দেয়ালের ওপরে উঠে পা দোলাচ্ছে রবিন। পাশে বসে আছে মুসা। হাত বাড়িয়ে মালাটা নিল কিশোরের হাত থেকে। ঠোঁটে লাগাতে গেল। বাধা দিল কিশোর, না না, আর খেয়ো না। দুতিন দিনের শুকনো পেট, বেশি সইতে পারবে না। যা খেয়েছ খেয়েছ। আবার পরে। এটা কুমালোর জন্যে নিয়ে যাই।
পানির নিচের ঝর্না থেকে কুমালোর জন্যে পানি নিয়ে এল ছেলেরা। দেখে, পানি এসে গেল আহত রোগীর চোখে। দুহাতে মালাটা ধরে একচুমুক খেয়ে নামিয়ে রাখল পাশে, ধরে রাখল যাতে গড়িয়ে না পড়ে যায়। বলল, জীবনে আর কোন জিনিস এত মজা লাগেনি।
যাক, দুটো দরকারি জিনিস পাওয়া গেল, বলল কিশোর। ঘর এবং পানি। কিন্তু পেট বলছে খাবার ছাড়া আর বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না।
গুঙিয়ে উঠল মুসা, ঠিক বলেছ! আহারে, দুদিন ধরে যে কি কষ্টে রয়েছে বেচারা, পেটে হাত বোলাল সে।
হেসে উঠল সবাই।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুমালো বলল, এসব কাজ আমারই করার কথা। অথচ আমি একটা মরা কাঠ হয়ে পড়ে আছি এখানে, তোমরা কষ্ট করে মরছ।
হাত নাড়ল কিশোর। বাদ দাও এসব কথা।
হ্যাঁ, তোমারও এখন খাবার দরকার, মুসা বলল। আমাদের চেয়ে বেশি দরকার তোমার। কিশোর, দেরি করে লাভ কি? চল, যাই।
পানি খেয়ে শরীর কিছুটা ঠাণ্ডা হয়েছে। ছাউনির ছায়া ছেড়ে রোদে বেরোতে ইচ্ছে হচ্ছে না কিশোরের। কিন্তু বসে থাকলে চলবে না।
রবিন বলল, খোঁজাখুঁজি তো দুদিন ধরেই করলাম। কিছু থাকলে চোখে পড়ত না? কি পাওয়া যাবে এই হতচ্ছাড়া দ্বীপে?
একটা ব্যাপার চোখ এড়িয়ে গেছে তোমাদের, কুমালো বলল। একটা ভাল লক্ষণ। ওই পাখিটা, গাংচিল। রয়ে গেছে দ্বীপে। খাবার না থাকলে কিছুতেই থাকত না।
প্রথমে আমিও তাই ভেবেছি, কুমালো, কিশোর বলল। শুনে নিরাশ হবে হয়ত। চলে গেছে ওটা। কাল রাতে।
দীর্ঘ একটা নীরব মুহূর্ত, কেউ কথা বলল না। প্রচণ্ড হতাশা যেন চেপে ধরেছে সবাইকে। পানি শক্তি জুগিয়েছে বটে, অন্য দিকে পেটকেও চাঙা করেছে। খাবার চাইছে এখন ওটা।
হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিলোর। বলল, এভাবে বসে থাকলে কিছুই হত না। পানি আর ঘর তো পেয়েছি। খাবারও পাব। ওঠ, এস তোমরা। প্রমাণ করে দেব, পাখি ব্যাটা ভুল করেছে।
৪
ক্ষুধা তীক্ষ্ণ করে দিয়েছে ওদের চোখ। মিহি দাঁতের চিরুনি দিয়ে উকুন বাছার মত করে দ্বীপটায় খুঁজতে লাগল খাবার। অতি ছোট বস্তুও এখন চোখ এড়াবে না।
ওল্টানো যায় এরকম আলগা পাথর যে কটা পেল, সব উল্টে উল্টে দেখল তলায় কি আছে। প্রায় চষে ফেলল বালির সৈকত।
কিন্তু নিরাশ হতে হল।
তিন ঘন্টা খোঁজার পর ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল মুসা। শেষে একটা নারকেলের, কাণ্ডে মাথা রেখে একেবারে শুয়েই পড়ল। একটা আঙুল নাড়তে ইচ্ছে করছে না আর।
খুব মৃদু একটা শব্দ কানে এল, নড়াচড়ার। মনে হল কাটার ভেতরে। কিশোর আর রবিনকে ডাকল সে। কাছে এলে কিশোরকে বলল, কান রেখে দেখ।…কিছু শুনছ?।
কান ঠেকিয়ে রেখেই বলল কিশোর, ভেতরে জ্যান্ত কিছু আছে। ছুরি দিয়ে কেটে বের করা যাবে।
কাটা কাটতে শুরু করল ওরা। পচে নরম হয়ে গেছে। ভেতরের জিনিস দেখে মুখ বিকৃত করে ফেলল রবিন। মোটা মোটা শুয়ালোকার মত কতগুলো জীব।
পোকা! কিশোর বলল। সাদা গোবরেপোকার শুককীট। মুসা, ভর পকেটে। আর আছে কিনা দেখি।
খাবে ওগুলো! রবিনের প্রশ্ন।
প্রাণ তো বাঁচাতে হবে, জবাব দিল কিশোর। নাক টিপে ধরে তেতো ওষুধ খায় না রোগী?
