এড এসেছে পশ্চিমধারে, পাহাড়ের গোড়ায়, দ্বীপের এই ধারটা বেশি উঁচু। বায়ে সাগরের ওপর কুয়াশা খুবই ঘন কুয়াশার একটা মেঘ ভেসে এসে ঘিরে ফেলল তাকে, ফলে মুসাকেও দেখতে পেল না আর। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে তার, বুক কাঁপছে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, কান খাড়া। সামনে কিছু দেখা যায় না। অন্ধের মত পা বাড়াতে গিয়ে পড়ে গেল সে। পাথরের ধস সৃষ্টি করে গড়িয়ে পড়তে লাগল ঢাল বেয়ে।
ব্যথা লাগতে আঁউক করে উঠল। বাড়ি লেগেছে কোন কিছুতে, পাথরেই হবে। উঠে বসল। এই সময় চোখে পড়ল ওটা।
ভূতুড়ে একটা মূর্তি, ঢালে দাঁড়িয়ে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কালো মূর্তি, পিঠে কুজ, ছুঁচালো কুৎসিত মুখ, বাঁকা নাক, বড় বড় চোখ।
ভূত! ভূত! চিৎকার করে উঠল এড়। বাঁচাও!
নড়ে উঠল ভূত। লম্বা হাত বাড়িয়ে দিল যেন এডকে ধরার জন্যে।
১১
দৌড়ে এল সবাই। চোখ বন্ধ করে চিৎকার করছে এড। ইতিমধ্যে পাতলা হয়ে গেছে কুয়াশা। রবিন বলল, ভূত দেখলে কোথায়? ওটা তো গাছ।
চোখ মেলল এড। সত্যিই। কুঁজো ভূতটা একটা বাঁকা সাইপ্রেস। ডালগুলো কাণ্ডের দুপাশে এমনভাবে বেঁকে আছে, যেন হাত। তার ওপরে অনেকখানি গায়েব, ছিঁড়ে নিয়ে গেছে ঝড়। কাণ্ডের ছেড়া, মোচড়ানো অংশটাকে মাথার মত দেখাচ্ছে, তাতে বড় একটা ছিদ্র-কুয়াশার কারণে মনে হয়েছিল, চোখ নড়ছে।
গাছ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এড। আমি ভেবেছি ভূত।
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কিশোর, ভূতই ওটা! বুঝতে পারছ না? বাওরাড ডাইয়ের চিহ্ন।
চিহ্ন? মুসা বুঝতে পারল না।
ঠিক বলেছ! কিশোরের মতই চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
রিমলেস গ্লাসের ওপাশে সরু হল প্রফেসরের চোখ। মাই গড, কিশোর, ঠিকই বলেছ তুমি! খোঁজ, খোঁজ সবাই। গাছের চারপাশে কোন জায়গা বাদ দেবে না। গুপ্তধন এখানে থাকতে পারে।
আমি বাঁয়ে দেখছি, এড বলল।
আমি ডানে, বলল রবিন।
কিশোর, তুমি গাছে ওঠ, প্রফেসর বললেন। আমি গোড়ায় দেখছি।
অদ্ভুত গাছটার কাছে এগিয়ে গেল সবাই, একা দাঁড়িয়ে আছে মুসা। একবার ডানে তাকাচ্ছে, একবার বাঁয়ে। তারপর ঘাড় ফেরাল পেছনে। এই, শোন, আস্তে বলল সে।
তার কথা বোধহয় কারও কানে, গেল না।
এই, শুনছ, আবার বলল সে। ওখানে পাওয়া যাবে না।
থমকে গেল কিশোর। কি বললে?
মাথা নাড়ল মুসা। ওই গাছটাকে চিহ্ন বানায়নি বাওরাড।
কি বলছ? ফিরে তাকালেন প্রফেসর। কেন…
ওই যে, হাত তুলে দেখাল মুসা। কিছুটা ডানে ঢালের গায়ে আরেকটা গাছ। ওটাকে তো আরও বড় ভূত মনে হচ্ছে আমার কাছে।
আর ওই যে, পেছনে আরেকটা গাছ দেখাল সে। ওটা ভূতের দাদা।
জোরে বাতাস বইছে। দ্রুত উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে কুয়াশা। একটা পাথর সরানোর জন্যে ঝুঁকেছিলেন প্রফেসর, গুঙিয়ে উঠে সোজা হলেন। হায় হায়, সবগুলোকেই তো ভূতের মত দেখাচ্ছে!
