দ্রুত মাছগুলোর চামড়া পরিষ্কার করে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলল ওরা। লম্বা লম্বা কাঠিতে গেঁথে ধরল আগুনের ওপর।
মাছের কাবাব দিয়ে চমৎকার নাস্তা হল সেদিন। কিছুই অবশিষ্ট রাখল না। কাঁটায় লেগে থাকা, মাংসগুলো পর্যন্ত চেটেপুটে সাফ করে ফেলল। সেই সঙ্গে রয়েছে ডুবো ঝর্নার মিষ্টি পানি। আয়েশ করে ঢেকুর তুলল সবাই। ভুলে গেল। প্রথম তিন দিনের আতঙ্ককর পরিস্থিতির কথা। মৃত্যুদ্বীপকে জয় করেছে ওরা।
আশা করা যাচ্ছে, রবিন বলল। ডেংগু আসাতক বেঁচে থাকতে পারব আমরা। একটা কাঠিতে ছুরি দিয়ে গোল গোল খাজ কাটছে সে, তিনটা কেটে ফেলেছে, আরেকটা কাটছে।
কি করছ? মুসা জিজ্ঞেস করল।
দিনের হিসেব রাখছি। কাঠিটা যেরকম লম্বা, তাতে চোদ্দটা খাজ কাটা যাবে। আমার বিশ্বাস, ততদিনে মোটর বোটটাকে দেখতে পাব। ইস, কি যে আনন্দের দিন হবে সেদিনটা!
রবিন, কিশোর বলল। কয়েকটা কথা বলার সময় এসেছে। তোমাদের জানিয়ে রাখা উচিত মনে করছি। একদিন খুব ঝামেলা গেছে, দুশ্চিন্তায় ছিলাম, আরও বেশি চিন্তায় পড়ে যাবে বলে বলিনি। ডেংগুর আশা ছাড়তে হবে আমাদের। দ্বীপ থেকে বেরোতে হলে ভেলা তৈরি করতে হবে।
রবিন, মুসা, কুমালো, তিনজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোরের দিকে।
ভেলা? মুসা বলল। ভেলা কি দরকার? বোটই যখন পাব?
না, বোট আসছে না, ভুল রীডিং লিখে ডেংগুকে কিভাবে ফাঁকি দিয়েছে, খুলে বলল কিশোর। কাজেই বুঝতেই পারছ, নিজের পায়ে কিভাবে কুড়োল মেরেছি।
তা মেরেছ, মাথা দোলাল মুসা।
না, ঠিকই করেছ তুমি, কুমালো বলল। এছাড়া আর কি করতে পারতে? তুমি তো আর জানতে না এখানে এনে আমাদেরকে আটকাৰে ডেংগু। তুমি করেছ, যাতে মুক্তা চুরি করতে না পারে সে। প্রফেসরের সম্পদ রক্ষা করেছ। এটা তোমার দায়িত্ব ছিল। আর এত ভাবনার কিছু নেই। খাবার আর পানি যখন পাওয়া গেছে, বেরিয়েও যেতে পারব আমরা। ভেলা বানাতে পারবে। নারকেলের অনেক কাণ্ড আছে।
কিন্তু শুধু কাণ্ড দিয়েই হবে না, রবিন বল। বাধব কি দিয়ে ওগুলোকে? পেরেক নেই, স্কু, বন্টু, দড়ি কিচ্ছু নেই। কুমালোর জবাবের জন্যে অপেক্ষা করল
সে। তাছাড়া আসল কাজই এখনও বাকি রয়ে গেছে, যে জন্যে আমরা এলাম এখানে, আটকা পড়লাম। মুক্তো ভোলা। কিছু নমুনা নিয়ে গিয়ে তাঁকে দেখাতে হবে। মুক্তো তোলার জন্যে এত নিচে ডুব দেবে কে? তুমি তো অসুস্থ।
কাজটা আমাদেরকেই করতে হবে আরকি, কিশোর বলল।
হাঁ হয়ে গেল রবিন। ষাট ফুট! তিরিশের বেশি আমি পারব না। পঁয়তাল্লিশের বেশি মুসাও পারবে কিনা সন্দেহ।
