বাঁশের বোতলে পানি ভরা আছে। নিচ থেকে ছলকে ওঠা, সাগরের পানি সারাক্ষণ ভিজিয়ে রাখছে বাঁশগুলোকে, ফলে ভেতরের পানি বেশ ঠাণ্ডা থাকছে। খাবার দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তবে ভাবনা নেই, দাদীমা আছে। আর তেমন ঠেকায় পড়লে মাছও ধরতে পারবে।
ভেলার আশেপাশে খেলে বেড়ায় ডলফিনের দল। শরীরের রঙ উজ্জ্বল নীল কিংবা সবুজ, পাখনার রঙ হলুদ-রোদ লাগলে সোনালিই মনে হয়। ক্যামেলিয়ন। আর অক্টোপাসের মতই রঙ বদলাতে পারে ওরা। মাঝে মাঝেই হয়ে যায় চকচকে তামাটে। লাফালাফি করতে গিয়ে সেদিন ভেলায় এসে পড়ল একটা। আর নামতে পারল না। মৃত্যুর পর রঙ বদলে ধূসর-রূপালি হয়ে গেল, তার ওপর কালো কালো। দাগ।
তিন দিনের দিন আশাকে পরীক্ষা করতে এল মস্ত এক তিমি। সোজা এগিয়ে এল ভেলার দিকে, থেকে থেকেই ফোঁস ফোঁস করে পানির ফোয়ারা ছিটাল মাথার ওপরের ফুটো দিয়ে। ভয়ে প্রায় দম আটকে বসে রইল অভিযাত্রীরা। ইচ্ছে করলেই ভেলার বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে ষাটফুটি দানবটা।
লেজের মাত্র একটা ঝাপটা, বলল উদ্বিগ্ন ররিন। ব্যস, তারপরেই আশা একেবারে নিরাশা।
ভেলাটাকে ঘিরে দুবার চক্কর মারল তিমি। তারপর লেজটাকে খাড়া ওপরের দিকে তুলে দিল ডুব। লেজ ডুবে যাওয়ার সময় এত বেশি পানি ছিটাল, অভিযাত্রীদের মনে হল এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল তাদের ওপর।
প্রচণ্ড আলোড়ন উঠল পানিতে। ভীষণ কেঁপে উঠল ভেলা, দুলতে শুরু করল।
সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। গোড়ালির ওপরে পানি উঠে গেছে। এই গেলাম!
তবে নৌকার তুলনায় একটা বিশেষ সুবিধে রয়েছে ভেলার। তলা নেই, কাজেই পানি জমা হয় না, ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলে গেল, কিছু নেমে গেল ফাঁক দিয়ে।
ভেলার নিচ দিয়ে পেরিয়ে গিয়ে আবার ভউস করে আসল তিমি, আরেকবার নাকানি-চোবানি খাওয়াল ভেলাটাকে। কাঁধের ধাক্কায় আরেকটু হলেই ছিঁড়ে ফেলেছিল পাশের একটা কাণ্ডের বাঁধন।
আরও কিছুক্ষণ অভিযাত্রীদের আশঙ্কার মধ্যে রেখে অবশেষে ভু আর ভাসল না। দেখা দিল না আর একবারও।
তিমির কাঁধের ধাক্কায় ঢিল হয়ে গেছে কাণ্ডটার বাঁধন। তাড়াতাড়ি আবার সেটাকে শক্ত করল ওরা।
সেদিন সকাল থেকেই বাতাস পড়ে গেছে। ঝিরঝিরে বাতাসে পালের কোনা দুপাত ছপাত করে বাড়ি খাচ্ছে মাস্তুলের সঙ্গে। ঢেউ নেই। বাতাস না থাকায় দশগুণ বেশি হয়ে গেছে রোদের তেজ। সাগর যেন একটা মসৃণ চকচকে আয়না।
আনমনে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করল কুমালো, ব্যাপার সুবিধের মনে হচ্ছে। হঠাৎ এরকম বাতাস পড়ে যাওয়ার মানে বিপদ।
কিন্তু আকাশে মেঘ নেই। শুধু পুবদিকে বহুদূরে কালো একটা স্তম্ভের মত দেখা যাচ্ছে, পানিতে দাঁড়িয়ে আছে যেন আকাশে মাথা তুলে।
