গর্জে উঠে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল ভিশন। মনে পড়ল, মিশনারির ওরকম রাগ করা উচিত না, মুখ খারাপ তো দূরের কথা। মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখে হাসার চেষ্টা করল।
আপনি এখানে কি করছেন? মুসা জানতে চাইল।
প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না ভিশন। বেরিয়ে এল স্তুপের ওপাশ থেকে। কিশোর, রবিন আর কুমালোও এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের দিকে চেয়ে হাসল। কান। থেকে গড়িয়ে পড়ছে ঝিনুকের রস।
তোমাদের জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম, বলল সে। তাই আর থাকতে না পেরে দেখতে এসেছি কি করছ।
আপনি আমাদের ওপর স্পাইগিরি করছিলেন! গরম হয়ে বলল মুসা।
শান্ত দৃষ্টিতে মুসার দিকে তাকাল ভিশন। মাই বয়, তোমার মনে রাখা উচিত, দ্র আচরণ ঈশ্বর পছন্দ করেন।
পাক-পবিত্র থাকাও ঈশ্বর পছন্দ করেন, মুসা বলল। যান, মুখ ধুয়ে পাকসাফ হোন।
কিশোরের দিকে চেয়ে অভিযোগের সুরে বলল ভিশন, দেখ, তোমার বন্ধু দুর্ব্যবহার করছে। তোমার কিছু বলা উচিত।
নিশ্চয় বলব, তবে আপনাকে। ও ভূল বলেনি, আপনি সত্যি স্পাইগিরি করছিলেন আমাদের ওপর। আড়ালে থেকে চোখ রাখছিলেন।
ভুল করছ, মাই সান, ভুল করছ। আর তোমাদেরই বা দোষ দিই কিভাবে? রক্ত গরম, মাথা গরম করার বয়েস তো এটাই। যাকগে, আমি কিছু মনে করিনি তোমাদের কথায়। মিশনারি যখন হয়েছি, মাপ করতেই হবে মানুষকে, বলতে বলতে কিশোরের কাঁধে হাত রাখল ভিশন।
ঝাড়া দিয়ে হাতটা কাঁধ থেকে ফেলে দিল কিশোর। হয়েছে, ওসব ভণিতা রাখুন। আপনি মিশনারি নন। বেঈমান, দুমুখো সাপ।
বুঝতে পারছি, রেগেছ,ধৈর্য হারাল না মিশনারি। কিন্তু কেন এই ক্ষোভ জানতে পারি? সব খুলে বল আমাকে, বুঝে দেখি ভুল বোঝাবুঝিটা কোত্থেকে হল?
ক্ষণিকের জন্যে দ্বিধায় পড়ে গেল কিশোর। ভুল করেনি তো? লোকটা কি সত্যিই মিশনারি? ধৈর্য তো সে-রকমই, শান্তও রয়েছে। রেগে না গিয়ে বরং বোঝানর চেষ্টা করছে।
ফাঁদে ফেলার জন্যে হঠাৎ বলল কিশোর, প্রফেসর ইস্টউডের নাম নিশ্চয় শুনেছেন?
সামান্যতম চমকাল না ভিশন। মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছে যেন। ইস্টউড… মাথা নাড়ল। না, মনে পড়ছে না। বোধহয় শুনিনি।
অ, তাহলে তো তাঁর ল্যাবরেটরিতে বাগও আপনি লুকাননি। তার সঙ্গে আমাদের কি কি কথা হয়েছে শোনেননি। জানেন না আমাদের এই দ্বীপে আসার কারণ। কালো সেডানে করে আমাদের পিছু নেননি। স্যালভিজ ইয়ার্ডটাও চেনেন।
না, তাই না?