হ্যাঁ, মুসা ঠিকই বলেছে, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল কিশোর। এখানে কিছু পাব না। এগুলো ভূত-গাছ, কোনটাকে চিহ্ন ধরব? এরকম অনেক সাইপ্রেস আছে দ্বীপে। কুয়াশার মধ্যে বিশেষ অ্যাঙ্গেলে দাঁড়িয়ে দেখলে অসংখ্য ভূত দেখা যাবে।
আমরা হেরে গেলাম, বয়েজ, নিরাশায় জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন প্রফেসর।
যদি এই দ্বীপে গুপ্তধন, লুকানো থাকে, আশা ছাড়তে পারছে না, কিশোর। পাওয়ার আশা নেই। কিন্তু…
বাধা পড়ল কথায়। হঠাৎ গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ছোট বড় অনেক পাথর। ঝট করে ওপরে তাকাল সে। কুয়াশাকে ঝেটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস, অনেক দূরে দৃষ্টি চলে এখন। চূড়ার কাছে আরেকটা ভূতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
আরেকটা সাইপ্রেস, হেসে উঠল এড।
কিন্তু, নিচের ঠোঁটে টান দিয়ে ছেড়ে দিল কিশোর। সাইপ্রেস পাথর ফেলতে পারে না।
গাছ না, গাছ না! চিৎকার করে উঠলেন প্রফেসর। মানুষ! এই এই, থাম! থাম!
থামল না লোকটা। হারিয়ে গেল চূড়ার ওপাশে। ছুটন্ত পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
জলদি এস, ব্যাটাকে ধরতে হবে, বলেই দৌড় দিলেন প্রফেসর।
তার পেছনে ঢাল বেয়ে ছুটল ছেলেরা। চূড়ায় উঠে দেখলেন, দূরে দৌড়ে চলে যাচ্ছে মূর্তিটা, ডানে, খড়ির পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতলব।
নিশ্চয় বোট এনেছে, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন প্রফেসর। ধরতেই হবে।
সরাসরি গেলে পথ কিছুটা কম হয়, সোজা খাড়ির দিকে ছুটলেন তিনি। তাকে পাশ কাটাল মুসা, পেছনে এড। সবার আগে ঘড়ির কাছে পৌঁছল ওরা দুজন। কিন্তু লোকটাকে দেখা গেল না।
ওই যে, মুসা আর এডের পেছনে উঁচু জায়গায় থেকে বলল কিশোর। বায়ে। বায়ে।
ঘাঁড়ির উত্তরে একটা টিলার ওপাশে হারিয়ে যাচ্ছে মূর্তিটা। ছুটল মুসা আর এড। রবিন গেল। তার পেছনে প্রফেসর। সবার শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে চলেছে কিশোর।
টিলার কাছে আগে পৌঁছল রবিন আর প্রফেসর। তাদের পর পরই মুসা আর এড়। টিলার নিচে ছোট্ট, সরু এক টুকরো সৈকত। সেট ধরে দৌড়ে গিয়ে মোটরবোটে উঠল লোকটা। ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। সরে যেতে শুরু করল বোট। ফিরে তাকাল একবার সে।
সেই লোকটা! রবিন বলল। সবুজ ফোক্সওয়াগেনে করে এসেছিল।
কালো চুল, কালো গোফওয়ালা হালকা-পাতলা লোকটার দিকে চেয়ে আছেন প্রফেসর। চিনি ওকে! ওর নাম নোবল। এই, এই থাম।
কে শোনে কথা। গতি আরও বাড়িয়ে দ্বীপের কাছ থেকে সরে যেতে লাগল -কোর্ট।
শয়তান! গর্জে উঠলেন প্রফেসর। চল, চল, আমার বোটে। আবার খাড়ির কাছে দৌড়ে চলল ওরা।