ডাঙার টর্নেভোরও এই একই ধর্ম। একটা বাড়ি হয়ত উড়িয়ে নিয়ে গেল খড়কুটোর মত, ঠিক দশ ফুট দূরেই আরেকটা ঘর রইল একেবারে অক্ষত।
আমাদের কাছে আসবে না, বলল সে।
হয়ত, বলল বটে, তবে ততটা আশাবাদী হতে পারল না কুমালো।
পাল নামিয়ে ফেলব?
লাভ হবে না। নিতে চাইলে নিয়ে যাবেই। নামিয়ে রাখলেও নেবে, উঠিয়ে রাখলেও নেবে।
দানবটার দয়ার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে, এই ভাবনাটাই অস্বস্তিকর। কিছু একটা করতে পারলে এতটা খারাপ লাগত না। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। কিছুই করার নেই।
দেখার মত দৃশ্য। তিন হাজার ফুট উঁচু এক পানির স্তম্ভ। মাথাটা গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মেঘের মত, নিচটা শ আকৃতির। মাঝখানে সরু একটা স্তম্ভ যোগাযোগ রক্ষা করেছে দুটোর।
গতিবেগ দুশো মাইলের কম, না! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। কিন্তু বাতাসের প্রচণ্ড গর্জনে ঢাকা পড়ে গেল তার কথা।
ঘুরে ঘুরে ছুটে আসছে শুটা। একবার এদিকে সরে যাচ্ছে, একবার ওদিকে। কোনদিকে যাবে যেন মনস্থির করতে পারছে না।
রোদের মধ্যে উড়ছিল একটা গাংচিল। হঠাৎ হ্যাঁচকা টানে ওটাকে ভেতরে নিয়ে গেল পানির স্তম্ভ, চোখের পলকে কোথায় যে হারিয়ে গেল ওটা, বোঝাই গেল না।
সরে যেতে যেতেও হঠাৎ গতিপথ বদল করে কাছে চলে এল দানবটা। একটানে যেন ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেল ভেলার ছাউনি আর পাল। ডেকে উপুড় হয়ে পড়ে কাণ্ড আঁকড়ে ধরে রইল অভিযাত্রীরা।
মলিন হয়ে এল দিবালোক। চোখের সামনে শুধু পানি আর পানি। কানফাটা গর্জন। কানে আঙুল ঢোকাতে বাধ্য হল ওরা। বনবন করে ঘুরতে শুরু করেছে ভেলাটা।
হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে গেল দাদীমার বাঁধন। চোখের পলকে সাগরে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল কাছিমটা।
চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল অভিযাত্রীরা।
তারপর কোথা দিয়ে যে কি ঘটে গেল, বুঝতেই পারল না ওরা। হঠাৎ নিজেদেরকে আবিষ্কার করল পানির মাঝে। চারপাশে পানি, ওপরে পানি, নিচে পানি। মাথার ওপরে একটা হাঙরকে দেখতে পেল খাবি খাচ্ছে। তবে কি ডুবে গেছে ওরা?
হঠাৎ কাত হয়ে গেল ভেলাটা। মুহূর্ত পরে কিশোর দেখল, সে একা একটা কাণ্ড আঁকড়ে ধরে আছে, অন্যেরা নেই। ভেলাটাও নেই।
আরও কয়েক সেকেণ্ড পর দেখল, সাগরে ভাসছে সে। সরে যাচ্ছে দানবটা। কি ঘটেছিল বুঝতে পারল। ওদের ওপর সরাসরি এসে পড়েনি জলস্তম্ভ, পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। যাবার সময় টান দিয়ে তুলে নিয়েছিল ভেলাটাকে। হাঙরটাকে আসলে সাগরের তলায় নয়, পানির স্তম্ভের মাঝে দেখতে পেয়েছে সে। :
সাগরের পানি স্থির। দূরে সরে গেছে পানির স্তম্ভটা। একশো ফুট দূরে একটা বাদামী মাথা ভেসে উঠতে দেখা গেল। খানিক দূরে আরেকটা মাথা।
কুমালোও! রবিইন! চেঁচিয়ে ডাকল কিশোর। মুসা কোথায়?
