সাংঘাতিক শক্ত তলোয়ার মাছের তলোয়ার। একবার একটা মাছ তলোয়ার দিয়ে পালাউ ল্যাণ্ডনে একটা মোটর বোটের তলা ফুড়ে দিয়েছিল। শুধু তাই না, বোটের তলা ফুটো করে ধাতব পেট্রল ট্যাঙ্কে ঢুকে গিয়েছিল ওটার চোখা তলোয়ারের মাথা।
ছয় ফুট লম্বা তিনটে বাঁশের বোতল তৈরি হয়ে গেল। পানি বয়ে নেয়ার আর ভাবনা নেই। বোতলগুলোতে পানি ভরে নিয়ে কাণ্ড-কাটা ছিপি দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হল ওগুলোর মুখ।
যাক, পানির অভাবে আর মরছি না, বলল কিশোর।
ঢেউয়ে ভেসে এসে যে শুধু পাকা বাশ ঠেকেছে তাই না, চারাও জল বাঁশের। আগে থেকেই ছিল ওগুলো দ্বীপে। ঝড়ে উপড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ঝাড়টা। কিছু শেকড়-বাকড় রয়ে গিয়েছিল, হয়ত ওগুলো থেকেই চারা গজিয়েছে। দিনে প্রায় এক ফুট করে বাড়ছে ওগুলো। বাঁশের কেঁাড় খুব ভাল তরকারি। নরম থাকতে থাকতেই ওগুলো কেটে নেয়া হল। ভেলায় করে পাড়ি জমানর সময় খাওয়া যাবে।
বাহ, এখন আমাদের সুদিন, হাসতে হাসতে বলল মুসা। যখন নামলাম, ছিল মরুভূমি। এখন দেখি সব রকমের খাবার জোগাতে আরম্ভ করেছে দ্বীপটা।
রান্নার পাত্রও জোগাল ওদেরকে বাঁশ। ভেতরে পানি ভরে ফুটানো যায়। বাঁশটা পোড়ে না। শুধু তাই না, বাঁশের ভেতর ভরে খাবারও নেয়া যাবে।
তলোয়ার মাছের মাংস ফালি করে কেটে রোদে শুকাল ওরা। নোনাও করা যায়, কিন্তু পদ্ধতিটা জানে না ছেলেরা। কুমালো বলে দিল। সাগরের নোনা পানি এনে রেখে দিতে হবে পাথরের গর্তে। রোদে বাম্প হয়ে উড়ে যাবে পানি। নিচে জমে থাকবে লবণের হালকা আন্তর। লবণও পাওয়া গেল, নোনাও করা গেল মাছের মাংস।
মুক্তার জন্যে ঝিনুক তুলেছে ওরা। কুমালোর দেখাদেখি ঝিনুকের মাংস খেতে আরম্ভ করেছে। স্বাদ না থাকুক, প্রােটিন তো পাওয়া যায়, জীবন বাঁচে। কিন্তু বড় বেশি পচনশীল। একটু রোদেই পচতে শুরু করে। অনেক কায়দা-টায়দা করে শুকিয়ে নিল কিছু ঝিনুকের মাংস। বাঁশে ভরে রাখল। সাগর পাড়ির সময় নেহায়েত ঠেকায় না পড়লে খাবে না।
সাগরের শ্যাওলা তুলেও শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হল খাবার হিসেবে।
এই জিনিস কে খায়? নাক কুঁচকাল রবিন। একেবারে শুকনো খড়।
কুমালো জানাল, স্বাদ যা-ই হোক, ভিটামিন আছে। প্রাচ্যের লোকেরা নাকি বেশ পছন্দ করে।
ফিরে আসতে শুরু করেছে পাখিরা। ইতিমধ্যেই চলে এসেছে কিছু। তার মধ্যে রয়েছে ভাড় নামে পরিচিত মেগাপড় পাখি। ওড়ার গতি খুবই সুখ, পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতেও পারে না ভালমত। মানুষকেও ভয় করতে শেখেনি। দুটো পাথর নিয়ে ঠুকতে শুরু করল কুমালো। আজব কোন কারণে ওই শব্দ শুনে লাফাতে লাফাতে দৌড়ে এল পাখিটা।
সহজেই ওটাকে ধরে ফেলল সে। পালক ছাড়িয়ে, কেটে, আগুনে ঝলসে
ওটাকে রেখে দেয়া হল ভেলায় খাবার জন্যে।
