জোর আলোচনা চলল। মাছ ধরা যায় কি উপায়ে? সুতো নেই, বড়শি নেই, ছিপ নেই, টোপ নেই, জাল নেই, বর্শা নেই। কি দিয়ে ধরবে?
কুমালো সুস্থ স্বাভাবিক থাকলে একটা জবাব বের করা যেত। কিন্তু রোগে ভুগে ভীষণ ক্লান্ত সে, ঘুমোচ্ছে। সমস্যাটা নিয়ে প্রায় ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল তিন গোয়েন্দা। হাই তুলল মুসা। ঘুম পেয়েছে।
একটা ফাদ বানানো যায়, কিশোর প্রস্তাব দিল। অবশ্য যদি একটা বাক্স বা ঝুড়িটুড়ি পাওয়া যায়। কিন্তু নেই, আবার হাই তুলল মুসা, হাত চাপা দিল মুখে। কাজেই ফাঁদ তৈরি হচ্ছে না। আর কোন উপায়ও নেই…
নিশ্চয় আছে! চেঁচিয়ে বলে, একলাফে উঠে কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে গেল কিশোর। রবিনও বেরোল। ঘুমজড়িত চোখে তাদের পিছু নিল মুসা, কি করে কিশোর দেখার জন্যে কৌতূহল হচ্ছে।
সূর্য ডুবে গেছে। যাই যাই করে এখনও রয়ে গেছে গোধূলির কিছু আলো। সাগরের পারে এসে পাথর জড়ো করতে শুরু করল কিশোর।
দয়া করে বলবে, কি করছ? আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করল মুসা।
ফাঁদ তৈরি করছি, পাথরের ফাঁদ। এটাই উপযুক্ত সময়, জোয়ার এখন সবে আসতে শুরু করেছে। পাথর গায়ে গায়ে লাগিয়ে একটা গোল দেয়াল তৈরি করব। জোয়ারে ডুবে যাবে ওটা। যখন পানি নেমে যাবে, হয়ত একআধটা মাছ আটকে থাকতেও পারে ওর ভেতর।
খাইছে। ঠিকই তো বলেছ! তুড়ি বাজাল মুসা। ঘুম দূর হয়ে গেছে। কিশোর আর রবিনের সঙ্গে সে-ও দেয়াল তৈরিতে হাত লাগাল। দেয়ালটা ছড়িয়ে নিয়ে গেল পানি পর্যন্ত, যাতে জোয়ার চলে যাওয়ার পরেও তাতে চিকচিকে পানি থাকে।
শেষ হল দেয়াল। তিন ফুট উঁচু, বিশ ফুট চওড়া।
হিসেব করে বের করল কিশোর, মাঝরাতের দিকে ডুবে যাবে দেয়াল, ভোরে সূর্য ওঠার আগে আবার বেরিয়ে আসবে। ভেতরে পানি থাকবে তখনও।
পরদিন সকালে রোদের বর্শাগুলো যখন সবে ছড়াতে শুরু করেছে সূর্য, দুএকটা ঢুকে পড়েছে মাছের চামড়ার তাঁবুতে, ঘুম ভাঙল মুসার। শুয়াপোকা আর উই হজম করে ফেলেছে পেট, নতুন খাবার চাইছে। কিশোর আর রবিনকে ডাকল, এই ওঠ ওঠ! আলসে হয়ে গেছে সব। চল, গিয়ে দেখি কি মাছ পড়ল।
ফাঁদের তলায় নেমে গেছে পানি। অল্প পানিতে ছোটাছুটি করছে কয়েকটা বিচিত্র ছোট জীব, বেরোনর পথ খুঁজছে। খুব সুন্দর একটা মাছ দেখা গেল, গায়ের রঙ সবুজে সোনালিতে মেশানো, তার ওপর লাল আর নীলের হালকা ভোরা। তিনজনেই চিনতে পারল ওটাকে, অ্যাঞ্জেল ফিশ। আরও দুটো মাছ আছে, অ্যাঞ্জেলের মত এত সুন্দর নয়, তবে খেতে চমৎকার। একটা বাচ্চা ব্যারাকুড়া, আরেকটা মুলেট। বিষাক্ত একটা স্করপিয়ন ফিশও আছে। ওটার কাছেও গেল না তিন গোয়েন্দা। পানিতেই রইল ওটা। পরের বার জোয়ার এলে বেরিয়ে যেতে পারবে, যদি ততোক্ষণ বেঁচে থাকে।