খানিক পরে উত্তরে দেখা দিল ওরকম আরেকটা।
জলস্তম্ভ, কুমালো বলল। প্রশান্ত মহাসাগরের এদিকটায় খুব বেশি দেখা যায় ওগুলো।
বিপজ্জনক? মুসা জানতে চাইল।
কখনও কখনও, জবাবটা দিল রবিন। ডাঙায় যেমন বালির ঘূর্ণি ওঠে, অনেকটা ওরকম। তবে পানিরগুলো অনেক বড়, উদ্বিগ্ন চোখে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে সে। এই ছোট ছোটগুলো আগাম সঙ্কেত, বুঝিয়ে দিচ্ছে বড়টাও আসবে। টর্নেডোর মতই। বলা যায়, সাগরের টর্নেডো।
ডাঙার টর্নেডো তো ঘরবাড়িই উড়িয়ে নিয়ে যায়, কিশোর বলল।
যায়, বলল কুমালো। সাগরেরগুলোও কম না। একটু পরেই দেখতে পাবে। উত্তর-পূর্ব দিকে তাকিয়ে আছে সে।
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অন্যরাও তাকাল।
তাদের চোখের সামনেই জমে উঠল কালো মেঘ, তিন হাজার ফুট উঁচুতে। এমন ভাবে দোমড়াচ্ছে মোড়াচ্ছে, যেন জীবন্ত এক দানব। ওটা থেকে স্কুলে রয়েছে লম্বা একটা লেজের মত।
পলিনেশিয়ানরা এর নাম দিয়েছে আকাশের দানব। এ-সম্পর্কে অনেক কুসংস্কার আছে ওদের।
কালো জমাট বাঁধা মেঘটার মাঝে ঝিলিক দিচ্ছে বিদ্যুৎ।
হ্যারিক্যানের মত খারাপ নয় নিশ্চয়, আশা করল মুসা।
আরও বেশি খারাপও হতে পারে, কুমালো বলল। তবে থাকে না বেশিক্ষণ। আর হারিনের মত এত জায়গা জুড়ে আসে না। হারিক্যান আসে পাচ-ছয়শো মাইল জুড়ে, আর এটা বড়জোড় দুতিন হাজার ফুট। তবে ছোট হলে হবে কি, ভয়ঙ্কর আঘাত হানতে পারে। আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলব এরচে হারিক্যান ভাল।
কিছু একটা করার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে কিশোর। সরে যেতে পারি না, আমরা? এখানে থেকে কি ওটার খাবলা খেয়ে মরব? বলেই ছপাত করে দাঁড় ফেলল পানিতে।
অযথা শক্তি খরচ কোরো না। কোন দিক দিয়ে যে যাবে কিছুই বলা যায় না। দাঁড় বেয়ে সরে বাঁচতে গিয়ে হয়ত আরও ভেতরেই পড়ব। চুপচাপ এখন বসে বসে শুধু আশা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
প্রতিমুহূর্তে লম্বা হচ্ছে দানবটার লেজ। এখন দেখে মনে হচ্ছে লম্বা ঔড় বাড়িয়ে দিয়ে সাগর ছোঁয়ার চেষ্টা করছে কোন অতিকায় অক্টোপাস।
আশ্চর্য রকম স্তব্ধ হয়ে আছে বাতাস। নড়ে না চড়ে না, একদম স্থির। অথচ কানে আসছে ছুটন্ত বাতাসের ভয়ঙ্কর গর্জন।
শুঁড়টা সাগর ছুঁয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আলোড়ন উঠল ওখানকার পানিতে। শাঁ শাঁ করে শূন্যে উঠে যেতে লাগল পানি, ফোয়ারার মত।
ঘূর্ণি জেগেছে পানিতে। বাতাসের পাকের টানে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে পানি, মনে হচ্ছে, পানির মোটা একটা স্তম্ভ রচনা করছে। প্রচণ্ড বাতাস বইছে ওখানে, অথচ ভেলার কাছে একরত্তি নেই। একটা নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলছে না, এখানে বাতাস।