দিনটা শেষ হওয়ার আগেই সেদিন আরও দুটো মুক্তা যোগ হল প্রথমটার সঙ্গে। দ্বিতীয়টা কিছু ছোট, তৃতীয়টা আরও বড়।
তোমাদের আসা সার্থক হল, বলল কুমালো। মুক্তা পেলে। নিশ্চিন্ত হলে এতদিনে।
নিশ্চিন্ত? মুখ বাঁকাল কিশোর। দুশ্চিন্তার কারখানা তৈরি করলাম বরং। এগুলো প্রফেসরের হাতে তুলে দেয়ার আগে আর স্বস্তি নেই আমার কপালে।
সে-রাতে কিশোর দেখল দুঃস্বপ্ন। দেখল, ওদের ভেলা উল্টে গেছে। গভীর পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে সে। তার প্যান্টটা কামড়ে ছিঁড়ে খুলে নিয়ে যাচ্ছে একটা হাঙর। হাঙরের মুখটা ডেংগুর মত। মুখে শয়তানী হাসি। হাঙরের আবার হাতও আছে, সেই হাতে তিনটে মুক্তা।
জেগে গেল সে। ঘামে ভিজে গেছে শরীর। চট করে হাত চলে গেল প্যান্টের পকেটে। না, হারায়নি, আছে মুক্তাগুলো।
৭
ভেলা তৈরি শুরু হল। ল্যাগুনের দিকে ঢালু হয়ে আছে জায়গাটা। ইচ্ছে করেই এই স্থান নির্বাচন করেছে ওরা। চারজনকে বয়ে নেয়ার উপযোগী ভেলা বেশ ভারি হবে, বয়ে নিয়ে গিয়ে পানিতে নামাতে পারবে না। জায়গা ঢালু হলে ঠেলে নামাতে সুবিধে হবে।
তারপরেও বাড়িতে সতর্কতা গ্রহণ করল কিশোর। কয়েকটা কাণ্ডকে পানির সঙ্গে আড়াআড়ি করে রাখল ডাঙায়। এগুলোর ওপর ভেলাটা তৈরি করে গড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলবে পানিতে। খুঁটি গেড়ে আটকে দিল রোলারগুলোকে, যাতে আপনাআপনি গড়িয়ে যেতে না পারে।
পনেরো থেকে বিশ ফুট লম্বা সাতটা কাও এনে রাখা হল রোলারের ওপর। লম্বাগুলো রাখা হল মাঝখানে, বেড়ে থাকা অংশটা গলুইয়ের কাজ করবে। পাশেরগুলোর মধ্যে যে কটা মাপে বড় হয়ে গেল, ছোট করে কেটে সমান করে ফেলা হল। খুব কাজ দিল কুড়ালটা, ওটা ছাড়া কাটতে পারত না।
চামড়ার ফিতে দিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা বাঁধা হল কাণ্ডগুলো।
বাঁধা শেষ করে সব দিক থেকে খুঁটিয়ে দেখল কতটা কি হয়েছে।
জাহাজের মতই আকার, বলল কিশোল রোদ থেকে বাঁচার জন্যে একটা কেবিন লাগবে। পালও দরকার।
হেসে উঠল মুসা। কি দিয়ে বানাবে? প্রবাল পাথর?
