সৈকতের ধারে চলে এল কাছিমটা। পানিতে নেমে মুসাকে সাহায্য করল রবিন আর কিশোর কুমালোও করল, যতটা পারল। আরেকটু হলেই তার ভাল পা-টায় কামড়ে দিয়েছিল কাছিম। দাঁত বসাতে পারলে এক কামড়ে অনেকখানি মাংস তুলে ফেলত।
রাখ, করছি ব্যবস্থা, ছুরি বের করল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাতে শুরু করল কাছিমটা। অনেক বয়েস হয়েছে। রবারের মত চামড়ায় ভাঁজ। মনে হচ্ছে যেন রেগে গিয়ে মাথা নাড়ছে একজন বুড়ো মানুষ।
মের না, দাদাকে মের না। বাধা দিল রবিন। জ্যান্ত রাখব ওটাকে। ভেলায় করে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব। তাজা মাংসের দরকার হলে তখন জবাই করতে পারব।
ঠিক, একমত হল কুমালো। একটা কাঠি দিয়ে বালিতে খোঁচা মারছে। তবে ওটা দাদা নয়, দাদী। এই যে দেখ, ডিম পেড়ে রেখে গেছে।
ফুটখানেক গভীর একটা গর্তে প্রায় একশো ডিম পেড়েছে কাছিমটা।
সবাই মিলে টেনেটুনে কাছিমটাকে ডাঙায় তুলল। তারপর ঠেলে চিত করে ফেলল। আর সোজাও হতে পারবে না, পালাতেও পারবে না।
হাসিমুখে ডিমগুলোর দিকে এগিয়ে গেল মুসা। একটা ডিম তুলে নিল। ড্রারে, অবাক কাণ্ড! ভেবেছিল, মুরগী কিংবা হাঁসের ডিমের খোসার মতই শক্ত হবে, তা নয়। নরম, রবারের বলের মত।
ভাঙব কিভাবে? কুমালোক জিজ্ঞেস করল সে।
দাঁত দিয়ে এক জায়গায় কেটে ফেল। কাটা জায়গা মুখে লাগিয়ে চাপ দাও, ভেতরের জিনিস মুখে ঢুকে যাবে। কাঁচা খাওয়া যায়। তবে সিদ্ধ করে নিলে বেশি মজা লাগবে। এগুলোও নিয়ে যেতে পারব ভেলায় করে।
দাদীমাকে তুলে এনে একটা নারকেল কাণ্ডের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়ে বাঁধল ছেলেরা।
ভোর হল। আলোচনা করে একমত হল অভিযাত্রীরা, যথেষ্ট খাবার জোগাড় করা গেছে। এবার রওনা হওয়া যায়।
তাঁবুর ওপর থেকে হাঙরের চামড়াটা নামিয়ে দুই টকুরো করল ওরা। একটা দিয়ে পাল হবে, আরেকটা দিয়ে কুঁড়ের চালা।
পাল তোলার কাছি হিসেবে ব্যবহার করা হল স্কুইডের চামড়া। বাঁশ পেয়েছে, কাজেই পাল বানাতে অসুবিধে হল না।
কেবিনটা অতি সাধারণ। তিনটে বাঁশের টুকরো কেড়ে ধনুকের মত বাঁকা করে আটকে দেয়া হল ভেলায়। ফাঁক ফাঁক করে বসানো হয়েছে ধনুক তিনটে। তার ওপর ছড়িয়ে দেয়া হল চামড়াটা। কোণাগুলো বেঁধে দেয়া হল চামড়ার দড়ি দিয়ে, যাতে বাতাসে উড়ে যেতে না পারে। নৌকার ছইয়ের মতই দেখতে হল জিনিসটা। পাঁচ ফুট চওড়া, তিন ফুট উঁচু। নিচু হওয়ায় সুবিধে, ঝড়ো বাতাসেও উড়িয়ে নেবে না সহজে। লম্বায় হয়েছে আট ফুট। চারজনের জায়গা হয়ে যাবে। আর যেহেতু সামনে পেছনে খোলা, গলুইয়ে চোখ রাখতেও অসুবিধে নেই।
ডিমগুলো সিদ্ধ করে নেয়া হল। তারপর দাদীমাকে ভেলায় তুলে মাস্তুলের সঙ্গে বাঁধা হল শক্ত করে, ছুটতে পারবে না।
যাবার জন্যে তৈরি সবাই। বিষণ্ণ চোখে পরিত্যক্ত ঘরটার দিকে তাকাল ওরা, পুরো দুটো হপ্তা কাটিয়েছে এখানে। ফেলে যেতে এখন মায়া লাগছে। ভেলায় চড়ে সাগরে পাড়ি দেয়ার অনিশ্চয়তায় কাঁপছে বুক।
ঢেউ আর বাতাসের করুণার ওপর নির্ভর করতে হবে ওদের। যাওয়ার চেষ্টা করবে দক্ষিণে। কিন্তু সহজেই পথ ভুল করতে পারে। ঘুরে যেতে পারে উত্তর, পুব কিংবা পশ্চিমে। বাতাসের চাপ কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে ওদের পলকা পাল কে জানে! আর দাঁড়ও তেমন মজবুত নয়। স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকবে?