মোচার মত দেখতে একটা তারা মাছ দেখে ধরতে গেল মুসা, থামাল রবিন। খবরদার! মারাত্মক বিষ ওগুলোর কাঁটায়। হাতে ফুটলে প্রথমে হাত ফুলে যাবে। তারপর ফুলবে শরীর। শেষে হৃৎপিণ্ড থেমে গিয়ে মারা যাবে।
সরে এল মুসা। তারা মাছের ধারেকাছে গেল না আর।
খাবার উপযোগী মাছগুলো ধরে নিয়ে মহানন্দে ঘরে ফিরল তিন গোয়েন্দা। ওগুলো দেখে কুমালোও খুশি হল।
কাঁচাই খেতে হবে, সে বলল। খারাপ লাগবে না। তবে বেঁধে নিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু কি করব? গায়ে তো জোর নেই, মলে আগুন জ্বালাতে পারতাম।
দেখি, আমি চেষ্টা করে, বলল কিশোর। তবে বিশেষ ভরসা পেল না। আমাজনের জঙ্গলে ভাসমান দ্বীপে আগুন জ্বালাতে গিয়ে বুঝেছে কাজটা কত কঠিন।
প্রথমেই দরকার শুকনো খড়কুটো। সেটা জোগাড় করা যাবে, নারকেলের কাণ্ড থেকে। ভেতরের কিছু ছোবড়া কেটে নিলেই হবে। তারপর লাগবে কাঠের গুঁড়ো। আর শক্ত শক্ত কয়েকটা কাঠি।
ছোবড়া জোগাড় হল। গুড়োও পাওয়া গেল বাকল চেঁছে। বাকি রইল কাঠি।
কাঠি লাগবে, কিশোর বলল। শক্ত এবং হালকা।
আগের দিন সৈকতে একটা গাছের ডাল পড়ে থাকতে দেখেছিল রবিন। ঢেউয়ে ভেসে এসে আটকা পড়েছে। ছুটে গিয়ে কাঠি কেটে নিয়ে এল সে।
বেশ হালকা কাঠি। খটখটে শুকনো। কিভাবে কি করবে? মুসা জানতে চাইল।
সোজা একটা কাঠিকে সুন্দর করে কেটে ঘোট করল কিশোর। এক মাথা, চোখা করল। বাকলের একটা টুকরো কেটে মাঝখানে ছোট একটা গোল খাঁজ করল। তারমধ্যে রাখল বাকলের গুড়ো। চারপাশে ছড়িয়ে দিল ছোবড়া। তারপর ছোট কাঠির চোখা মাথাটা খাঁজে রেখে দুহাতের তালুতে চেপে ধরে ডলতে শুরু করল, ডাল ঘুটনি দিয়ে ডাল ঘোটা হয় যেভাবে।
দ্রুত থেকে দ্রুততর হল হাত। হাতের জোর ঠিক রাখতে হবে, বাড়াতে হবে গতি, তাহলেই কেবল আসবে সাফল্য। টপ টপ করে ঘাম ঝরতে লাগল তার কপাল থেকে। বাকলের খাঁজটাকে গভীর করে বসে যাচ্ছে কাঠির চোখা মাথা। চারপাশে ছিটকে পড়ছে বাকলের গুড়ো।
আরও জোরে ডলতে লাগল কিশোর। ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল ছোবড়া থেকে। তারপর দপ করে জ্বলে উঠল আগুনের একটা শিখা।
পেটের ওপর ভর দিয়ে শুয়ে পড়েছে মুসা। মুখ নামিয়ে আস্তে আস্তে ফু দিল। আগুনে। তার ওপর আরও কিছু ছোড়া আর শুকনোবার্কলের কুটো রাখল মুসা। উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে লাগল আগুন।
কাঠিটা সরিয়ে এনেছে কিশোর। হউফ! করে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে হাতের। উল্টো পিঠ দিয়ে ঘাম মুছল কপালের। বলল, ইস, এভাবে কষ্ট করে আগুন ধরানো..ম্যাচ থাকলে কত সহজ হত।