আঠারশা নব্বই সালে ফুরিয়ে আসে খনি, কিশোর বলল। চলে যেতে শুরু করে লোকে। ততদিনে খাড়িও প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।
গুঙিয়ে উঠল মুসা। একশো বছর পর এখানে কি খুঁজতে এসেছি আমরা, কিশোর?
জানি না, সেকেণ্ড। তবে আমি শিওর, নোরিয়াকে এখানে এসেই খুঁজতে বলেছেন বাওরাড। হয়ত এক-আধটা খবরের কাগজও বের হত তখন এখানে। খুঁজলে কয়েক সংখ্যা পাওয়াও যেতে পারে।
বলা যায় না, খবরের কাগজের মর্গও থাকতে পারে, রবিন আশা করল।
মর্গের নামে চমকে উঠল মুসা। খাইছে! যে শহরে এসেছি, আমরাও না শেষে মর্গের বাসিন্দা হই!
তার কথা কানে তুলল না কিশোর। বলল, এস, যাই।
পুরানো শহরের পাশে এসে সাইকেল থামাল ওরা। তালা দেয়া বড় একটা ফটকের সামনে। উঁচু বেড়ায় ঘেরা পুরো শহরটা
বেড়া দেখছ! এড বলল। দেখ, ওই বিল্ডিঙের লেখাটাও নতুন। কেউ এসে বাস করতে আরম্ভ করেছে নাকি আবার?
কি জানি, গাল চুলকাল কিশোর।
মিনিটখানেক অপেক্ষা করল ছেলেরা, কান পেতে রইল। কিন্তু নীরব হয়ে রইল পাউডার গালচ।
বেড়া ডিঙিয়ে ঢুকতে হবে, অবশেষে বলল কিশোর।
সাইকেল রেখে, বেড়া বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। ওপাশে নেমে তাকাল ধুলো-ধূসরিত পথের দিকে।
রবিন, মুসা, কিশোর বলল। তোমরা বাঁয়ের বাড়িগুলোতে খুঁজবে। আমরা যাচ্ছি জেলখানা, আস্তাবল আর অন্য কয়েকটাবাড়ি খুঁজতে। খনির কাছে গিয়ে মিলিত হব। দেখা যাক, কিছু পাই কিনা।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানিয়ে জেনারেল স্টোরে গিয়ে ঢুকল রবিন আর মুসা। পা টিপে টিপে ঢুকে থামল। দুজনেই অবাক। একশো বছর আগে যেমন ছিল ঠিক তেমনই রয়েছে স্টোরটা। তাকে, তাকে মাল বোঝাই। ময়দা আর শুকনো আপেলের পিপা, লোহার নানারকম জিনিস-হাতুড়ি, বাটালি, করাত, শাবল, বেলচা, কুড়াল এসবই বেশি। চামড়ার জিন, আর আরও নানারকম জিনিস স্তূপ করে রাখা আছে মেঝেতে। দেয়ালে ঝোলানো পুরানো আমলের আগ্নেয়াস্ত্রগুলো। ম্লান আলোতেও চমকাচ্ছে। লম্বা কাউন্টারটা চকচকে পালিশ করা, পরিষ্কার।
কেউ থাকে এখানে! রবিন বলল।
কি-কিন্তু, তোতলাতে লাগল মুসা। নি-নিশ্চয় এ-যুগের কেউ নয়! জিনিসপত্র সব একশো বছর আগের মত…মানে, স্টোরটা এখন ভূতের দখলে! ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাল সে। যেন আশঙ্কা করছে, হ্যাল্লো, কেমন আছ? বলে এখুনি বেরিয়ে আসবে ভূত।
রবিনেরও গা ছমছম করছে। ঢোক গিলল। হ্যাঁ, স্টোরটা যখন খোলা থাকত, এরকম সাজানোই থাকত বোধহয়। যেন…যেন এখনও খোলা…পোড়ো নয়! মুসা, কাউন্টারে দেখছ, পুরানো ধরনের একটা হিসেবের খাতা এখনও রয়েছে, যেন বেচা-কেনা চলছে! :
খুব সাবধানে কাউন্টারের কাছে এসে দাঁড়াল দুজনে। খোলা পড়ে আছে খাতাটা। খদ্দেরের নাম লেখাঃ জিনিসের অর্ডার দিয়ে গেছে। অনেক দ্বিধা করে শেষে খাতাটায় আঙুল ছোঁয়াল রবিন। কাঁপা হাতে পাতা উল্টে চলল। নব্বইয়ের পরেও আরও কয়েক বছর টিকে ছিল এই শহর। ২৯ অক্টোবর, ১৮৯৬ সাল পাওয়া গেল। তার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখে জোরে জোরে পড়ল মুসা, বাওরাড ডাই, ফ্যান্টম লেক-সাপোর্ট সহ ২০০ বোর্ড-ফুট মুস টিম্বার, ২ পিপা ময়দা, ১ পিপা গরুর মাংস, ৪ বাক্স শুকনো সীমের বীচি। চোখ মিটমিট করল সে। খাইছে! কত লোকের জন্যে অর্ডার দিয়েছে?
