রবিন আর মুসারও কানে এল বিচিত্র শব্দ। পানি পড়ছে, মেশিন চলছে, থেকে থেকেই বন্য কণ্ঠে হেসে উহছে কোন পাগল! গুলি ফোটার বিকট আওয়াজ হল বদ্ধ সুড়ঙ্গে, কানের পাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল যেন বুলেট, গুলির শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাল সুড়ঙ্গের ভেতর।
কি হল, কিশোর? ফিসফিসিয়ে বলল রবিন, জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে।
ঢোক গিলল কিশোর। বুঝতে পারছি না!…ঢুকলাম…গুলি করল আমাদেরকে…লোকটা…।
লোকটাকে দেখতে পেল মুসা আর রবিন।
সুড়ঙ্গের আবছা অন্ধকারে বিশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে। রাইফেলের নল ওদের দিকে ফেরানো। দাড়িওয়ালা এক খনি-শ্রমিক। গায়ে লাল উলের শার্ট। পরনে হরিণের চামড়ার প্যান্ট। পায়ে গোড়ালি ঢাকা উঁচু চামড়ার বুট।
চুরি করে যারা ঢোকে, তাদের কি করে তাড়াতে হয়, জানি আমরা! খসখসে গলায় বলল লোকটা। হেসে উঠল খলখল করে। হাতের রাইফেল উঁচু করে আবার ট্রিগার টিপল।
৮
প্রচণ্ড শব্দ।
আবার গুলি করল লোকটা।
ছাই হয়ে গেছে মুসার চেহারা। আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ককিয়ে উঠল, আমি…আমি কি..গুলি খেয়েছি?
চোখ মেলল সে। অন্যদের অবস্থাও কমবেশি তারই মত।
মিস করেছে! রবিন বলল।
আসলে…আসলে আমাদের ভয় দেখাতে চেয়েছে, বলল এড।
আবার বুনো হাসি হেসে উঠল লোকটা। রাইফেল তুলে হুমকি দিল, চুরি করে যারা ঢোকে, তাদের কি করে তাড়াতে হয়, জানি আমরা!
আবার টিপে দিল ট্রিগার। পর পর দুটো গুলির শব্দ কাঁপন তুলল সুড়ঙ্গের দেয়ালে।
এবারও মিস করেছে! চিৎকার করে বলল এড। সাহস করে লোকটার দিকে এক পা এগোল সে। কি ব্যাপার? আমাদের…
দাঁড়াও, এড, ডাকল কিশোর। ভালমত দেখ সবাই। কি বলে শোন।
লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। খনির ভেতর থেকে এখনও ভেসে আসছে পানি পড়া আর মেশিন চলার আওয়াজ। দীর্ঘ এক মিনিট পর কট করে মৃদু একটা শব্দের পরই খড়খড় করে উঠল কিছু, সঙ্গে সঙ্গে বন্য হাসি হেসে রাইফেল তুলল লোকটা। একঘেয়ে কণ্ঠে বলল, চুরি করে যারা ঢোকে, তাদের কি করে তাড়াতে হয়, জানি আমরা! টিপে দিল ট্রিগার। পর পর দুবার।
ওটা নকল মানুষ! বলেই হাসতে শুরু করল কিশোর। যান্ত্রিক পুতুল। ভেতরে রেকর্ড করা ক্যাসেট ভরা। নানারকম শব্দের ব্যবস্থাও করা হয়েছে ক্যাসেটের সাহায্যেই। কায়দা করে বিশেষ বিশেষ জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে স্পীকারগুলো।
হঠাৎ কপালে চাপড় মারল রবিন। হায় হায়রে, গাধা বানিয়ে ছেড়েছে। আমাদের! ইস আরও আগেই বোঝা উচিত ছিল। পেপারেই তো পড়েছি। পাউডার গালচের সংস্কার করে টুরিস্ট আকর্ষণের ব্যবস্থা করেছে। গড়ে তুলেছে পুরানো ওয়েস্টার্ন পরিবেশ। সেজন্যেই চারপাশে বেড়া, গেটে তালা।
হুঁ, তিক্তকণ্ঠে বলল কিশোর। ধোকা খেয়েছে বলে নিজের ওপরই বিরক্ত। আমিও পড়েছি। কিছুদিন আগে।
এগিয়ে গিয়ে পুতুলটার মুখে হাত বোলাল মুসা। স্টিক। আসল না নকল বোঝাই যায় না। স্যালুনের ভূতটাও নিশ্চয় পুতুল। খোদা, কি জিনিস বানায় ওরা আজকাল!
