আর কতক্ষণ লাগবে, কিশোর? শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল এড।
ঘন্টা দুই। তবে ততক্ষণ থাকতে হবে না আমাদের। কেউ না কেউ এসে যাবেই।
কে আসবে? ডাকই তো কেউ শুনল না আমাদের।
আসবে। বোরিস। আমাদের না দেখলেই খোঁজা শুরু করবে।
কিন্তু আমরা এখানে আছি কি করে জানবে? কল্পনাই করবে না বার্জের মধ্যে ঢুকে বসে আছি।
আবার চেঁচাব। কেউ না কেউ শুনবেই।
হ্যাঁ, আর শুনেছে!
কিন্তু আর চেঁচানোর দরকার হল না। ডেকের ওপর ভারি জুতোর শব্দ।
কিশোর, ডাকব নাকি?
শ্শ্শ্! ঠোঁটে আঙুল রাখল কিশোর। শত্রু না মিত্র জানি না। আসুক আগে।
প্রায় দম বন্ধ করে কান পেতে রইল ওরা। সাবধানে ভাঙা হ্যাচের দিকে এগিয়ে আসছে পদশব্দ। থেমে গেল। দীর্ঘ নীরবতার পর ডাক শোনা গেল, কিশোর? এইই কিশোর? এজ?
বোরিস!
বোরিসভাই! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল কিশোর। আমরা এখানে।
তাড়াতাড়ি ফোকরের নিচে চলে এল দুজনে।
ওখান থেকে বের করুন আমাদের, এড বলল। জলদি। পানি ভরে যাচ্ছে।
দাঁড়াও। আসছি।
ডেকের ওপর দিয়ে আবার কিনারে চলে গেল পদশব্দ। কাঠ ভাঙার আওয়াজ শোনা গেল। খানিক পরেই ফিরে এল বোরিস, বার্জের কিনারে লাগানো মইটা খুলে নিয়ে এসেছে। ফোকর দিয়ে খোলে নামিয়ে দিল ওটা।
ডেকে বেরিয়ে এল দুজনে।
কত জায়গায় যে খুঁজলাম তোমাদের, বোরিস বলল। আমাকে না জানিয়ে এলে কেন?
কিশোর জিজ্ঞেস করল, আমাদের খুঁজে পেলেন কি করে?
রাস্তায় দেখলাম, আইসক্রীমের দোকানে দেখলাম, কোথাও পেলাম না। শ্যাগুলারের দোকানে ফিরে যাচ্ছি, এই সময় একটা ছেলে বলল বার্জে উঠতে দেখেছে তোমাদের। চলে এলাম।
একটা ছেলে দেখেছে আমাদের? ভুরু কোঁচকাল কিশোর।
সে আমাদের সাহায্য করল না কেন তাহলে? এউ বলল।
হ্যাঁ, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। ছেলেটা কোথায় এখন?
চলে গেছে। আমাকে বাৰ্জটা দেখিয়ে দিয়েই দৌড়ে চলে গেল। ওহহো, ভুলেই গেছি, মিস্টার ডাইক তাঁর বাবার সঙ্গেও কথা বলেছেন। বুড়ো থুরথুরে, এখনও বেঁচে আছেন দ্রলোক। বাওরাড ডাই কি কিনেছিল, তিনিও কিছু বলতে পারলেন না। তবে একটা সূত্র দিয়েছেন।
কী? আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বললেন, তখন যত জিনিস বিক্রি করত ডাইক কোম্পানি, পিতলের প্লেটে নিজেদের নাম খোদাই করে লাগিয়ে দিত জিনিসের ওপর।
কিশোর, এড বলল। চল, বাড়ি গিয়ে খোঁজা শুরু করি।
হ্যাঁ, জলদি করা দরকার, জরুরি কণ্ঠে বলল কিশোর। ভুলেই গেছিলাম, রবিন আর মুসা কোথায় গেছে জানে নোবল! বিপদে পড়বে ওরা!
