না, থোকা, টিক বলল। অনেক পুরানো বাক্স এটা। আমার হাতে পড়ার আগে কম করে হলেও পঞ্চাশ জনের হাত ঘুরে এসেছে। সিঙ্গাপুরে যখন বাক্সটা কিনলাম, তখনই ওই নাম দেখেছি।
ব্যানার জানালেন, গতকাল পেয়েছি এটা, মিসেস পাশা। মরিস ডিলম্যানকে বলে রেখেছিলাম, মিউজিয়মে রাখার মত জিনিস পেলেই যেন পাঠায়। পাঠিয়ে দিয়েছে। ব্যবসা যে ছেড়ে দিচ্ছি, একথা আর জানানো হয়নি ওকে।
ন্যায্য দাম দিতে রাজি আছি আমি, টিক বানাউ বলল।
বেশ, বললেন মেরিচাচী। ধরে নিলাম, জিনিসটা আপনার। মিস্টার ব্যানার কিনেছেন, তারপর আমার কাছে।
কথা শেষ করতে পারলেন না এবারেও।
বিচিত্র খড়খড় শব্দ হল।
কী…? বলতে গিয়ে থেমে গেল রবিন।
কট করে আরেকটা শব্দ হয়েছে।
ঝিক করে উঠল জিনিসটা। ডালার ওপর ঝুঁকে ছিল কিশোর, তার কানের পাশ দিয়ে শাঁ করে গিয়ে দেয়ালে বিধল একটা ছুরি।
২
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত পাথর হয়ে রইল যেন সবাই। দেয়ালে থিরথির করে কাঁপছে। ছুরির হাতল।
কিশোরের কাছে ছুটে গেলেন মেরিচাচী। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রায় ককিয়ে উঠলেন, এই, লাগেনি তো কোথাও! কিশোর?
মাথা নাড়ল কিশোর। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না যেন, ধপ করে গিয়ে বসে পড়ল একটা পুরানো বেঞ্চে। বড় বাঁচা বেঁচেছে। অল্পের জন্যে চোখে লাগেনি ছুরিটা।
কে ছুঁড়ল? পাগলের মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন ব্যানার।
আ-আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন? এক পা পিছিয়ে গেল টিক।
কে-কে-কেউ ছুঁড়েনি! তোতলাতে শুরু করল রবিন। বাক্স থেকে বেরিয়েছে।
কাছে এসে ভেতরে তাকালেন ব্যানার। গড! ভেতরে গোপন খোপ খুলে গেছে! নিশ্চয় কোথাও হাত দিয়ে ফেলেছিলে, রবিনকে বলল। কোন গোপন সুইচ-টুইচে।…
হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়, বলল রবিন। গোপন খোপেই ছিল ছুরিটা। খোপের ঢাকনা খুলতেই স্প্রিং ছুটে গেছে। বুবি ট্র্যাপ!
খাইছে! মুসা বলল। খোপ যে খুলবে…।
শাসানোনার ভঙ্গিতে টিক বানাউয়ের দিকে এগোলেন মেরিচাচী। যদি এটা আপনার কাজ হয়ে থাকে…।
বুবি ট্রাপ কাকে বলে তা-ই জানি না আমি! আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল নাবিকের।
না, আপনি করেননি একাজ! কিশোর বলল। মুখে রঙ ফিরতে শুরু করেছে ওর। উঠে গিয়ে দেয়াল থেকে খুলে নিল ছুরিটা। প্রাচ্যের জিনিস এটা। যতদূর মনে হয়, পূর্ব ভারতীয়। বাজি রেখে বলতে পারি, শত বছর আগে ওই ফাঁদ পেতে রেখেছিল কোন জলদস্যু!
খাইছে!
