খুব উৎসাহের সঙ্গে রওনা হল ওরা, যদিও জানে, প্যানভানাস পাওয়ার আশা তেমন নেই।
একটা পাথর তুলে মুসার হাতে দিতে দিতে কিশোর বলল, এটা চোষ। লালা গড়াতে থাকবে। মনে হবে পানি খাচ্ছ।
বাকি দিনটা খুঁজে বেড়াল ওরা। প্যানডানাসও পেল না, পানি আছে ওরকম কিছুই না। চাঁদের পিঠের মতই মরা যেন এই দ্বীপ।
সেরাতে আবার শিশির ধরা ফাঁদ পাতল কিশোর। কিন্তু পাতার খানিক পরেই এল জোরাল বাতাস, বাষ্প জমতেই পারল না। সকালে শূন্য পাওয়া গেল মালাটা। এমনকি রোগীর জন্যেও এক ফোঁটা পানি মিলল না।
কুমালোর বিহ্বল ভাব কেটে গেছে। ফলে পায়ের অসহ্য ব্যথা টের পাচ্ছে। প্রচণ্ড পিপাসা। তবে জ্বর চলে গেছে। গাল আর কপালে হাত দিলে এখন আগের মত গরম লাগে না। তার সঙ্গে পানির সমস্যা নিয়ে আলোচনা করল কিশোর। পানির জন্যে কি কি করেছে, সব জানাল। তারপর বলল, তুমি নিশ্চয় কোন উপায় বাতলাতে পারবে?
না, কুমালো বলল। এর বেশি আমিও কিছু করতে পারতাম না। ওই পিগউইড খুঁজে বের করা, তারপর মালা পেতে শিশির ধরা…।
জীবনে এতটা বোকা মনে হয়নি নিজেকে, বিড়বিড় করল কিশোর। অসহায়…
কিশোরের বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকাল কুমালো। দুশ্চিন্তা কাবু করে ফেলেছে তোমাকে। একটা কথা বললে শুনবে?
কী?
সাঁতার কাটতে চলে যাও তোমরা। আমার দেশের লোকের বিশ্বাস, কোন ব্যাপার যখন খুব জটিল হয়ে যায়, কিছুতেই কিনারা না হয়, ওটার দিক থেকে তখন মুখ ফিরিয়ে নেয়া উচিত। গিয়ে খেলাধুলা করা উচিত কিছুক্ষণ। এতে শরীরের অস্থিরতা কমে, চিন্তার ক্ষমতা বাড়ে।
বেশ, ডাক্তার কুমালো, তুমি যখন বলছ, যাচ্ছি, শুকনো হাসল কিশোর।
তবে আমার মনে হয় সময়ই নষ্ট হবে অযথা।
আমার কাছে পরামর্শটা ভালই লাগছে, মুসা বলল। বাতাস আছে। পানিও বেশ ঠাণ্ডা। আরামই লাগবে।
রবিন কিছু বলল না। তবে কিশোর আর মুসা উঠতেই সে-ও পিছে পিছে চলল।
সাগরের কিনারে চলে এল ওরা। ল্যাগুনের চেয়ে এদিকটায় ঠাণ্ডা বেশি। ঝাঁপিয়ে পড়ল ঢেউয়ের ওপর। ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে যায়নি দেয়ালটা, সৈকত নেই, একবারেই ঝপ করে নেমে গেছে গভীর পানিতে। তিনটে সীল মাছের মত খেলতে শুরু করল ওরা। ডুব দিচ্ছে, সাঁতার কাটছে, দাপাদাপি করছে। কচুপাতার পানির মত পিছলৈ ধুয়ে চলে গেল যেন তাদের সমস্ত উদ্বেগ।
ধরতে পারবে না আমাকে, মুসাকে চ্যালেঞ্জ করল কিশোর।
পারলে কি দেবে?
এই দ্বীপটা।
এই মরা দ্বীপ কে নেয়? তবু আমি ধরছি তোমাকে। কয়েক গজও যেতে পারল না কিশোর, তার আগেই তাকে ধরে ফেলল মুসা। ভেসে উঠে হাসতে হাসতে বলল, কি, রবিন মিয়া, তুমি চ্যালেঞ্জ করবে নাকি?