হাসল মুসা। ওর এই হাসির অর্থ বুঝল কিশোর। ব্যাপারটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ফেলেছে গোয়েন্দা সহকারী। আর একবার যখন নিয়েছে, সহজে ক্ষান্ত হবে না।
খানিক পরেই তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল মুসা। পিছে পিছে রওনা হল কিশোর আর রবিন।
ল্যাগুনের পাড়ে এসে কাপড় খুলে পানিতে নামল মুসা। ডাইভিং প্র্যাকটিস শুরু করল।
ডুব দিয়ে নেমে গেল অনেক নিচে। কিছুক্ষণ পর ভেসে উঠে ফোঁস্স্ করে বাতাস ছাড়ল মুখ দিয়ে।
দম নেয়ার পর বলল, তিরিশ ফুটের বেশি নেমেছি। পানি খালি ঠেলে রাখে। পায়ে দুটো লোহার জুতো পরতে পারলে কাজ হত। টেনে নামাত।
বিকেলে দোকান থেকে এনে দেবখন, হেসে বলল রবিন। আপাতত একটা পাথর দিয়ে কাজ চালাও।
হ্যাঁ, তাই করতে হবে।
একটা পাথর বেছে নিল মুসা, তার মাথার দ্বিগুণ। ওটা দুহাতে ধরে মাথা নিচু করে ডুব দিল। ভারের কারণে প্রথমে বেশ দ্রুত নেমে চলল, আস্তে আস্তে কমে এল গতি। কিন্তু তলায় নামতে পারল। এক হাতে পাথরটাকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে আরেক হাতে একটা ঝিনুক তুলে নিল। তারপর ছেড়ে দিল পাথরটা। সঙ্গে সঙ্গে তীরবেগে তাকে ঠেলে তুলতে লাগল পানি।
বিশাল বাদামী ঝিনুকটা তীরে ছুঁড়ে মারল সে।
পানির তলায় বেশিক্ষণ থাকেনি, বিশ সেকেণ্ড। ফলে পানির চাপ তেমন প্রতিক্রিয়া করল না শরীরে।
বাপরে বাপ, পিষে মেরে ফেলতে চায়! শ্বাস নিতে নিতে বলল সে। এভাবে একটা একটা করে ঝিনুক তুলতে হলে এক মুক্তা পেতেই এক বচ্ছর লাগবে।
একটা ঝুড়ি হলে…। কিশোরের কথায় বাধা দিল মুসা, কোথায় পাবে?
জানি না। চল, কুমালোকে জিজ্ঞেস করি।
কুমালোকে সমস্যাটার কথা বলতে পড়ে থাকা নারকেল কাণ্ডের মাথার দিকে তাকাল সে। বলল, নারকেল গাছের মাথায় শক্ত আঁশে তৈরি এক ধরনের জাল থাকে। চেষ্টা করলে ওগুলো দিয়ে একটা থলে বানানো যায়।
দূর! বলে মাথা নাড়ল মুসা।
তবে নারকেলের জাল বা কাপড় পাওয়া গেল। গাছের মাথার কাছে ডালের গোড়ায় জড়িয়ে থাকে এই জাল। বেশ শক্ত। ডালের গোড়ার ফুটখানেক ওপর থেকে ডালপাতা সব মুড়িয়ে নিয়ে গেছে ঝড়। তবে গোড়া যেটুকু আছে, তাতে পাওয়া গেল ওই জাল। ছুরি দিয়ে কয়েক টুকরো কেটে নিয়ে ওই জালের সুতো দিয়েই সেলাই করে থলে তৈরি হয়ে গেল।
আচ্ছা, এই জিনিস দিয়ে কাপড় হয় না? রবিন বলল।
হয়ত হয়, আনমনে বলল কিশোর চামড়ায় ঘষা লাগবে। আরাম পাব না। তবে দিনের বেলা গায়ে দিয়ে রাখলে রোদ বাঁচবে কিছুটা।
কড়া রোদ সাদা প্রবালে প্রতিফলিত হয়ে এসে গায়ে লেগে চামড়ায় যেন ছ্যাকা দেয়। ফোঁসকা পড়ে যাওয়ার অবস্থা।
নারকেলের কাপড় দিয়ে শার্ট, কিংবা বলা ভাল গায়ের কিশোর। গায়ে দিয়ে দেখল, ভালই, রোদ অনেকখানি ঠেকায়।