা মাথা মাছের গায়ে। মনে হয় ডুবো চরায় লেগেছে।
কয়েক মিনিট ধরে ভেলাটাকে অনুসরণ করল সাগরের চাঁদ। ওটা থাকতে থাকতেই এল চারটে সাপের মত জীব। রক্ত ঠাণ্ডা করে দেয়া চেহারা। ওগুলোর আলো নেই, চাঁদ মাছের আলোয় দেখা গেল কুৎসিত ভঙ্গিতে শরীর মোচড়াচ্ছে। আট-দশ ফুট লম্বা, মানুষের উরুর সমান মোটা।
সাপ নাকিরে বাবা? মুসা বলল।
না, মোরে, ছুরি বের করল কুমালো। এক ধরনের বান মাছ। এ-ব্যাটাদের ব্যাপারে হুঁশিয়ার। সব খায়। মানুষের মাংসেও অরুচি নেই।
হারামী জীব! বিড়বিড় করে বলল কিশোর।
হ্যাঁ, রবিন বলল। বইয়ে পড়েছি, প্রাচীন রোমানরা নাকি মোরে ইল পুষত, এক পুকুরে অনেকগুলো। রোজ সকালে ওগুলোর নাস্তার জন্যে জ্যান্ত মানুষ ফেলে দিত পুকুরে। যুদ্ধবন্দী কিংবা গোলামদের।
হাতে ছুরি নিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে পানির নিচে তাকিয়ে আছে কুমালো। আমরা ওদেরকে বলি ক্যামিচিক। অর্থাৎ ভয়ানক জীব। ব্যাটারা উভচর। গাছ বেয়ে ওপরে উঠে সাপের মত ওত পেতে থাকে। নিচে দিয়ে শিকার গেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। পোনাপৈতে একবার একজনকে কামড়ে দিয়েছিল একটা মোরে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেয়ার পরেও বাঁচেনি লোকটা, দুদিন পর মারা যায়।