সানগ্লাস দরকার আমার, মুসা বলল। চোখের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে রোদ। এভাবে রোদের দিকে সারাক্ষণ চেয়ে থাকতে হলে অন্ধ হয়ে যাব।
ঠিকই বলেছে ও। এসব ছায়াশূন্য দ্বীপে আটকা পড়া অনেক নাবিকই অন্ধ হয়ে গেছে রোদের কারণে।
জালের বুনন কোথাও মোটা, কোথাও মিহি। ওরকম মিহি কাপড়ের ফালি কেটে চোখে বেঁধে নিল সে। খুদে ফাঁক দিয়ে তাকাল। আরে! কাজ হচ্ছে। রোদ আর ততটা লাগে না চোখে। যদিও দেখা যায় কম। তাতে কি? কাজ চললেই হল।
যাক, আরামই লাগছে, কিশোর বলল।
তা তো লাগছে, বলল মুসা। কিন্তু আমাকেও কি তোমার মতই কিত লাগছে?
হ্যাঁ, লাগছে, হেসে বলল রবিন। একেবারে নারকেল গাছের ভূত। হাসতে শুরু করল তিনজনেই।
চল, কুমালোকে দেখাই, প্রস্তাব দিল মুসা।
পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকল ওরা। তবু সামান্য শব্দ হয়ে গেল। তন্দ্রায় দুলছিল কুমালো, হঠাৎ জেগে তিনটে কিম্ভুত মুখোশ পরা মূর্তিকে দেখে চমকে চিৎকার করে উঠল। তারপর চিনতে পারল ওদেরকে। কাপড়, চশমা, আর থলের প্রশংসা করল।
কি জানি, মাথা চুলকাল সে। সন্দেহ হচ্ছে, তোমাদের গায়েও পলিনেশিয়ান রক্ত বইছে কিনা। নইলে এভাবে নকল কর কিভাবে? যা-ই পাচ্ছ, ঠিক কাজে লাগিয়ে ফেলছ।
খুশি হয়ে আবার উপসাগরের ধারে ফিরে এল ওরা। কুমালোর প্রশংসা অনেক উৎসাহ জোগাল ওদের।
এখন, পলিনেশিয়ানদের মত ডুব দিতে পারলেই হয়, বলল কিশোর। তাহলে কিছু মুক্তো তুলতে পারব।
কিন্তু কাজটা মোটেই সহজ নয়। পাথর নিয়ে কয়েকবার চেষ্টা করে দেখল কিশোর, তলায় পৌঁছতে পারল না। তবে প্রতিবারেই আগের চেয়ে বেশি নিচে নামতে পারছে। বুঝল, আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে। পুরো ব্যাপারটাই অভ্যাসের।
ব্যাগ কোমরে বেঁধে নিচে নেমে গেল মুসা। ঝিনুক কুড়িয়ে থলেতে ভরে উঠে আসার সময় খেয়াল করল, ভারি হয়ে গেছে। টেনে রাখছে নিচের দিকে। বেশি, জোরাজুরি করলে থলে ফেটে সব পড়ে যাওয়ারও ভয় রয়েছে। শেষে মাত্র তিনটে ঝিনুক নিয়ে উঠে আসতে হল তাকে।
আসলে একটা দাড়ি দরকার আমাদের, মুসা বলল। ব্যাগ বেঁধে দেব। টেনে তোলা যাবে।
ঠিকই বলেছ, একমত হল কিশোর। ভেলা তৈরির জন্যেও দড়ি দরকার। কিন্তু এই পাথরের রাজ্যে পাই কোথায়?
দড়ি খুঁজে অনেকটা সময় কাটাল ওরা। কুমালোর কাছে জেনেছে, ছোবড়া দিয়ে দড়ি তৈরি করে পলিনেশিয়ানরা। কিন্তু পেয়েছে মাত্র একটা নারকেল, ওটা দিয়ে আর কত লম্বা দড়ি হবে।
লিয়ান লতা দিয়ে দড়ির কাজ চালানো যায়। কিন্তু এই দ্বীপে তেমন কোন লতাই নেই।
আমাজানের জঙ্গলে ওরা দেখেছে, বোয়া সাপের চামড়া দিয়ে দড়ি বানায় ওখানকার জংলীরা। অ্যানকোণ্ডা সাপের চামড়া দিয়েও হয়। কিন্তু প্রবাল অ্যাটলে সাপ থাকে না, না ছোট, না বড়। সাগরের সাপ অবশ্য আছে, তবে এই ল্যাগুনে একটাও দেখতে পেল না ওরা।
দড়ি না পেলেও খাবার পেল। একটা শসা নিয়ে ঘরে ফিরল বিকেলে।
কুমালো চমকে যাবে, হাসতে হাসতে বলল মুসা। কে ভাবতে পেরেছিল প্রবালের বাগানে শসা পেয়ে যাব?
