হঠাৎ প্রচণ্ড আলোড়ন উঠল পানিতে, বিরাট কিছু একটা রয়েছে। দুটো সবুজ গোলক ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল মুসার দিকে।
চিৎকার করে উঠল সে। তবু দৌড় দিতে পারল না। চোখ দুটো যেন সম্মােহিত করে ফেলেছে তাকে, মাটির সঙ্গে আঠা দিয়ে জুড়ে দিয়েছে পা। স্বপ্নে যেরকম হয়, ইচ্ছে থাকলেও দৌড় দিতে পারে না মানুষ। সে-কারণেই তার মনে হচ্ছে, আবারও দুঃস্বপ্ন দেখছে।
পায়ের শব্দ শোনা গেল। পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে? চিৎকার করছ
কেন?
তারপর সে-ও দেখল ওগুলো। মুসার মতই বিশ্বাস করতে পারছে না।
চোখের মতই তো লাগছে, রবিন বলল।
কিন্তু এত বড়? বলল মুসা। নাকি প্ল্যাঙ্কটন জমে আছে কে জানে!
পাগল নাকি? কিশোর বলল। প্ল্যাঙ্কটন কখনও ওভাবে গোল হয়ে জমে সাঁতরাতে পারে না। ওগুলো চোখই। আরিব্বাপরে, কত বড় একেকটা!
যেন ম্যানহোলের ঢাকনা! ভূত না তো! বলতে বলতে পিছিয়ে গেল মুসা। ফাদের ভেতর পড়ে যাবার ভয়েই বুঝি। হুঁশিয়ার! ব্যাটা আসছে!
ঝটকা দিয়ে সামনে এগোল ওটা।
চমকে পিছিয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।
ওটার নড়াচড়ায় কয়েক টন পানি বেরিয়ে গেল ফাদের ভেতর থেকে। কালো কালো বিশাল কয়েকটি সাপ কিলবিক করে শূন্যে উঠল, আবার ঝপাত করে পড়ল পানিতে।
জায়ান্ট স্কুইড! আচমকা চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ভাল করে দেখার জন্যে আগে বাড়ল। একটা সাপ তার দিকে এগোতেই তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এল আবার।
ফোয়ারার মত ছিটকে এল তরল পদার্থ। ভিজে গেল তিন গোয়েন্দা।
পানি ছিটিয়ে ভেজাচ্ছে, মুসা বলল। ব্যাটা খেলছে আমাদের সঙ্গে।
পানি না, কালি,রবিন বলল। সাবধান, চোখে যেন না লাগে।
আরও দূরে সরে এল ওরা।
এ-জন্যেই ওদেরকে বলে কালি-কলম মাছ, বিড়বিড় করল কিশোর।
হ্যাঁ, বিদ্যে ঝাড়ার সুযোগ পেয়ে গেছে রবিন। খুব ঘন কালি, লেখা যায়। একজন অভিযাত্রী একবার ওই কালি দিয়ে লগবুক লিখেছিল।
দাপাদাপি তো করছে খুব, মুসা বলল। ঘাড়ের ওপর এসে না পড়ে।
মনে হয় না। ডাঙায় উঠতে পারে না ওরা।
সাগরে তো নামতে পারে?
কিভাবে নামতে হবে জানলে তো সহজেই পারত। কিন্তু যেমন বড় তেমনি বোকা। এরকম ফাঁদে নিশ্চয় আর কখনও পড়েনি। বেরোতে পারবে না।
ধরে নিয়ে যেতে পারলে হত, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। এরকম একটা স্কুইডই চেয়েছেন মিস্টার লিসটার।
কিন্তু এই জীবটা তিনি পাচ্ছেন না, বলল রবিন। আশা করা যায়, স্কুনার নিয়ে ফেরার পথে ধরতে পারব একটা। হামবোল্ড কারেন্টে অনেক পাওয়া যায় এগুলো?
দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল ঘেঁষে যে স্রোতটা এসেছে, তার কথা বলছ?
