আমি জানি, লিটল মারমেইড একটা স্কয়ার-রিগার জাতের বড়সড় জাহাজ, রবিন বলল। আঠারশো চুরানব্বইয়ে ডুবেছিল রকি বীচের কাছে। গুজব আছে, গুপ্তধন পাওয়া যাবে জাহাজটাতে। ঠিক?
হাসলেন প্রফেসর। আগের দিনে যত জাহাজ ডুবেছে, খোঁজ করলে জানবে, সবগুলোতেই গুপ্তধন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, মানে গুজব রয়েছে। তবে সময়টা ঠিকই জান। রবিনের পাশের চেয়ারে বসলেন তিনি। তিন মাস্তুলের জাহাজ লিটল মারমেইড। স্কটল্যাণ্ডের গ্লাসগো থেকে ঈস্ট ইণ্ডিজে গিয়ে মশলা আর টিনের ব্যবসা করত। ব্যবসার জন্যেই এসেছিল স্যান ফ্রান্সিসকোয়। তারপর দক্ষিণে কেপ হর্নের দিকে রওনা হয়, সেখান থেকে স্কটল্যাণ্ডে ফিরে যেত। যাওয়া আর হল না, ঝড়ের কবলে পড়ল। আঠারশো চুরানব্বইর ডিসেম্বরে রাতের বেলা তীরের কাছাকাছি প্রবালপ্রাচীরে ধাক্কা খেল ওটা।
ভয়ানক ঝড় বইছিল। বেঁচেছিল হাতে গোনা কয়েকজন। নাবিকেরা জাহাজ থেকে নেমে নৌকায় করে তীরে ওঠার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। বেঁচেছে তারাই, যারা জাহাজ থেকে নামেনি, কিংবা নামতে পারেনি। ধাক্কা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডুবে যায়নি জাহাজটা, টিকেছিল ভোর পর্যন্ত। ডোবার আগে পর্যন্ত ওটাতে ছিল ক্যাপ্টেন।
গুপ্তধন ছিল না?
আমার সন্দেহ আছে। অল্প পানিতে ডুবেছে জাহাজটা। ডুবুরিরা বহুবার খুঁজেছে ওটাতে। একশো বছরের মধ্যে অনেকবার। এখনও মাঝেসাঝে কেউ কেউ গিয়ে খোঁজ করে। সে আমলের কয়েকটা মুদ্রা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি ওটাতে। মাথা নাড়লেন প্রফেসর। না, ইয়াং ম্যান, লিটল মারমেইডে গুপ্তধন নেই। তবে গুজবটা সম্ভবত ছড়িয়েছে তার পরের আরেকটা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
আরেকটা! তাড়াতাড়ি ঘুরে বসল রবিন, প্রফেসরের দিকে মুখ করে।
রকি বীচের কাছেই বাস করছিল লিটল মারমেইডের বেঁচে যাওয়া একজন স্কটিশ নাবিক বাওরাড ডাই। আঠারশো ছিয়ানব্বই সালে চারজন লোকের হাতে খুন হয় সে। পসি করে খোঁজা হয় ওই চারজনকে। তারাও মারা পড়ে পসিদের হাতে, মুখ খোলার আগেই। ফলে জানা যায়নি, ডাইকে কেন খুন করেছিল ওরা। চারজনের একজন, লিটল মারমেইডের ক্যাপ্টেন। সে কারণেই লোকের সন্দেহ, কোন জিনিসের পেছনে লেগেছিল ক্যাপ্টেন, যা জাহাজ থেকে সরিয়ে ফেলেছিল ডাই। তারপর থেকে কতজন যে কতবার গিয়ে জাহাজটাতে খুঁজেছে। আশপাশের তীরভূমি, ডাইয়ের বাড়ি আর চারপাশের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে। কিছুই পায়নি।
অনেক নাবিকের মত, বাওরাড ডাইও জার্নাল রাখত। পরে, তার বংশধররাই সেই জার্নালটা আমাদের সোসাইটিকে দান করেছে, পুস্তিকাটা লেখার সময় কাজে লাগবে বলে। ওই জার্নাল, আঠারশো ছিয়ানব্বই সালে তৎকালীন শেরিফও পড়েছিল। বাইরের লোকে তো বটেই, ডাইয়ের বংশধরেরাও সন্দেহ করে, গুপ্তধন আছে। তারাও অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। পায়নি। জার্নালটাতে গুপ্তধনের কোন উল্লেখ নেই।
ভ্রূকুটি করল রবিন। আপনার কি মনে হয়, স্যার? ঈস্ট ইণ্ডিজ থেকে আনা কোন দামি জিনিস?