মোট চোদ্দটা পোকা পেল ওরা। সেগুলো দেখাতে নিয়ে গেল কমালোকে।
বিষাক্ত? সন্দেহের চোখে পোকাগুলোর দিকে তাকাচ্ছে রবিন।
মোটেই না, মাথা নাড়ল কুমালো। ভিটামিনে ভরা।
রাঁধা যায় না?
যায়। আগুন তো নেই, রোদে ঝলসেই কাজটা সেরে নিতে হবে। অন্ধকারে থাকে এগুলো, শরীর খুব নরম। গরম পাথরে রেখে রোদে দাও, সেদ্ধ হয়ে যাবে।
ঘিনঘিনে লাগলেও ঝলসানো পুঁয়াপোকার স্বাদ খুব একটা খারাপ লাগল না ছেলেদের কাছে। দুই দিনের খিদে পেটে, যা খাবে এখন তাই ভাল লাগার কথা!
এগুলো যেখানে পেয়েছ, কুমালো বলল। সেখানে উইপোকাও থাকতে পারে। পচা কাঠে বাসা বানায় ওরা।
কুমানোর অনুমান সত্যি। ওই কাণ্ডটারই আরেক প্রান্তে একটা উইয়ের বাসা খুঁজে পেল ছেলেরা। এই পোকার আরেক নাম সাদা পিপড়ে। বেশ মোটা, নরম। রোদ সইতে পারে না। তাড়াহুড়ো করে গাছের ভেতরের সুড়ঙ্গে ঢুকে বাঁচতে চাইল। কিন্তু যেতে দেয়া হল না। রবিনও হাত লাগাল এখন। পোকাগুলোকে বের করে করে রাখল গরম পাথরে। চোখের পলকে কুঁকড়ে, মরে গেল ওগুলো। ধীরে ধীরে সেদ্ধ হল।
আবার কিছু খাওয়া জুটল অভিযাত্রীদের।
হেসে বলল মুসা, বাড়ি গিয়ে মাকে যদি বলি শুঁয়াপোকা আর উই বেঁধে দাও, কি করবে আল্লাই জানে।
আবার খুঁজল ওরা। আর কিছু বেরোল না।
সূর্য ডোবার আগে ডুব দিয়ে গিয়ে পানি তুলে আনল মুসা। মনে হল, আগের মত জোর আর নেই স্রোতের। কিশোরকে জানাল সেকথা।
নিশ্চয় বৃষ্টি, আন্দাজ করল গোয়েন্দাপ্রধান। কয়েক দিন আগে ঝড়ের সময় যে বৃষ্টি পড়েছিল, সেটাই মাটির তলায় জমা হয়েছিল, ফাঁক দিয়ে বেরোতে শুরু করেছে। পানি কমে আসছে, তাই স্রোতের জোরও কমছে। আবার বৃষ্টি না হলে শেষ হয়ে যাবে একসময়। মনে মনে উদ্বিগ্ন হলেও আশঙ্কার কথা কাউকে জানাল, না সে।
পানিতে মাছ নিশ্চয় আছে, কিশোর বলল। ধরি কিভাবে?