হেস না হেস না, মাথা নাড়ল রবিন। হাঙরের চামড়া দিয়েই ঘরের চাল হয়ে যাবে। পালও। হতাশ হয়ে পড়ল পরক্ষণে। কিন্তু পাল তুলতে হলে মাস্তুল চাই। কি দিয়ে বানাব? নারকেলের কাণ্ড বেশি ভারি। দাঁড় করানো যাবে না।
যাবে, কিশোর বলল। পরিশ্রম করতে হবে আরকি।
স্কুইডের ঠোঁটের কুড়াল আর ধারাল প্রবালের সাহায্যে কাণ্ড ফাড়তে লেগে গেল ওরা। অনেক ঘাম ঝরানর পর কাণ্ড কেটে বের করল আঠারো ফুট লম্বা একটা দণ্ড। ছুরি দিয়ে টেছে মসৃণ করতে লাগল।
তার পরেও খসখসে রয়েই গেল, সোজা হয়নি ঠিকমত। কিন্তু এটা পেয়েই খুশিতে নাচতে বাকি রাখল ছেলেরা।
ভেলার গলুইয়ের কাছে গর্ত করে ফেলল একটা। তাতে বসিয়ে দিল মাল।
কেবিন আর পাল বানানো যাবে পরেও। এখনই দ্বীপ ছাড়তে তৈরি নয় ওরা, কাজেই ঘরটার প্রয়োজন আছে।
ভেলা বানাতে লেগেছে তিন দিন। রসদ জোগাড় করতে আরও সময় লাগল।
প্রথমেই জরুরি হল পানি। ডুবোঝনাটা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, স্রোতের জোর নেই বললেই চলে। ঝিরঝির করে বেরোয় এখন। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এখন ওগুলো তুলে জমিয়ে ফেলা উচিত। দিনের মধ্যে অসংখ্য বার পালা করে ডুব দিল তিনজনে। প্রতিবারেই তুলে আনল একমালা করে পানি। আগের মত মিষ্টি নেই আঁর, নোনা পানি মিশে যাচ্ছে, যদিও খুব সামান্য।
কুমানোর সঙ্গে পরামর্শ করল কিশোর। পানি বয়ে নিই কি করে? এখন তো পাথরের গর্তে জমিয়েছি। গর্তটা তো আর তুলে নেয়া যাবে না। আর মালাও মোটে একটা। একমালা পানিতে কিছুই হবে না।
ভুরু কোঁচকাল কুমালো। হা, সমস্যাই। আমাদের জেলেরা ছাগলের চামড়া দিয়ে ব্যাগ বানিয়ে নেয়। একটা ডলফিন-টলফিন পেলেও চলত।
দেখা যাক ফাঁদে পড়ে কিনা। কিন্তু আপাতত সমস্যার সমাধান করি কিভাবে? পাথরের গর্তে পানি বেশিক্ষণ থাকবে না, রোদে উড়ে যাবে। ঢাকনা দিয়ে রাখলে থাকবে?।
থাকবে। নারকেলের লাকড়ি গর্তের ওপরে সাজিয়ে তার ওপর পাথর চাপা দিয়ে রাখগে। বলে ছুরি নিয়ে কাজ করতে লাগল কুমালো। ছেলেরা কাজ করেছে একদিন, সে-ও বসে থাকেনি। দুটো ক্রাচ বানিয়ে ফেলেছে। এখন বানাচ্ছে ভেলার জন্যে দাঁড়। বলল, নারকেল দিয়ে কত কিছুই করলাম। ঘর বানালাম, কাপড় বানালাম, ভেলা বানালাম…পানি রাখার পাত্রও বানানো যায়। তবে খুব কঠিন হবে। একটা টুকরো কেটে খোড়ল করে নিতে হবে…
পারব! তুড়ি বাজিয়ে চেঁচিয়ে বলল কিশোর। খোড়ল হুয়ে আছে ওরকম কিছু একটা বেছে নিলেই তো পারি আমরা।
অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল কুমালো।
অন্য দ্বীপটায়, বলল কিশোর। কাল কয়েকটা বাঁশের টুকরো দেখে এলাম। নিশ্চয় ঝড়ে উপড়ে গিয়েছিল, অন্য দ্বীপ থেকে ঢেউয়ে ভেসে এসে ঠেকেছে…
তাহলে তো আর কোন ভাবনাই নেই।
কতটা লম্বা?
আট-দশ ফুট।
ছয় ফুট করে কেটে নাওগে।
কাটতে অসুবিধে হল না। তবে আরেকটা সমস্যা দেখা দিল। ফুটখানেক পর পরই বাশে একটা করে গাঁট, ওগুলো বন্ধ। ছিদ্র না করতে পারলে লাভ হবে না। করবে কি দিয়ে?
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল একটা তলোয়ার মাছ। নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে দিল চারজন মানুষকে। ফাদে ধরা পড়ল ওটা। চমৎকার মাংস, কয়েক দিনের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেল। ওটার তলোয়ার তিন ফুট লম্বা। একটা বাঁশের লাঠির মাথায় তলোয়ারটা বেঁধে লম্বা করে নিয়ে বর্শা বানিয়ে ফেলল মুসা। বাঁশের গাঁট ছিদ্র করার কাজে লাগল সেটা।