গুপ্তধনের কথা কিছু লেখেনি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মাথা নাড়ল রবিন। এমনকি ক্যাপ্টেনের কথা, বিপদের কথা, কিছুই না। শুধু বাড়ির ব্যাপারে। সব ভোঁতা।
কিন্তু কিশোরের কাছে ব্যাপারটা ভোতা লাগল না। বলল, দেখ, জার্নালটা বাক্সের দেয়ালে লুকানো পেয়েছি। মোটা এক পরত তক্তার ওপর পাতলা আরেক পরত লাগিয়ে তৈরি দেয়াল, মাঝখানটা ফাঁপা, তার মধ্যে ছিল। ভেতরটা শুকনো রাখার জন্যেই হয়ত ওরকম করে বানিয়েছিল, যাতে পানি ঢুকতে না পারে। প্রথমে বুঝতে পারিনি। বাক্সটা ধরে যখন জোরে ঝাঁকালাম, ভেতরে শুনলাম মৃদু আওয়াজ।
তখন আরও ভালমত দেখলাম। চোখে পড়ল আলগা কাঠ। ভেতরের দেয়াল একরকম, আর বাইরেরটা আরেক। তবে রঙ, কাঠের দাগে তফাৎ খুব সামান্য। ভাল করে না দেখলে চোখেই পড়ে না। ধ্রু-ড্রাইভার দিয়ে খুঁচিয়ে চলটা তুলে ফেললাম। তারপর পাতলা কাঠটা ফাঁক করে ফেলতে অসুবিধে হয়নি। কোটের একটা হ্যাঙার দিয়ে টেনে বের করেছি অয়েলস্কিনে মোড়া জার্নালটা।
নিশ্চয়ই কেউ লুকিয়েছিল? মুসা বলল।
মনে হয় না। দেয়ালের ওপরের দিকটা ফাঁক হয়ে গিয়েছিল হয়ত। তখন কোনভাবে জার্নালটা পড়েছে ভেতরে। নেহাত কাকতালীয় ঘটনা। তারপর আবার দেয়ালটা মেরামত করে ফেলা হয়েছে। যে করেছে, সে খেয়ালই করেনি ভেতরে একটা জিনিস রয়েছে।
কিন্তু টিক বানাউ ঠিকই আন্দাজ করেছে, ওটা ভেতরে আছে, মুসা বলল। জার্নালটা চায় সে। কেন?
রবিন, পয়লা পৃষ্ঠাটা পড,কাগজগুলো বাড়িয়ে দিল কিশোর।
বেঞ্চে রাখা আলোর কাছাকাছি পাতাগুলো নিয়ে গেল রবিন। জোরে জোরে পড়ল, বাওরাড ডাই, ফ্যানটম লেক, ক্যালিফোর্নিয়া, অক্টোবর ২৯, ১৮৯৬!
…কিশোর, ওই জার্নালটাও এই লোকই লিখেছে- যেটা পড়ে এলাম, লিটল মারমেইডের বেঁচে যাওয়া নাবিক।
ওই জার্নালের শেষ তারিখটা মনে আছে? কোন তারিখে শেষ করেছে?
এটা ঊনত্রিশে শুরু, ওটা শেষ হয়েছে আটাশ তারিখে। তারমানে ওটার পরের অংশ এটা।
এটাতে হয়ত গুপ্তধনের কথা লেখা আছে! তুড়ি বাজাল মুসা।
মাথা নাড়ল কিশোর। না; সে-রকম কিছু দেখলাম না। রবিন যেটা পড়ে এসেছে, ও-রকমই। কোথায় কোথায় গিয়েছিল ডাই, কি কি করেছে। ব্যস, এসব।
তাহলে টিক চাইছে কেন? আবার প্রশ্ন করল মুসা। সে-ও কি গুজবের পিছেই ছুটছে?
এই জার্নালই যে চাইছে, শিওর হচ্ছি কি করে? রবিন প্রশ্ন তুলল।
জবাব দিল না কিশোর। খানিক পরে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, রবিন, তুমি বললে, ডাই পরিবার এই কিছুদিন আগে জার্নালটা হিসটোরিক্যাল সোসাইটিকে দান করেছে?