লজের ঘরে ঘরে ক্রিস্টমাস লাইট জ্বলছে। ড্রাইভওয়েতে ট্রাক রাখল বোরিস। এক লাফে নেমে বাড়ির দিকে দৌড় দিল কিশোর আর এড। পিছে পিছে এল বোরিস। অনেক দেরি হয়ে গেছে, রাশেদ পাশাকে ফোন করে জানাবে ওরা ভাল আছে।
লিভিংরুমে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস ডাই। ফায়ারপ্লেসে গনগন করে জ্বলছে। আগুন।
মাআ! আমাদের বাড়িতে এমন কিছু আছে, যার ওপরে পেতলের প্লেটে লেখা ডাইক অ্যাণ্ড সনস? সান্তা বারবারায় যা যা জেনে এসেছে সব মাকে জানাল এড।
ও, বাওরাড কি কিনেছেন জানতে পারনি তাহলে? ভূরু ডললেন মিসেস ডাই। পেতলের প্লেট? পুরানো অনেক জিনিসেই তো ওরকম প্লেট লাগানো আছে। তখন ওটাই চল ছিল। কিন্তু কোনটাতে ডাইক কোম্পানির নাম আছে বলে তো মনে পড়ছে না।
ভাল করে ভেবে দেখ, মা।
রবিনরা ফেরেনি? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
ফিরেছিল। আমাকে বলেছে, ড্যানিয়েলদের ওখান থেকে এক টন পাথর – কিনেছিলেন বাওরাড। কি পাথর, কি সাইজ, দেখতে কেমন, বলতে পারেনি। তাই ডিনোর সঙ্গে ড্যানিয়েলদের পুরানো আড়তে গেছে, ওখানকার অফিসে, রেকর্ড দেখতে। কিন্তু গেছে তো অনেকক্ষণ…।
এখনও ফেরেনি? এ্যাণ্ডফাদার ক্লকটার দিকে তাকাল কিশোর। প্রায় সাতটা বাজে।
না। ডিনোও তো ফিরল না…।
বিচিত্র একটা শব্দ হল। বাড়ির পেছনে দূরে কোথাও। ফোন শেষ করে সবে ঢুকছিল বোরিস, শুনে সে-ও থমকে গেল।
তখন থেকেই শুনছি, মিসেস ডাই বললেন। এক ঘন্টা ধরে, মাঝে মাঝেই। কিসের শব্দ?
দেয়াল ভাঙছে মনে হয় কেউ, বোরিস বলল। দেয়াল?
আমাদের কাছাকাছি তো কেউ থাকে না। তবে ওদিকে…
ওদিকে কি? এড বলল। ওদিকে তো কোন দেয়াল নেই।
দেখনি হয়ত। ওদিকে একটা স্মোকহাউস আছে। বহুদিন ব্যবহার হয় না, তোমার বাবা যখন ছোট, তখন থেকেই। বলতে ভুলে গেছি…।
স্মোকহাউস? কিশোর বলল। পাথরের স্মোকহাউস?
হতে পারে। আমিও ভালমত দেখিনি। দূর থেকে দেখেছিলাম, লতা, গাছগাছড়ায় ঢেকে ফেলেছে।
বোরিসভাই, ট্রাক থেকে লণ্ঠনটা নিয়ে আসুন, কুইক।
বৈদ্যুতিক লণ্ঠনটা নিয়ে এল বোরিস। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন মিসেস ডাই। পথ আর নেই এখন, জঙ্গল আর আগাছার রাজত্ব। কনকনে ঠাণ্ডা পড়েছে।
আধমাইল মত গিয়ে একটা কাঠের কুঁড়ে দেখা গেল। ওটার পাশ দিয়ে চলতে চলতে মিসেস ডাই বললেন, বাওরাডের আমলে মজুরদের ঘর ছিল এটা।
স্মোকহাউসটাও কি বাওরাডই বানিয়েছিলেন? কিশোর জানতে চাইল।
জানি না, অন্ধকারে একদিকে হাত তুলে দেখালেন মিসেস ডাই। ওখানেই কোথাও আছে।
বাড়ি মারার শব্দ থেমে গেছে। রাস্তা থেকে ঘন ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে এগোল ওরা। ভাঙা ডাল, দোমড়ানো পাতা, ছেড়া তা বুঝিয়ে দিচ্ছে এখান দিয়ে গিয়েছে কেউ। শোকহাউসটা দেখা গেল। হাউস মানে ধসে পড়া পাথরের স্তূপ।