তোমার পেছনে, জবাব দিল রবিন।
পেছনে ফিরে তাকাল কিশোর। চল্লিশ ফুট দূরে ভাসছে মুসা। আরেকটা কাণ্ড আঁকড়ে ধরে রেখেছে।
কাছাকাছি হল চারজনে। দুটো কাণ্ডকে একসঙ্গে করে হেঁড়া দড়ির টুকরো যে কটা পাওয়া গেল, সেগুলো দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধল।
তারপর, বাকি কাণ্ডগুলো পাওয়া যায় কিনা খোঁজাখুঁজি শুরু করল।
তিন গোয়েন্দার সঙ্গে কুমালোও যোগ দিল। ভেলাটা যে জায়গায় ধ্বংস হয়েছে, সে জায়গাটা আন্দাজ করে নিয়ে চারপাশে তল্লাশি চালাল ওরা। কিন্তু আর একটা কাণ্ডও পাওয়া গেল না। কে জানে, হয়ত টেনে ওগুলোকে মাথার ওপরে তুলে নিয়ে চলে গেছে জলস্তম্ভ। দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে ফেলবে। মোট কথা, ওগুলো পাওয়ার আর কোন আশা নেই। যে দুটো পাওয়া গেছে, ওগুলোতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
রোদ নেই আর এখন। মাথার ওপরে কালো মেঘ। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘন ঘন বাজ পড়তে শুরু করল। আকাশের দানব চলে গেছে, এবার আসবে বোধহয় ঝড়।
মেঘের মধ্যে যেন বোমা ফাটাতে শুরু করল বজ। নামল বৃষ্টি, মুষলধারে। তবে বেশিক্ষণ রইল না। জোরাল হল ওপরের বাতাস, উড়িয়ে নিয়ে গেল মেঘ।
বৃষ্টি থামলে আরও কিছুক্ষণ কাণ্ডগুলো খুঁজল অভিযাত্রীরা। পেল না। শেষে দুটো কাণ্ডের ওপর উঠেই কোনমতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। চারজনের ভার বাইতে পারল না দুটো কাণ্ড, ডুবতে শুরু করল।
নেমে গেল মুসা। কাণ্ড ধরে ঝুলে রইল পানিতে। অন্যেরাও নেমে পড়ল। তার মত একই ভাবে ধরে ভেসে রইল। ঢেউ ভাঙছে মাথার ওপর। শ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে। পানি ঢুকে যেতে চায় নাকের ভেতর।
আশা এখন নিরাশায় পরিণত হয়েছে। বাঁশের বোতল আর খাবারগুলো গেছে ! পাল নেই, দাঁড় নেই, ছাউনি নেই, এমনকি নারকেল কাপড়ের পোশাকগুলোও নেই যে রোদ থেকে গায়ের চামড়া আর চোখ বাঁচাবে। দুটো মাত্র কাণ্ড, চারজনের ভর রাখতে পারে না, উঠে বসারও উপায় নেই। অন্ত্র বলতে আছে শুধু একটা করে ছুরি।
বার বার মুখ নামিয়ে পানির তলায় দেখছে রবিন। হাঙরের ভয় করছে। যেকোন মুহূর্তে হাজির হয়ে যেতে পারে ওগুলো। মুখ তুলে পানির ওপরেও খুঁজছে হাঙরের পিঠের পাখা, দূর থেকে পানি কেটে আসছে কিনা দেখছে।
তোমাদের কেমন লাগছে, জানি না, বলল সে। আমার অবস্থা কাহিল।
আহত পায়ের যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করে হাসল কুমালো। বলল, এক কাজ কর। ভেলায় উঠে জিরিয়ে নাও খানিকক্ষণ। একজনের ভার সহজেই রাখতে পারবে এটা।
কুমালোর কথামত দুই কাণ্ডের ভেলায় উঠে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল রবিন। খুবই বেকায়দা অবস্থা, কিন্তু এটাকেই মনে হল এখন গদির বিছানা।