হাই তুলতে তুলতে উঠে বসেছে রবিন।
মালাটা মুসার হাতে ধরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। চলে এল মরা হাঙরটার কাছে। চামড়া ছিলতে শুরু করল। আর খামিক পরেই উঠবে মারাত্মক রোদ, তার আগেই যদি একটা ছাউনির ব্যবস্থা করা যায়, বেঁচে যাবে।
মালার তলায় জমা পানিটুকুর দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। মুখ বাড়িয়ে রবিনও দেখল। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল দুজনের। ওই দুই চুমুক পানিই এখন ওদের কাছে লক্ষ টাকার চেয়ে দামি। মুসা ভাবছে কুমালোর কথা, রবিনও।
গোঙাচ্ছে কুমালো। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। রোদ ওঠার আগেই যদি এই অবস্থা হয়, উঠলে পরে কি হবে? পানি খেল না মুসা। রবিনের দিকে বাড়িয়ে ধরল। মাথা নাড়ল রবিন। হাসল দুজনেই। কুমালোর মাথাটা উঁচু করে বাকি পানিটুকু তার মুখে ঢেলে দিল মুসা।
কিশোরকে সাহায্য করতে চলল দুই সহকারী গোয়েন্দা।
চামড়া পুরোপুরি ছাড়ার আগেই উঠল লাল সূর্য, দিগন্তে উঁকি দিয়েই যেন আগুন ছড়াতে শুরু করল।
চামড়া ছাড়ানো শেষ হল অবশেষে। বিশ ফুট লম্বা আট ফুট চওড়া বেশ চমৎকার একটা টুকরো। ভেতরের দিকে লেগে থাকা মাংসের টুকরোগুলো সযতে, সাফ করে ফেলল ওরা। চামড়াটা টান টান করে মাটিতে বিছিয়ে দেখল কাজ কেমন হয়েছে।
ভাল বুদ্ধি বের করেছিলে, রবিন, কিশোর বলল।
ঘর তো বানায় বললে মাছের চামড়া দিয়ে, মুসা বলল রবিনকে। কি করে বানায়? সাইবেরিয়ায় বললে, না?
হ্যাঁ। মাছ-তাতার বলে ওদেরকে। মাছ খায়, মাছের চামড়া দিয়ে জুতা আর পোশাক বানায়, ঘর বানায়। মাটিতে খুঁটি গেড়ে তার ওপর চামড়া ছড়িয়ে দেয়। যদি দেখতে যাও, বহুদূর থেকেই ওদের গ্রামের গন্ধ নাকে আসবে তোমার।
জানি, কি বলতে চাইছ, নাক কুঁচকাল মুসা।
হাঙরের চামড়ার অবশ্য এতটা গন্ধ বেরোবে না, কিশোর বলল। রোদে শুকিয়ে যাবার পর। তবে মাছটার গন্ধ আর সইতে পারছি না। এটাকে গড়িয়ে নামিয়ে দিতে পারলে হয়। জোয়ারে ভেসে চলে যাবে।
প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর ভারি লাশটাকে পানির কিনারে নিয়ে যেতে পারল ওরা।
মাংসের পাহাড়, পচা দেহটার দিকে তাকিয়ে বলল মুসা।
অথচ এমনি কপাল আমাদের, একটা টুকরো মুখে দিতে পারব না।
বেশি পচে গেছে, কিশোর বলল। খেলে পেটে অসুখ করে মরবে।
সুতরাং, সাগরের নাস্তার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে বিষাক্ত খাবারের দিকে পিঠ ফেরাল ওরা। হাঙরের চামড়াটা টানতে টানতে নিয়ে ফিরে এল ক্যাম্পে।
ঘর বানানয় মনোযোগ দিল ওরা। কি করে বানানো যায়? পেরেক নেই, বল্ট নেই, স্কু নেই, নেই কড়িকাঠ, তক্তা, খুঁটি। ঘর বানাতে যা যা জিনিস প্রয়োজন, তার কোনটাই নেই।
শুধু আছে একটা চামড়া, মুসা বলল। চালা বানানো যাবে। দেয়াল হবে কি দিয়ে? পাথর জড়ো করব?