এই বিশেষ শসাটা কোন সজি নয়, কোন বাগানেও জননি। এটা একটা জলজ প্রাণী, নাম সী কিউকামবার বা সাগরের শসা। চীনাদের খুব প্রিয় খাবার।
ল্যাগুনের প্রবালের একটা তাকে ওটাকে পড়ে থাকতে দেখেছে ছেলেরা। বিশাল এক শসার মতই দেখতে, গায়ে শসার মতই শুয়া রয়েছে, চামড়ায় চাকা চাকা দাগ। বেশ মোটা, আর ফুটখানেক লম্বা। তবে পানির ওপরে তোলার পর চুপসে অর্ধেক হয়ে গেল।
এই জীবটাও বিষ ছড়াতে পারে, সেই বিষ চোখে লাগলে অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কাজেই ছুরি দিয়ে গেঁথে সাবধানে তুলেছে ওটাকে মুসা। রেখে দিয়েছে গরম পাথরের ওপর। মরে যাওয়ার পর ক্যাম্পে এনেছে।
কুমালোর নির্দেশ মত লম্বালম্বি চিরে পাঁচটা ফালি করল ওটাকে কিশোর। ঝলসে নিল আগুনে। চেহারাটা কুৎসিত, কিন্তু খেতে চমৎকার লাগল সাগর-শসার মাংস।
৫
সেরাতে দুঃস্বপ্ন দেখল মুসা। ঘুমের মধ্যেই চেঁচাতে শুরু করল, ওরে বাবারে! কানা হয়ে গেলামরে! সাগর-শসার বিষ লেগেছে!
ঠেলা দিয়ে তাকে জাগাল কিশোর। এই মুসা, চেঁচানি থামাও। দুঃস্বপ্ন দেখছ।
আর ঘুম এল না মুসার। হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল ছাউনি থেকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। দেখতে পাচ্ছে সবাই, তারমানে অন্ধ হয়নি। আসলেই দুঃস্বপ্ন ছিল ওটা।
কালো কালো মূর্তির মত তার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে নারকেলের কাণ্ডগুলো।
তারার ঘড়ি দেখে অনুমান করল, ভোর তিনটে বাজে। ল্যাগুনের শান্ত পানিতে সাদার্ন ক্রসের উজ্জ্বল প্রতিবিধ ঝিলমিল করছে।
ল্যাগুনের ধারে পায়চারি শুরু করল সে, উত্তেজনা কমানোর উদ্দেশ্যে। তারপর সরে এল সাগরের ধারে। সাগরও নীরব। ঢেউ নেই। জোয়ার নামছে।
অলস ভঙ্গিতে হেঁটে এগোল সে ফাঁদে কি পড়েছে দেখার জন্যে। কিনারে। এসে ভেতরে তাকাল। ভীষণ চমকে উঠল সে। জীবনে এরকম দৃশ্য দেখেনি। বিশাল দুটো চোখ তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।
বাসনের সমান বড় একেকটা। তার মনে হল, কোন জীবন্ত প্রাণী নয়, প্রাণীর ওরকম চোখ থাকতে পারে না। সত্যি সত্যি দেখছে, না সে এখনও ঘুমিয়েই রয়েছে? আরেকটা দুঃস্বপ্ন দেখছে।
কেমন যেন ভূতুড়ে সবুজ রঙ চোখগুলোর, জ্বলছে। মনে হয় কাচের ওপাশে বৈদ্যুতিক বাতি বসানো। ট্রাফিকের সিগন্যাল বাতি যেন বলছে যাও। যাওয়ার ইহেও হল মুসার। কিন্তু পা কথা শুনতে চাইছে না।