চেঁচামেচি করে আর গান গেয়ে ভয় ভুলে থাকার চেষ্টা করল ওরা।
ভেলাটার একটা নাম রাখা দরকার, রবিন বলল। কি নাম, বলত?
কিশোর, তুমি বল, মুসা বলল।
আশা। কারণ এখন আশা ছাড়া আর কি করতে পারি আমরা।
ল্যাগুনে ভেলা ভাসাল চার নাবিক। চড়ে বসল তাতে। দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চলল চ্যানেলের দিকে।
বাহ, ভালই তো ভাসছে,মন্দব্য করল কুমালো।
নাকও সোজা রাখছে, বলল কিশোর। নারকেল গাছের সরল মসৃণ কাণ্ডকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাল সে। বেশ সোজা হয়েছে। কাত হয়ে যাবার প্রবণতা নেই।
নাহ, সত্যিই ভাল হয়েছে, দাঁড় বাইতে বাইতে বলল মুসা।
পাল নামিয়ে রাখা হয়েছে। চ্যানেল পেরোনর পর তারপর তোলা হবে। দাঁড় বেয়ে ভারি ভেলাটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যথেষ্ট পরিশ্রম হল চারজনের।
পনেরো মিনিট পর অবশেষে বের করে আনা হল ওটাকে। ভোলা সাগরে বেরোনর আনন্দেই যেন ঢেউয়ের বুকে দুলে দুলে নাচতে আরম্ভ করল আশা।
৮
যাত্রার প্রথম দুদিন এত নির্বিঘ্নে কাটল, যাত্রা শুরুর আশঙ্কার আর বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট রইল না অভিযাত্রীদের মাঝে।
বাতাসের গতি অপরিবর্তিত রইল, উত্তর-পুব দিক থেকে বইছে, ওরা চলেছে সোজা দক্ষিণে। এই গতি অব্যাহত রাখতে পারলে দিন কয়েকই পোনাপেতে পৌঁছে যাবে ওরা। আর কোন কারণে যদি দ্বীপটার কাছ থেকে সরে আসে, তাহলেও ভাবনা নেই, সীমার রুটে গিয়ে পড়বে। মারশাল আইল্যাণ্ড থেকে কুসাই, ট্রাক, পোনাপে আর ইয়্যাপেতে জাহাজ চলাচল করে। কোন না কোন জাহাজের দেখা পাবেই। কারণ ওই পথ ধরে অনেক মাছধরা জাহাজও চলাচল করে।
দিনের বেলা সূর্য ওদের কম্পাস, রাতে তারা। দাঁড় দিয়ে হলের কৃাজ চালায়। পালা করে ডিউটি দেয়। ক্রোনোমিটার নেই, সময়ও নির্ধারণ করে সূর্য আর তারা দেখে।
প্রতিটি কাণ্ডের ফাঁক দিয়েই ছলকে ওঠে পানি, ফলে সারাক্ষণই কিছুটা ভেজা থাকতে হচ্ছে ওদেরকে। তবে গরমের মধ্যে ওই ভিজে থাকাটা বরং আরামদায়ক। দিনের বেলা কড়া রোদ। অসুবিধে হয় না ওদের। সহ্য না হলে ঢুকে বসে থাকে ছইয়ের ভেতর।