জলদস্যু? রবিন বলল।
কিশোরের চোখ চকচক করছে। ছুরিটা নিয়ে বাক্সের কাছে ফিরে এল সে। গোপন খোপটা পরীক্ষা করতে লাগল। মাথা ঝাঁকাল সন্তুষ্ট হয়ে। বললাম না? স্প্রিং, হুড়কো, সব হাতে বানানো। মরচে পড়েছে। অনেক পুরানো। দামি জিনিস চোর-ডাকাতের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে এরকম ফাঁদ পাতা হত সেকালে। জাভা আর মালয়ের জলদস্যুরা এসব কাজে ওস্তাদ ছিল।
সবার চোখ ঘুরে গেল টিক বানাউয়ের দিকে।
না-না, তাড়াতাড়ি দুহাত নাড়ল পানির পোকা। আমি ওসব দেশের লোক নই। তবে জাভায় ছিলাম অনেকদিন। কোন জলদস্যুর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
গুঙিয়ে উঠল মুসা। জাভা জায়গাটা যে কোথায়, তা-ই আমি জানি না।
ইন্দোনেশিয়ার একটা বড় দ্বীপ, বলল কিশোর। কাছাকাছি আরও দ্বীপ আছে। সুমাত্রা, নিউ গিনি, বোর্নিও, সেলিবিস, এবং আরও হাজারও ছোট-বড় দ্বীপ। এখন ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন, কিন্তু আগে ওলন্দাজ কলোনি ছিল ওখানে। ছোট ছোট শত শত রাজ্য ছিল, ওগুলোকে বলা হত সালতানাত, শাসনকারীদের বলা হত সুলতান। বেশির ভাগই ডাকাত ছিল ওরা।
ব্ল্যাকবিয়ার্ডের মত? জানতে চাইল মুসা। পাল তোলা জাহাজ, ভারি কামান, কালো পতাকায় মানুষের খুলি আর হাড়ের ছবি…।
না, ঠিক ওরকম নয়। এসব ছিল পশ্চিমা জলদস্যদের নিশানা। ব্ল্যাকবিয়ার্ড ছিল ইংরেজ। ঈস্ট ইনডিয়ান জলদস্যুদের বড় জাহাজ ছিল না, জলি রজার পতাকা ছিল না, কামানও ছিল খুব কম। ছোট দ্বীপগুলোতে থাকত ওরা। ইউরোপিয়ান কিংবা আমেরিকান জাহাজ দেখলেই তেড়ে এসে চড়াও হত।
পশ্চিমা জাহাজগুলো তখন ওসব অঞ্চলে যেত মশলা, টিন, চা আর চীন থেকে সিল্ক আনার জন্যে। নানারকম চমকপ্রদ জিনিস নিয়ে য়েত ব্যবসা করার জন্যে, আর নিত ব্যাগভর্তি সোনা-রূপা। অস্ত্রশস্ত্রও নিত। সেসব ছিনিয়ে নেয়ার জন্যেই হামলা চালাত জলদস্যুরা। তবে সব সময়ই হেরে আসত না পশ্চিমারা। পাল্টা হামলা চালাত। অনেক সময় তো ঘরে ঢুকে গিয়ে শেষ করে দিয়ে আসত জলদস্যুদের।
তারমানে এদেশীরাও কম ডাকাত ছিল না, হেসে বলল রবিন। তো, তোমার কি ধারণা? ওই অঞ্চল থেকেই এসেছে এই বুবি ট্র্যাপ?
ধারণা নয়, আমি শিওর, চিন্তিত ভঙ্গিতে গাল চুলকাল কিশোর। শোনা, যায়, এখনও নাকি কিছু জলদস্যু আছে কোন কোন দ্বীপে।
কিশোর, দেখ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। বাক্সের ভেতর ছোট একটা জিনিস পেয়ে তুলে দেখাল, আঙটি! খোপটাতে ছিল।
আর কিছু আছে? রবিন জিজ্ঞেস করল।
ঠেলে মুসাকে সরিয়ে বাক্সের ওপর ঝুঁকল টিক। দেখি তো। ঘোড়ার ডিম আর কিছু নেই।
মুসার হাত থেকে আঙটিটা নিল কিশোর। নিখুঁত, সূক্ষ্ম খোদাই। সোনার হতে পারে, কিংবা তামার, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মাঝখানে লাল একটা পাথর বসানো।
খাঁটি, কিশোর? মুসা জানতে চাইল।
বুঝতে পারছি না। হতে পারে। খাঁটি সোনার অলঙ্কার যেমন পরত ওখানকার লোকে মেকিও পরত। সোনার রঙ করা, কিন্তু সোনা নয়। ওসব দিয়ে ইউরোপিয়ানরাই বেশি ঠকাত দেশী লোকদের।