মাথা নাড়ল রবিন, না বাবা, পারব না, খামোকা মুখ খরচ করে লাভ নেই।
ডুব দাও,মুসাকে বলল কিশোর। আমি ধরব।
পারবে না জানে, তবু মুসার দ্রুত নেমে যাওয়া ছায়াটাকে লক্ষ্য করে ডুবে চলল কিশোর।
বিশ ফুট মত নেমে থামল মুসা। দেয়ালের ধার ধরে ডুব-সাঁতার দিয়ে চল। তার পিছে তেড়ে এল কিশোর।
দেয়ালের বোতলের মুখের মত জায়গাটায় এসে, যেখানে চওড়া হতে আরম্ভ করেছে দেয়াল, হঠাৎ মুখে ঠাণ্ডা পানি লাগল মুসার। বেশি ঠাণ্ডা।
মনে হল, ঠাণ্ডা পানির একটা ডুবো-প্রবাহ দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে এসে সাগরে পড়ছে। সামনে এগোতেই আবার গরম পানিতে পড়ল সে।
ঠাণ্ডা পানি কিশোরের শরীরেও লাগল। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠতে শুরু করল সে। দম প্রায় ফুরিয়ে এসেছে মুসার, সে-ও উঠতে লাগল।
রবিন দেখল, ভুস জুস করে ভেসে উঠল দুটো মাথা। সাঁতরে কাছে আসতে লাগল সে।
ঝাড়া দিয়ে চুল আর মুখ থেকে পানি ফেলে কিশোর বলল, মুসা, কিছু টের পেয়েছি। ঠাণ্ডা পানি। মনে হল দ্বীপের ভেতর থেকেই আসছে।
এর মানে বুঝতে পারছ?
না তো!
এর মানে পরিষ্কার পানি! বাজি ধরে বলতে পারি আমি।
ধরলে হারবে, আরকি।
কাছে চলে এল রবিন। জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে। তাকে বলল কিশোর। শুনে তার সঙ্গে একমত হল রবিন। নিশ্চয় মিষ্টি পানি! ইস, একটা বোতল পেলে হত! চল, ডুব দিয়ে হাঁ করে মুখে নিই।
ডুব দিল কিশোর। ঠাণ্ডা পানিতে মাথা ঢুকতেই স্রোতের দিকে ফিরে মুখ হাঁ করল। সঙ্গে সঙ্গে মুখে ঢুকল পানি। পরিষ্কার, মিষ্টি! গিলে নিয়ে আবার হাঁ করল। আবার গিলে আবার হাঁ। পানি মুখে নিয়ে ভেসে উঠল ওপরে। তার পাশে ভাসল মুসা।
রবিইন, চেঁচিয়ে উঠল গোয়েন্দা সহকারী। সত্যি মিষ্টি!
খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল কিশোরের। বলল, যাক, অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। রবিন, মুসার সঙ্গে গিয়ে তুমিও খেয়ে এস।
ওরা দুজনে আবার ভাসলে বলল কিশোর, তোমরা এখানে থাক। নিশানা রাখ। আমি গিয়ে মালাটা নিয়ে আসি।
দশ মিনিটের মধ্যেই নারকেলের মালা নিয়ে ফিরে এল সে। কিন্তু মুখ তো নেই, মুসা বলল। ডোবালেই নোনা পানিতে ভরে যাবে। মিষ্টি পানি ভরবে কিভাবে?
পরা যাবে, বলল রবিন। কায়দা আছে।
হ্যাঁ, বলে ডুব দিল কিশোর। নোনা পানিতে ভরে গল মালা। ঠাণ্ডা পানিতে পৌঁছে মালাটা উপুড় করল সে। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে পাম্প করার মত কয়েকবার ওপরে নিচে করল আঙুলগুলো। চাপ লেগে বেরিয়ে গেল নোনাপানি, আর ঢুকতে পারল না, কারণ মিষ্টি পানির চেয়ে ভারি। সেই জায়গা দখল করল মিষ্টি পানি। মালাটাকে কয়েকবার ওপরে-নিচে করে, পানি ঢুকিয়ে, বের করে নিশ্চিত হয়ে নিল। সে, যে আর এক ফোঁটা নোনা পানিও নেই। তারপর মালা ভর্তি মিষ্টি পানি নিয়ে, মালার মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে ভেসে উঠতে শুরু করল ওপরে।