অনেক লোক ভাড়া করেছিল নিশ্চয়। শ্রমিক। তাদের খাবার লাগবে না? আর কিছু চোখে পড়ছে, মুসা? মাথা নাড়ল মুসা। দেখছি না।
স্টোরের বাইরে বেরিয়ে হাঁপ ছাড়ল দুজনে। এরপর ঢুকল স্যালুনে।
আরি, এটা তো কমুনিটি সেন্টার ছিল মনে হচ্ছে, রবিন বলল। লোকে একে অন্যের সঙ্গে দেখা করত এখানে, মেসেজ রেখে যেত। নিশ্চয় এখানে ঢুকেছিল বাওরাড।
ঘরটা বড়, অন্ধকার। পেছনে একটা দরজা, শোবার ঘরে ঢোকার জন্যে। বা ধারে কারুকাজ করা একটা পিয়ানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চকচকে বারের ওপাশে সারি সারি মদের বোতল। পেছন দিকে গোল একটা টেবিলে কয়েকটা বোতল, গেলাসে ঢালা মদ, তাস ছড়িয়ে আছে, যেন এই খানিক আগে মদ খাওয়া আর তাস খেলা চলছিল।
এ-এটাও তো স্টোরের মতই, মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। যেন এইমাত্র ছিল খনির শ্রমিকেরা, হঠাৎ উঠে চলে গেছে।
কথা শেষ হল না তার। অনেকগুলো, কণ্ঠের মিলিত শব্দে ভরে উঠল ঘর। সীমান্ত এলাকার পুরানো গানের সুর বাজতে শুরু করল পিয়ানোতে। কিন্তু মানুষজন কাউকে চোখে পড়ল না। বোতল আর গেলাস ঠোকাঠুকির মৃদু টুংটাং পান করার শব্দ, মানুষের হুল্লোড় চলছে। পেছনে গোল টেবিলের কাছে জোরে শব্দ, আবছা একটা মূর্তি উঠে দাঁড়াল বলে মনে হল। চুপ! একচুল নড়বে না! ধমক শোনা গেল।
সামান্য স্পষ্ট হল আবছা মূর্তিটা। দেখা গেল, দুহাতে দুই পিস্তল।
ভূ-ভূত! চিৎকার করে উঠল মুসা। মেরে ফেলল রে, মেরে ফেলল! রবিন, দৌড় দাও!
দৌড়াতে গিয়ে একজন আরেকজনের ওপর এসে পড়ল। ওদের কাণ্ড দেখেই বুঝি পেছনে হো হো করে হেসে উঠল লোকেরা। বেজেই চলেছে পিয়ানো। বাইরে গরম। পরোয়াই করল না দুই গোয়েন্দা। ধুলোয় ঢাকা পথ ধরে ছুটল খনির দিকে।
খনির ভেতরে লম্বা সুড়ঙ্গটা আলোকিত। ঢালু শ্যাফট ধরে ছুটল ওরা। সামনে দেখা গেল কিশোর আর এডকে।
কিশোর! চেঁচিয়ে ডাকল মুসা। আরেকটু হলেই ভূতে…! এবারেও শেষ হল না তার কথা। দেখল, থমকে দাঁড়িয়ে গেছে কিশোর আর এড়। দৃষ্টি সামনে। কিছু একটা ওদেরকেও অবাক করেছে।