জলদি কর, রবিন, ওই লাকড়িটা দাও আমার হাতে! চিৎকার করে বলল কুমালো।
ছুটে গিয়ে নারকেল কাণ্ডের একটা ফাড়া লাকড়ি এনে কুমালোর হাতে দিল রবিন।
ধর আমাকে নিয়ে যাও ওটার কাছে!
কুমালোকে স্কুইডটার কাছে আসতে সাহায্য করল রবিন। পায়ের ব্যথার পরোয়াই করল না পলিনেশিয়ান। ধা করে বাড়ি মারল স্কুইডের মাথায়, মগজ ভর্তা করে দেয়ার জন্যে।
যন্ত্রণায় ভীষণ ভাবে কেঁপে উঠল স্কুইডের শরীর। লাফ দিয়ে উড়টা উঠে গেল ওপরে, ঢিল হয়ে গেল বাঁধন। ধপ করে মাটিতে খসে পড়ল কিশোর। ঝাড়া লেগে চিত হয়ে পড়েছে মুসা, আগেই।
মাটিতে আছড়াতে শুরু করল গুঁড়গুলো, মুমূর্ষ সাপের মত মোচড় খাচ্ছে। ধীরে ধীরে কমে এল নড়াচড়া, নিথর হয়ে গেল।
কিশোরকে তুলে বসাল রবিন আর মুসা। তার জখম পরীক্ষা করল। রক্তাক্ত শরীর। অনেক জায়গায় কেটেছে, রক্ত ঝরছে ওগুলো থেকে।
ঠিকই, আছি আমি, বলল কিশোর। হাত-পা ভাঙেনি। কাটাও তেমন বেশি নয়, শুধু আঁচড় লেগেছে। কুমালোকে তোল। ওর অবস্থা কাহিল।
কুমালোর দুই বগলের তলায় ক্রাচ হয়ে তাকে ধরে ধরে তাঁবুতে নিয়ে এল মুসা আর রবিন। একেবারে নেতিয়ে পড়ল বেচারা। সারাদিন পায়ের অসহ্য যন্ত্রণায় কষ্ট পেল।
কুমালোকে ঘরে রেখে মরা দানবটার কাছে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা। পাথরটা আটকে রয়েছে স্কুইডের ঠোঁটে। যে ঔড়টা তাকে ধরেছিল সেটার দিকে চেয়ে শিউরে উঠল কিশোর। আতঙ্ক উত্তেজনায় দুর্বল হয়ে পড়েছে শরীর, মাথা ঘুরছে, ঘোলা দেখছে চোখে।
এরকম একটা প্রাণীকে মেরে ফেললাম, আফসোস করে বলল কিশোর। জ্যান্ত নিতে পারলে কাজ হত।
না মারলে তুমি বাঁচতে না এতক্ষণ, মুসা বলল। তাছাড়া ভেলা বানাতে দড়ি দরকার। ভেলা না হলে বেঁচে ফিরতে পারব না আমরা এখান থেকে।
তা ঠিক। বসে থাকলে চলবে না। জোয়ার আসার আগে কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। নইলে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এটাকে।
চামড়া খুবই শক্ত। কয়েক ঘন্টা কঠোর পরিশ্রম করে বঁড়গুলো আলাদা করল ওরা। টেনে নিয়ে গিয়ে পাথরের ওপর বিছিয়ে দিল রোদে শুকানর জন্যে।
কাল কাটব, কিশোর বলল। জোয়ার এসেছে। ভেসে ওঠা লাশটাকে টানতে শুরু করেছে পানি।
নিয়ে যাক, নাকি? জিজ্ঞেস করল মুসা। না স্কুইডের মাংসও খাওয়া যায়? কেটে রাখব খানিকটা?