কি বলছ কিছুই বুঝতে পারছি না, গলার জোর কিছুটা হারিয়েছে ভিশন। ঝিনুকের একটুকরো মাংস খসে পড়ল লম্বা নাক থেকে।
বুঝিয়ে দিচ্ছি। জামবুকে আপনিই শুকতারায় তুলে দিয়েছিলেন পার্ল ল্যাগুনের অবস্থান জানার জন্যে। আপনার নির্দেশেই আমার কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছে সে। মিশনারির ছদ্মবেশে আমাদের ভুলিয়ে বোটে উঠেছেন জামবু যে কাজ করতে পারেনি, সেটা করার জন্যে। লগবুক থেকে রিডিং নকল করেছেন। পথে এত দ্বীপ পড়ল কোনটাতেই নামেননি, পছন্দ হয়নি আপনার। হবে কি ভাবে? নামার উদ্দেশ্যে তো আসেননি। মানুষের ভালবাসা না ছাই, আসলে এসেছেন মুক্তোর খোঁজে।
ধপ করে একটা নারকেলের গুড়ির ওপর বসে পড়ল মিশনারি। হতাশ ভঙ্গিতে দুহাত ছড়াল। সামনে ঝুঁকল চওড়া কাঁধ। রাগে কালো হয়ে গেছে মুখ। তবে সামলে নিল।
বেশ, বলল সে। বুঝতে পারছি, খেলা খতম। অতিরিক্ত চালাক তুমি। ফাঁকি দিয়ে আর লাভ হবে না, গিলবে না তুমি।
ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল কিশোর।
হ্যাঁ, আবার বলল ভিশন। তোমাকে ফাঁকি দেয়া যাবে না। বড় বেশি চালাক। তোমার বিরুদ্ধে না গিয়ে পক্ষেই থাকতে চাই।
সেটা সম্ভব নয়।
কেন নয়? স্বীকার করছি, আমি মিশনারি নই। ছদ্মবেশ নিয়েছি, অভিনয় করেছি। তার মানে এই নয় যে তোমাদের ক্ষতি করতে চেয়েছি।
কি চেয়েছেন তাহলে? মুক্তো চুরি করতে?
চুরি বলছ কেন? শব্দটা পছন্দ হল না ভিশনের। এই মুক্তোর খেত কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এই দ্বীপটার মালিকও প্রফেসর নয়। এমনকি আমেরিকান সরকারও এটার মালিকানা দাবি করতে পারবে না। এটা কারও জায়গা নয়, তারমানে সবার। আমি সেই সবার একজন। তোমরাও। এই ল্যাগুন, যা যা আছে এখানে, সব কিছুর মালিক সবাই। আমাদের সবারই অধিকার রয়েছে এতে।
তারমানে আপনি বলতে চাইছেন, এত খাটাখাটনি করে, টাকা খরচ করে, প্রফেসর যে মুক্তোর খামার করেছেন…
প্রফেসরটা একটা গাধা। মানুষকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করে। নিজের ভাল বোঝার অধিকার রয়েছে মানুষের এটা যেন জানেই না। আমি তার মত বোকা নই। কাজেই নিজের ভালমন্দ অবশ্যই বুঝব। তোমাদের কাছে আর লুকিয়ে লাভ নেই, আমার নাম ভিশন নয়, ডেংগু পারভি। আমি মুক্তা ব্যবসায়ী। দক্ষিণ সাগরে খুচরা মুক্তা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যাই নিউ ইয়র্ক, লণ্ডন, প্যারিসে। বিক্রি করি। মুক্তা চিনি আমি। আমার সাহায্য নিলে লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না তোমাদের। আমি যে দামে বিক্রি করতে পারব, তার চার ভাগের এক ভাগ দামেও তোমরা পারবে না। একটা রফায় আসতে পারি আমরা, ফিফটি-ফিফটি শেয়ার। কি, রাজি?
আপনার কথা শেষ হয়েছে? তাহলে যেতে পারেন।
হাসি ফুটল ডেংগুর ঠোঁটে। কাঁধের হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করল। আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছ তোমরা, ভারি গলায় বলল সে। আরও একটা কথা জেনে রাখতে পার, মুক্তো অনেক দামি জিনিস। এরচে অনেক কম দামি জিনিসের জন্যে মানুষ খুন করেছি আমি।