প্রথমে দরকার লগি, বলল কিশোর। আর গোটা দুই খুঁটি। ওই নারকেলের কাণ্ডটা দিয়ে লগির কাজ চলবে।
আরেকটা কাণ্ড কেটেই তো দুটো খুঁটি বানানো যাবে, রবিন বলল। কিংবা আরও এক কাজ করা যায়। নারকেলের অনেক কাণ্ড দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি দুটোকে পালা হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।
নারকেল কাণ্ডের অভাব নেই। আট ফুট উঁচু দুটো কাণ্ড বেছে নিল ওরা, একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব বারো ফুট। ছুরি দিয়ে ওগুলোর মাথায় গভীর খাঁজ কাটল। তার পর ফেঁড়ে যাওয়া আরেকটা কাণ্ডকে কেটে এনে তুলে দিল ওই দুটোর ওপর, কড়িকাঠ হয়ে গেল।
বাবা, দারুণ চালা, মুসা বলল। তাবু হয়ে গেল একেবারে।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল রবিন। অনেক পলিনেশিয়ানই এরকম কুঁড়েতে থাকে। দ্বীপে থাকার সময় জাপানীরাও হরদম বানাত।
কড়িকাঠের ওপর চামড়াটা ঝুলিয়ে দিল ওরা, দড়িতে চাদর ঝোলানর মত করে। দশ ফুট করে হল একেকদিকে। এরপর দেয়াল তৈরির পালা। প্রবালের চ্যাপ্টা টুকরো এনে একটার ওপর আরেকটা রেখে দুই পাশে চার ফুট উঁচু দুটো দেয়াল তুলল। চামড়ার দুই প্রান্ত বিছিয়ে দিল ওগুলোর ওপর। তার ওপর আরও পাথর রেখে আটকে দিল, যাতে ছুটতে না পারে। ব্যস, হয়ে গেল ঢালু ছাউনি। রোদ তো আটকাবেই, বৃষ্টি হলেও গড়িয়ে পড়ে যাবে ঢাল বেয়ে।
পাথর দিয়ে অন্য দুপাশের দেয়ালও তুলে দিল ওরা। চারটে বড় বড় ফোকর রাখল, ওগুলো দরজা।
শেষ হল ঘর তৈরি। এমন কুঁড়ে আর কেউ কখনও দেখেছে কিনা সন্দেহ। মুসার দৃঢ় বিশ্বাস, মাছ-তাতারেরাও দেখেনি এই জিনিস।
কুমালোকে ঘরের ভেতর নিয়ে আসা হল। শোয়ানো হল প্রবালের মেঝেতে সব চেয়ে কম খসখসে জায়গায়। নিঃশ্বাস ফেলা দেখেই বোঝা গেল অন্ধকার। ঠাণ্ডায় এসে আরাম লাগছে তার। তিন ফুট চওড়া প্রবালের দেয়াল পুরোপুরি ঠেকিয়ে দিয়েছে রোদ। চালাটাও চমৎকার, অন্তত নারকেল পাতার ছাউনি আর ক্যানভাসের চেয়ে ভাল। কুঁড়ে কিছুটা নিচু হয়ে গেল, তবে একদিক দিয়ে সেটা বরং ভালই, ঝড়ের সময় বাতাসে উড়িয়ে নেয়ার সম্ভাবনা কম।
লম্বা হয়েছে যথেষ্ট। চারজনের জন্যে বেশ বড়। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে হবে না।
বৃষ্টির দিনে রান্নাও করতে পারব এর ভেতর, কিশোর বলল।
যদি বৃষ্টি হয়, বলল মুসা। রান্না করার মত কিছু পাওয়া যায়। আর যদি আগুন জ্বালাতে পারি।
ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। এইসব যদির সমাধান করতে হবে আমাদের। বৃষ্টি ঝরাতে পারব না, কাজেই পানি জোগাড়ের অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। হয়ে যাবে। ভাবতে হবে আর কি। গুইজি লতা থেকে পানি পাওয়া যায়, কিন্তু এই দ্বীপে ওই গাছ নেই। ব্যারেল ক্যাকটাসে পানি পাওয়া যায়, এখানে তাও নেই।প্যানডানাসের খোঁজ করলে কেমন হয়? এখানকার মত খারাপ জায়গায়ও জন্মায় ওগুলো। পানি থাকে ওতে। চল, খুঁজে দেখি।