আমার মনে হয় না সুবিধে হবে, রবিন বলল। পুবদেশীর অবশ্য বাচ্চা স্কুইডের মাংস খুবই পছন্দ করে। তবে এই বুড়ো দাদাকে ওরাও গিলতে পারবে কিনা সন্দেহ। চিবানই যাবে না রবারের মত মাংস।
ভেসে যাওয়ার আগে আরেকটা জিনিস রাখতে হবে আমাদের, বলল কিশোর। কাজে লাগবে।
একটা পাথর তুলে নিয়ে গিয়ে স্কুইডের ঠোঁটে বাড়ি মারতে শুরু করল সে। পিটিয়ে ভেঙে ফেলল একটা অংশ। শক্ত এই জিনিসটা দেখতে অনেকটা কুড়ালের মত, কুড়ালের ফলার মতই ধার। নারকেল কাণ্ডের একটা খাটো লাকড়ি নিয়ে হাতল বানাল কিশোর। শুঁড় থেকে সরু চামড়ার একটা ফালি কেটে হাতলের সঙ্গে বাঁধল ভাঙা ঠোঁটটা।
দেখতে হয়ত তেমন সুন্দর না, হাত ঘুরিয়ে বাতাসে কোপ মারল সে। তবে চমৎকার একটা কুড়াল পেয়ে গেলাম। ভেলা বানাতে খুব কাজ দেবে।
৬
পরদিন জায়ান্ট স্কুইডের শুঁড় কেটে লম্বা লম্বা ফালি করল ওরা। চেঁছে ফেলে দিল চামড়ার ভেতরের মাংস। কড়া রোদে খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে গেল চামড়া।
ট্যান করার দরকার আছে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
কয়েক বছর যদি রাখতে চাইতাম, তাহলে করতাম, জবাব দিল কিশার। আমাদের এত বেশি দিন রাখার দরকার নেই। কয়েক হপ্তায় নষ্ট না হলেই হল।
অদ্ভুত, না? সুইডের চামড়া দিয়ে দড়ি…হাহ, হাই।
অদ্ভুত হবে কেন? ভুরু নাচাল রবিন। অন্য জীবের মত এটাও তো জীব। কিসের চামড়া ব্যবহার করে না লোকে? ক্যাঙারু, ওয়ালাবি, মোষ, উটপাখি, হরিণ, গুইসাপ, অ্যালিগেটর, হাঙর, সীল, ওয়ালরাস, কোনটা বাদ দেয়? বিশ্বাস করবে, জংলী নরখাদকরা আজও মানুষের চামড়া দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বানায়?.
বিশ ফুট লম্বা চারটে ফালি জোড়া দিয়ে বড় একটা দড়ি হল, উপসাগরের তলায় পৌঁছেও আরও থাকে। দড়ির এক মাথায় নারকেল কাপড়ের থলে বেঁধে ডুব দেয়ার জন্যে প্রস্তুত হল ওরা।
আমিই আগে যাই, মুসা বলল।
একহাতে পাথর আঁকড়ে আরেক হাতে ব্যাগ নিয়ে পানিতে নামল সে। ওপর থেকে কিশোর আর রবিন দেখল কঁপা কাঁপা একটা ছায়া নেমে যাচ্ছে, নামার সময় পানিতে ঢেউ উঠেছে, সে জন্যেই ওরকম দেখা যাচ্ছে মুসাকে।
পা নিচের দিকে রাখতে কষ্ট হচ্ছে মুসার। ঠেলে উল্টে ফেলতে চাইছে পানি। শেষে দুপা দিয়ে পাথরটা চেপে ধরল। এবার আর মাথা ওপরের দিকে রাখতে অসুবিধে হল না।
ভয়ঙ্কর চাপ পড়ছে দেহের ওপর। জড়িয়ে ধরে চেপে চ্যাপ্টা করে দিতে চাইছে যেন বিশাল কোন দৈত্য। এই চাপের মধ্যে ফুসফুসের বাতাস আটকে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে।
নিচে নেমে খামচি দিয়ে দিয়ে ঝিনুক তুলে ব্যাগে ভরতে লাগল। ঝিনুকের খোলা খসখসে, কাঁটা কাঁটাও রয়েছে কোন কোনটাতে। কুমালোর দস্তানা দুটো পরে আসা উচিত ছিল, ভাবল সে। খোঁচা লেগে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে আঙুল। যদি কাছাকাছি হাঙর থাকে, তাহলে বিপদ হবে। তবে ল্যানের ভেতর এ-পর্যন্ত কোন হাঙর দেখেনি। কিন্তু বাইরে থেকে আসতে কতক্ষণ?