জোয়ার এখনও পুরোপুরি নামেনি। ফাঁদের মধ্যে পানি রয়েছে। আবার জোয়ার এলে সহজেই বেরিয়ে যেতে পারবে স্কুইডটা। ততক্ষণ টিকতে পারলে হয়। আটকা পড়েছে পাথরের ফাদে। একেবারে নেমে যাবে পানি। রোদ উঠবে।
তখন কি করবে? ভাবসাবে মনে হচ্ছে বিপদ এখনও বুঝতে পারেনি ওটা।
ফাঁদের ভেতরে পানি কুচকুচে কালো, স্কুইডের কালি মেশানো। শরীরের ভেতরের থলে বোঝাই করে পানি টানছে, তীব্র গতিতে ছুঁড়ে মারছে আবার, উল্টোদিকে ছুটে যেতে চাইছে রকেটের মত, পারছে না পাথরের দেয়ালের জন্যে। ঠেকে রয়েছে।
আরিব্বাবারে, কত্তো বড়! গাল ফুলিয়ে বলল মুসা। শরীরটাই বিশ ফুট হবে।ড় আরও বিশ ফুট।
তু এটাকে ছোটই বলা চলে, রবিন বলল। বেয়াল্লিশ ফুট লম্বা উড়ওয়ালা স্কুইডও ধরা পড়েছে। শার্ম তিমির সঙ্গে অনেক সময় লড়াই বাধে স্কুইডের। একবার ওরকম এক লড়াই দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল একদল বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রীর। লড়াইয়ে তিমিটা হেরে গিয়েছিল।
কিশোর ঠিকই বলেছে, মুসা বলল। এটাকে ধরে নিয়ে যেতে পারলে ভাল পয়সা মিলত। কিন্তু পারব না। হাতে পেয়েও ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
জীবটার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ভাবছিল আর নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছিল কিশোর। বলল, এটাকে কাজে লাগাতে পারি আমরা। দড়ি বানাতে পারি।
দড়ি? হাহ, পাগল হয়ে গেছ তুমি। এটা দিয়ে দড়ি বানাবে কি করে?
ড়গুলো দিয়ে। ফালি করে কেটে নিলে খুব শক্ত দড়ি হবে, চামড়ার ফালির মত।
ঘোঁৎ করে উঠল মুসা, বিশ্বাস করতে পারছে না।
কেন পারব না? কিশোরের কণ্ঠে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। বোয়াকনসট্রিকটর আর অ্যানাকোন্ডার চামড়া দিয়ে যদি দড়ি হয় স্কুইডের বঁড় দিয়ে কেন হবে না? মালয়েশিয়ায় অজগর দিয়েও দড়ি বানায় লোকে। ওগুলো এত টেকসই, আসবাবপত্র মোড়ানর কাজে ব্যবহার করে, লস অ্যাঞ্জেলেসের বড় বড় অনেক দোকানে দেখতে পাবে। আমার তো বিশ্বাস, এই ঔড় দিয়ে সাপের দড়ির চেয়ে শক্ত দড়ি হবে।
…বেশ, তা নাহয় হল, কিন্তু কাটতে যাচ্ছে কে? বললেই তো খসিয়ে দিয়ে দেবে না স্কুইড। আমি ওই শুড়ের ধারেকাছে যেতে চাই না। রেগে আগুন হয়ে শেষে আমাকে দিয়েই নাস্তাটা সেরে ফেলবেন মহামান্য কালির মহাজন।
সূর্য উঠল। রোদ চড়তে লাগল। গরম সইতে না পেরে অস্থির হয়ে উঠল দানবটা, রাগ বাড়ছে। মেরু অঞ্চলের ঠাণ্ডা পানি ওদের পছন্দ, হামরোল্ড স্রোতের কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে ভেসে চলে আসে বলে নিরক্ষীয় অঞ্চলের গরম টের পায় না। দিনের বেলা ওই স্রোতের মধ্যেই থাকে। রাতে আবহাওয়া খুব ঠাণ্ডা হলে স্রোত ছেড়ে উঠে আসে ওপরে, আলো ফোঁটার আগেই ডুবে যায় আবার। রোদ ভীষণ অপছন্দ।