হ্যাঁ।…তারমানে…
তারমানে কাছাকাছিই কোথাও বাস করছে ওরা। বাক্যটা শেষ করে দিল কিশোর। এস।
দুই সুড়ঙ্গে ঢুকল কিশোর। পেছনে রবিন আর মুসা।
ট্রাপচার তুলে হেডকোয়ার্টারে ঢুকল ওরা। ডেস্কে বসে টেলিফোন বুক খুলল কিশোর। এই যে, পাওয়া গেছে। মিসেস বাওরাড ডাই, চার, ফ্যান্টম লেক রোড। মুসা, ম্যাপটা, জলদি।
বিশাল ম্যাপটায় চোখ বোলাচ্ছে কিশোর। জার্নালটার জন্যে নতুন একটা খাপ বানাচ্ছে রবিন।
অবশেষে মুখ তুলল গোয়েন্দাপ্রধান। এই যে। মাইল তিনেক পুবে, পর্বতের ভেতরে, হাসল সে। কাল সাইকেল নিয়ে বেড়াতে যাব। দেখা করে আসব মিসেস ডাইয়ের সঙ্গে।
৫
সুন্দর দিন। আবহাওয়া ঠাণ্ডা। কিন্তু সাইকেল চালিয়ে পর্বতের পাশের রাস্তায় যখন পৌঁছল তিন গোয়েন্দা। তেতে উঠেছে সূর্য।
ওই যে,। কপালের ঘাম মুছল মুসা। ফ্যান্টম লেক রোড। দেখ, সোজা পর্বতের ভেতরে ঢুকে গেছে।
আর কি খাড়া, গুঙিয়ে উঠল কিশোর চালাতে তো পারবই না, ঠেলে নিতে হবে সাইকেল। চল, কি আর করা যাবে।
ঠেলে নিয়ে উঠতে লাগল ছেলেরা। লম্বা গাছপালার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে পাহাড়ী পথ। পথের ধারে একটা খাড়ি,
ঝাপঝাড়ে বোঝাই, আশপাশে শুকনো, রুক্ষ মরূদ্যান।
এই নাম পেল কোথায়? ধূসর পর্বতের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন। ফ্যান্টম লেক। অবাকই লাগছে। এখানকার পর্বতের মাঝে হ্রদ আছে বলে তো কখনও শুনিনি!
ভ্রূকুটি করল কিশোর। হ্যাঁ। অবাক করার মতই।
ওদিকে কয়েকটা পুকুর দেখা যাচ্ছে, মুসা বলল।
আছে। কিন্তু ওগুলোর একটার নামও ফ্যান্টম লেক নয়, বলল রবিন। আমি…।
ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। সামনে, ওপর থেকে ফ্যান্টম লেক রোড ধরে নেমে আসছে গাড়িটা। মোড় নেয়ার সময় তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ জানাচ্ছে টায়ার, শোনা যাচ্ছে, গাড়ি চোখে পড়ছে না এখনও। দেখা গেল অবশেষে। ছুটে আসছে ওদের দিকেই।
আরি! সবুজ ফোক্সওয়াগেন! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
টিক বানাউ! বলল রবিন।
লুকাতে হবে! কিশোর বলে উঠল। কুইক!
সাইকেল তিনটে পথের পাশে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে হুড়মুড় করে ঝোপে ঢুকে পড়ল ওরা। পাশ দিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে গেল গাড়িটা, কয়েক গজ এগিয়েই ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। এক ঝটকায় দরজা খুলে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে ছুটে এল চালক। এই, এই ছেলেরা, থাম!
লোকটা টিক বানাউ নয়। রোগাটে এক যুবক, পুরু গোঁফ, কালো উদাসী চুল। পরনে কালো পোশাক। এই, কি হচ্ছে? আবার চিৎকার করে বলল সে। কি করছ ওখানে…?
পিছিয়ে গেল ছেলেরা। দৌড় দাও! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
পথের ধার দিয়ে ছুটতে শুরু করল ওরা। পেছনে আবার চিৎকার ব পিছু নিল লোকটা।
সামনে একটা ঘন ঝোপ, পথের পাশে। আর কোন উপায় না দেখে তাতেই ঢুকে পড়ল ছেলেরা।