আঁচড়ানর শব্দে একরাতে ঘুম ভেঙে গেল মুসার। কী, দেখার জন্যে হামাগুড়ি দিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল সে। বিরাট একটা গোল পাথর বুকে হেঁটে চলেছে। পানির দিকে। চমকে উঠল সে। প্রথমেই মনে হল, ভূত! চেঁচিয়ে উঠতে যাবে, এই সময় চিনে ফেলল, কচ্ছপ। সাগরের কাছিম। বিশাল। দুশো পাউণ্ড খুব ভাল মাংসের ভাঁড়ার। নিশ্চয় ডিম পাড়ার জন্যে তীরে উঠেছিল, আঁচড়ের শব্দের ব্যাখ্যা এটাই।
এতগুলো মাংস ল্যানে হারিয়ে যেতে দেয়া যায় না। দৌড় দিল মুসা। আঁপিয়ে এসে পড়ল কাছিমের পিঠে। পাত্তাই দিল না জীবটা। আগের মতই গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে। পাথরের খাঁজে পা ঢুকিয়ে দিয়ে ওটাকে আটকানর চেষ্টা করল সে। টেনে সহজেই তার পা ছাড়িয়ে নিল ওটা।
লাফিয়ে পিঠ থেকে নেমে পড়ল মুসা। উল্টে ফেলার চেষ্টা করল ওটাকে। বেজায় ভারি। একার সাধ্যে কুলাল না। সাহায্যের জন্যে চিৎকার শুরু করল।
কিশোর আর রবিন বেরিয়ে এসে সাহায্য করার আগেই ল্যাগুনের পানিতে নেমে পড়ল কাছিমটা।
কিন্তু এত সহজে ছাড়ার পাত্র নয় মুসা। কাছিমের পিঠে চড়ে বসল। টেলিভিশনে দেখেছে, কিভাবে পলিনেশিয়ান ছেলেরা কাছিমের পিঠে চড়ে পানিতে ঘুরে বেড়ায়।
গলাটা যেন রাবারের তৈরি। তার ঠিক নিচে শক্ত খোলার কিনার আঁকড়ে ধরল সে। চিত হয়ে গিয়ে শরীরের ভার দিয়ে উল্টে ফেলার চেষ্টা করল ওটাকে।
ওল্টাল না কাছিমটা, তবে ডুবও দিতে পারল না। সাঁতরে চলল ওপর দিয়ে।
সোজা এগিয়ে চলেছে সরু চ্যানেলের দিকে, যেখান দিয়ে সাগরে বেরোনো যায়। দ্রুত ভাবনা চলেছে মুসার মাথায়। সাগরে বেরিয়ে গেলে আর কিছু করতে পারবে না। যা করার এখনই করতে হবে। কি করবে? পেছনের একটা পা চেপে ধরবে? তাহলে হয়ত সাঁতরাতে অসুবিধে হবে কাছিমের।
পাশে কাত হয়ে হাত বাড়িয়ে পেছনের ডান পা-টা চেপে ধরল সে। ধরে রাখল শক্ত করে যাতে নাড়তে না পারে কাছিমটা।
অন্য তিনটা পা ব্যবহার করছে ওটা। ফলে সামনের দিকে না এগিয়ে এক জায়গায় ঘুরতে শুরু করল কাছিম। মুখটা সৈকতের দিকে ফিরতেই পা ছেড়ে দিল মুসা। সঙ্গে সঙ্গে ওই পা ব্যবহার শুরু করল জীবটা। এগিয়ে চলেছে এখন সৈকতের দিকে।
রবিন আর কিশোরকে দেখতে পাচ্ছে মুসা, কুমালোকেও। হৈ চৈ শুনে। বেরিয়েছে।
দাঁড়াও, মাংস নিয়ে আসছি, চেঁচিয়ে বলল গোয়েন্দা সহকারী।
কিন্তু সাগরের কাছিমও, সহজে পরাস্ত হতে চাইল না। মুসাকে পিঠ থেকে ফেলে দেয়ার সব রকম চেষ্টা চালাল। একবার এদিকে ঘুরে যাচ্ছে, আরেকবার ওদিকে। বার বার পেছনের পা চেপে ধরে ওটাকে সঠিক দিকে এগোতে বাধ্য করছে মুসা। এরকম করতে গিয়ে একসময় হাত ছুটে গেল গলার কাছ থেকে। ব্যস, চোখের পলকে ডুব দিল কাছিম। এক ডুবে নেমে এল ছয়-সাত ফুট। গলা চেপে ধরে টেনে আবার ওটাকে ওপরে উঠতে বাধ্য করল মুসা।