হ্যাঁ। মনে আছে তোমার ওই বইটার কথা, ছয়জন তরুণ বিজ্ঞানী বালসা গাছের ভেলায় চড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন সাগরে? পেরু থেকে রওনা হয়েছিলেন তারা, ওই স্রোতে ভেলা ভাসিয়ে দক্ষিণসাগরের দ্বীপে এসেছিলেন। অসংখ্য স্কুইড দেখেছিলেন তাঁরা। রাতের বেলা ভেসে উঠত ওগুলো, দিনে তলিয়ে যেত গভীর পানিতে।
সবুজ আলো দুটোর উজ্জ্বলতা এখন কমছে বাড়ছে, যেন ভেতরের বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্র ভোল্টেজ একবার বাড়াচ্ছে একবার কমাচ্ছে।
গায়ে কাঁটা দিল মুসার। খাইছে! ব্যাটা চোখের পাতা ফেলে না কেন একবারও? গুহার ভেতরে অষ্টাপদী জীবটার সঙ্গে লড়াইয়ের কথা মনে পড়ল তার। ওটার চোখেও এরকম শয়তানী ছিল, তবে আরও ছোট চোখ, আর দেখতে মানুষের চোখের মত। এটার মত উজ্জ্বলতাও ছিল না ওগুলোয় মাথা দোলাল সে, হুঁ, অক্টোপাস আর স্কুইডের মাঝে ফারাকটা এখন বুঝতে পারছি। মাঝে মাঝেই ভাবতাম তফাৎটা কোথায়?
অনেক তফাৎ, রবিন বলল। এটার চোখ বাসনের মত, অক্টোপাসের চোখ থিমবলের মত। অক্টোপাসের শরীর একটা আস্ত ফোলা ব্যাগ, আর এটার হল টরপেডোর মত। চলেও ওরকম ভাবেই। শুঁড় দশটা। দুটো শুঁড় আরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। ওঁড়ে কাপের মত বসানো রয়েছে, তবে অক্টোপাসের মত সাকশন কাপ নয়, এগুলোতে রয়েছে ধারাল দাঁত। মারাত্মক। ইস্পাতের তার কেটে ফেলতে পারে।
যাহ্, বাড়িয়ে বলছ।
এক বর্ণও না। আমেরিকান মিউজিয়ম অভ নেচারাল হিস্টরির কয়েকজন বিজ্ঞানী একবার এক অভিযানে বেরিয়েছিলেন। বড় মাছ ধরার জন্যে তাঁরা ব্যবহার করছিলেন ইস্পাতের তার। সেই তার কেটে দিয়েছে স্কুইডের সাত। কাজেই সাবধান। অবশ্য যদি নিজেকে ইস্পাতের চেয়ে শক্ত মনে কর, তাহলে আলাদা কথা।
ভোর এল। অন্ধকার তাড়ানর জন্যে উঠেপড়ে লাগল ধূসর আলো। দানবটাকে স্পষ্ট দেখা গেল এখন। পুরো ফাঁদটা জুড়ে রয়েছে। শরীরের জন্য, শুড়ের জায়গা হচ্ছে না ভেতরে। পাথরের ওপর দিয়ে এসে শুকনোয় বিছিয়ে আছে ওগুলো।
ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলাচ্ছে টর্পেডোর মত শরীরটা। কালো থেকে বাদামী, বাদামী থেকে তামাটে, তামাটে থেকে ফ্যাকাসে সাদা।
গোল চোখের ব্যাস একফুট। রাতের চেয়ে এখন আরও ভয়ঙ্কর লাগছে। ফসফরাসের সবুজ আলো মিলিয়ে গেছে এখন, চোখ দুটোকে লাগছে এখন কালো, দুটো গর্তের মত, যেন যে কোন মুহূর্তে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে আতঙ্ককর কিছু। তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে ছেলেদের দিকে। স্থির ওই চোখের দিকে
তাকিয়ে নিজেদেরকে বড় ক্ষুদ্র আর অসহায় মনে হল তিন গোয়েন্দার।
প্রশান্ত মহাসাগরের দুঃস্বপ্ন! বিড়বিড় করল কিশোর। একেবারে মানানসই।