কড়া রোদে অস্থির হয়ে অল্প পানিতে সাংঘাতিক দাপাদাপি শুরু করল ওটা। শুঁড় দিয়ে চাবুকের মত বাড়ি মারতে লাগল দেয়ালের বাইরে মাটিতে, ধারাল দাঁতের আঁচড়ে গভীর ক্ষত হয়ে গেল শক্ত প্রবাল পাথরে।
হঠাৎ এক লাফ দিয়ে উঠে গেল ছয় ফুট। চাবুকের মতই শাঁই শাঁই শুঁড় চালাল বাতাসে। লাফিয়ে সরে এল রবিন আর মুসা। কিশোর সরে সারতে পারল না। পাথরে হোঁচট খেয়ে গেল পড়ে।
শাঁ করে এসে তার কোমর জড়িয়ে ধরল একটা ভয়াবহ ভঁড়। নারকেল কাপড়ের পোশাক কেটে চামড়ায় বসে যেতে লাগল তীক্ষ্ণধার দাঁত।
বড় একটা পাথর দিয়ে উঁড়টায় পাগলের মত বাড়ি মারতে শুরু করল মুসা। কুমালো! কুমালো! বলে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল রবিন।
ধীরে ধীরে কিশোরকে মুখের কাছে টেনে নিচ্ছে প্রকাণ্ড শুঁড়টা। ঈগল-চঞ্চর, মত ঠোঁটটা ফাঁক হয়ে বেরিয়ে পড়ল একসারি করাতে-দাঁত। দুই হাতে একটা পাথর আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছে কিশোর। পারছে না। টানের চোটে হাত ছুটে গেল পাথর থেকে। ধরল আরেকটা পাথর। হ্যাঁচকা টানে ওটা থেকেও তার হাত ছুটিয়ে নিল স্কুইডের গুঁড়।
তিন-হাতে পায়ে ভর দিয়ে আহত পা-টা টানতে টানতে তাঁবু থেকে বেরোল কুমালো।
কুমালে, জলদি! চেঁচিয়ে বলল রবিন। তার ধারণা, স্কুইডকে ঠেকার নিশ্চয় কোন উপায় জানে পলিনেশিয়ানরা।
পাথর দিয়ে বাড়ির পর বাড়ি মারছে মুসা। যেন রবারে লাগছে পাথর, কিছুই হচ্ছে না গুঁড়টার। শেষে পাথরটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কিশোরের দুহাত চেপে ধরল। শুরু হল যেন স্কুইডে আর মানুষের দড়ি টানাটানি।
দুজনে মিলেও থামাতে পারল না খুঁড়টাকে। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলেছে স্কুইড। আর মাত্র কয়েক ফুট তফাতে রয়েছে অপেক্ষমাণ ঠোঁট।
মুসা, খবরদার! সাবধান করল রবিন। আরেকটা ঔড় এগিয়ে আসছে মুসাকে ধরার জন্যে, সে দেখতে পায়নি। রবিনের চিৎকার শুনে লাফ দিয়ে সরে গেল একপাশে।
অবশেষে পৌঁছে গেল কুমালো। বড় একটা পাথর তুলে নিয়ে ভাল পা-টায় ভর দিয়ে দাঁড়াল। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারল পাথরটা। পাথর আর বর্শা ছুঁড়ে মাছ মারায় ওস্তাদ পলিনেশিয়ানরা। হাতের নিশানা খুব ভাল। আহত, অসুস্থ অবস্থায়ও কুমালোর লক্ষ্য ফসকাল না। দুর্বল অবশ্যই, কিন্তু এই জরুরি মুহূর্তে কোথা থেকে যেন অসুরের বল এসে গেছে তার গায়ে।
উড়ে এসে পাথরটা ঢুকল দানবের ঠোঁটে, চোয়ালে এমন শক্ত হয়ে আটকে গেল, কিছুতেই খুলতে পারল না স্কুইড।
একমুখ পাথর নিয়ে মানুষ খাওয়ার আশা ছাড়তে বাধ্য হল কালির মহাজন। কিন্তু ওঁড়ের বাঁধন আলগা করল না। যেন প্রতিজ্ঞা করেছে, আচ্ছামত শান্তি দিয়ে ছাড়বে ব্যাটাদের।