গুজব তো তাই বলে। জলদস্যুর সম্পদ। কেন? ও-ব্যাপারে তুমি কিছু জান নাকি?
ইয়ে, না, স্যার, আমতা আমতা করল রবিন। নিছক আগ্রহ। আই সী। হাসলেন প্রফেসর কেইন। কেন আগ্রহ, জানতে পারি?
আমরা….আমরা, স্যার….ওই স্কুলের ব্যাপার আরকি। বড়দিনের ছুটি তো। স্কুলের ম্যাগাজিনে গবেষণামূলক একটা লেখা লিখতে চাই।
ভাল, খুশি হলেন প্রফেসর। খুব ভাল। স্যার, জার্নাল আর পুস্তিকাটা দেখতে পারি? রিমলেস গ্লাসের ওপাশে হাসি ফুটল প্রফেসরের চোখের তারায়। স্কুলের ম্যাগাজিনের জন্যে, না? নিশ্চয়। দেখ, কিছু আবিষ্কার করতে পার কিনা। তাহলে পুস্তিকার নতুন সংস্করণে তোমার নামও উঠে যাবে।
হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর। ফিরে এলেন কয়েক মিনিট পর। সঙ্গে এসেছেন মিসেস ডেভিড। হাতে একটা পাতলা পাণ্ডুলিপি-লিটল মারমেইডের ওপর লেখা স্তিকার, আর অয়েলস্কিনে বাঁধানো একটা নোটবুক নিয়ে পড়তে আরম্ভ করল রবিন।
সন্ধ্যার একটু আগে সাইকেল চালিয়ে ফিরে এল স্যালভিজ ইয়ার্ডে। পেছন দিকে বেড়ার পঞ্চাশ ফুট দূরে সাইকেল থেকে নামল। উনিশশো ছয় সালে স্যান ফ্রান্সিসকোতে এক মহাঅগ্নিকাণ্ডের ছবি আঁকা রয়েছে বেড়ার গায়ে। দাউ দাউ করে বাড়ি জ্বলছে। সেদিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বসে আছে একটা কুকুর। এগিয়ে এসে কুকুরের একমাত্র চোখে টিপ দিল সে। বেরিয়ে পড়ল একটা ছোট ফোকর। তার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে লেভার চাপতেই সরে গেল বেড়ার তিনটে তক্তা। তিন গোয়েন্দার এই গোপন প্রবেশ পথের নাম লাল কুকুর চার। সাইকেল নিয়ে ভেতরে ঢুকল রবিন।
জঞ্জালের তলা দিয়ে গেছে পথ। হামাগুড়ি দিয়ে সেই পথ ধরে গেলে ট্রেলারে ঢোকা যায়। হেডকোয়ার্টারে ঢোকার আগে ওয়ার্কশপটা দেখার সিদ্ধান্ত নিল সে। কিছুদূর এগিয়ে দেখল মেইন গেট দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ইয়ার্ডে ঢুকছে মুসা আমান।
সারাটা বিকেল খাঁটিয়ে মেরেছে আমাকে! রবিনকে দেখে প্রায় গুঙিয়ে উঠল মুসা। ছুটি, হ্যাঁহ! এরচে স্কুলই ভাল ছিল।
আউটডোর ওয়ার্কশপে এসে ঢুকল দুজনে। ওখানে পাওয়া গেল কিশোরকে। ওয়ার্কবেঞ্চের ওপর একটা বাতি রেখে বাক্সটা পরীক্ষা করছে। হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে কি জেনেছে রবিন, বলার জন্যে মুখ খুলতেই হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিল গোয়েন্দাপ্রধান। এক মিনিট। উত্তেজিত কণ্ঠ। আবার দেখলাম বাক্সটা। কি পেয়েছি, দেখ।