হ্যাঁ, ভালই বানায়। খালি কথা বললে হবে না, আরও কাজ আছে। কোন সূত্র-টুত্র পাওয়া গেছে? কাজে লাগার মত?
হিসেবের খাতাটার কথা জানাল রবিন। আর কি পরিমাণ খাবার কিনেছে বাওরাড ডাই।
একজনের জন্যেও কিনতে পারেন। শুনে কিশোর বলল, অনেক দিন কোথাও থেকে কিছু বানানোর দরকার হলে। একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে, নোরিয়াকে চমকে দেয়ার জন্যে যা বানিয়েছেন, বাওরাড, সেটা বড় রকমের কিছু। কিন্তু কি বানিয়েছেন, কোথায় বানিয়েছেন এখনও জানি না আমরা। পাতলা জার্নালটা খুলল সে। ঊনত্রিশে অক্টোবর এমন কিছু লেখা নেই, যাতে কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
স্যালুনে সূত্র খোঁজার সুযোগই পাইনি,মুসা বলল।
বেশ, তাহলে আবার যাব আমরা। জার্নাল বন্ধ করল কিশোর। তারপর জেলখানায়। শেরিফের ফেলে যাওয়া রেকর্ড থাকতেও পারে। শেষে টু মারব। পত্রিকা অফিসে।
ফিরে চলল ওরা। ঢোকার সময় তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি রবিন আর মুসা। এখন দেখল ভালমত। ঠেলাগাড়ি, নানারকমের যন্ত্রপাতি, আরও একটা পুতুল কালো দাড়িওয়ালা এক খনি-শ্রমিক, হাতে গাঁইতি।
বাহ্, চমৎকার, হেসে বলল মুসা। তখন এটা দেখলেও দৌড় পেতাম…।
হাত থেকে গাইতি ফেলে দিল দাড়িওয়ালা। লাফিয়ে কিশোরের কাছে গিয়ে একটানে তার হাত থেকে জার্নালটা নিয়ে দৌড় দিল। বেরিয়ে গেল সুড়ঙ্গ থেকে।
টিক বানাউ! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
এতই দ্রুত ঘটে গেছে ঘটনা, ক্ষণিকের জন্যে যেন পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল ওরা। রবিন চেঁচাতেই কিশোরও চিৎকার করে উঠল, নিয়ে গেল! ধর, ধর!
ম্লান আলোকিত সুড়ঙ্গ ধরে ছুটল ওরা। বেরিয়ে এল কড়া রোদে। ভীষণ গরম।
ওই যে ব্যাটা! হাত তুলে দেখাল এড।
পথের শেষ মাথায় চলে গেছে বেঁটে নাবিক, এখনও দৌড়াচ্ছে।
থাম! এইই, থাম, চোর কোথাকার! মুসা চেঁচাল।
আরে, থামছে না তো! বলল এড। এই, এইই, থাম!
ফিরে চেয়ে হাসল টিক। তারপর ছুটে গেল স্যালুনের দিকে। এই সময় দরজায় দেখা দিল একটা আবছা মূর্তি, দুই হাতে পিস্তল।
চমকে উঠল মুসা। সেই ভূতটা…।
মূর্তিটাকে টিকও দেখেছে। সে-ও চিৎকার করে উঠল। পরক্ষণেই মোড় নিয়ে আরেকদিকে দৌড়াতে গেল। ঘোড়াকে পানি খাওয়ানোর একটা পুরানো গামলায় পা বেঁধে পড়ে গেল হুমড়ি খেয়ে। হাত থেকে উড়ে চলে গেল জার্নালটা। হচড়েপাচড়ে কোনমতে উঠে দাঁড়াল সে।