হ্যাঁ, কিশোর। আসল ডাই লজটা তৈরি হয়েছিল তেরশো বায়ান্ন সালে। তখন ওটার নাম ছিল ডাই ক্যাসল। চোর-ডাকাত আর বাইরের শত্রুর হামলার আশঙ্কা এত বেশি ছিল সেকালে, পয়সাওয়ালা লোকেরা দুর্গ ছাড়া থাকতে সাহস পেত না। নিরাপদ মনে করত না, এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে বললেন মহিলা, প্রথমে ডাই ক্যাসল ছিল শুধু একটা টাওয়ার হাউস। আস্তে আস্তে চারপাশে ঘর তৈরি হল, ঠিক এই বাড়িটার মত। সতেরশো সালের দিকে ওই টাওয়ারে অস্ত্র ধারী দারোয়ান বসানোর দিনে শেষ হয়ে এল। সে-সময় পেশা বদল করে নাবিক হল ডাইয়েরা। তখন টাওয়ারে উঠে সাগর দেখত তাদের স্ত্রীরা, জাহাজ দেখত, স্বামীদের জাহাজের ফেরার অপেক্ষা করত।
পুরানো দিনের এসব গল্প শুনতে শুনতে অধৈর্য হয়ে উঠল মুসা। বলল, চিঠির কথা কি যেন বলছিলেন?
উপত্যকাটা পছন্দ করে বাড়ি তৈরি করলেন বাওরাড ডাই। বানাতে প্রায় দুবছর লেগেছিল। তারপর ছেলে আর স্ত্রীকে আনতে লোক পাঠালেন স্কটল্যাণ্ডে। কয়েক মাস পর ওরা যখন এসে পৌঁছল, বাওরাড তখননেই, খুন হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী নোরিয়া একটা চিঠি খুঁজে পেলেন পুরানো একটা বেড-ওয়ারমারের ভেতরে। নোরিয়ার উদ্দেশেই লেখা।
তারমানে এমন কিছু, কিশোর বলল। যা নোরিয়া ছাড়া আর কেউ বুঝতে না পারে? বেশ খুশি মনে হল তাকে।
নোরিয়ার ছেলে তা-ই ভাবতেন। গুজব ছড়ানো শুরু হয়েছে তখন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ওই চিঠি আর জার্নালেই রয়েছে গুপ্তধনের চাবিকাঠি। অনেক চেষ্টা করেছেন আমার দাদা-শ্বশুর। বোঝেননি কিছু।
চিঠিটা দেখা যায়? অনুরোধ করল মুসা।
নিশ্চয়ই। আমার শোবার ঘরেই রেখেছি, একটা খাতার ভেতরে।
কেন? কিশোর জিজ্ঞেস করল। খাতায় কেন? বাওরাড ডাইয়ের অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে রাখেন না?
না।
উঠে বেরিয়ে গেলেন মিসেস ডাই। খাতাটা নিয়ে ফিরলেন। হলদে হয়ে গেছে চিঠির কাগজ।
তাতে লেখা :
নোরিয়া, ডিয়ার
শীঘ্রি এসে পৌঁছবে তুমি। ইদানীং আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আমার ওপর চোখ রাখছে কেউ। শেষ এই জরুরি কথাগুলো বলতে হচ্ছে আমাকে, আরও অনেকেই পড়বে এই চিঠি সেকথা মনে রেখে।
তোমাকে কথা দিয়েছিলাম সোনালি সুখ উপহার দেব। তা-ই দিচ্ছি। মনে করার চেষ্টা কর, বাড়িতে আমি কি ভালবাসতাম, ভাব প্লকের গোপন রহস্যের কথা। আমার শেষ নির্দেশ অনুসরণ কর। পড়, আমার দিনগুলো কিভাবে তৈরি করেছি তোমার জন্যে। আয়নায় দেখ সেই গোপন কথা।
মুখ চাওয়াচাওয়ি করল ছেলেরা। আবার পড়ল চিঠিটা।
আমার দাদা-শশুর মনে করতেন, মিসেস ডাই বললেন। সোনালি সুখ বলে গুপ্তধন বোঝাতে চেয়েছেন বাওরাড ডাই। বাড়ির এমন কোন আয়না নেই যার ভেতরে তিনি দেখেননি, যেটা নিয়ে গবেষণা করেননি। কিছুই যখন পেলেন না, অনুমান করলেন, জার্নালে দেখতে বলা হয়েছে। আমার দিনগুলো কিভাবে তৈরি করেছি তোমার জন্যে-এটা জার্নাল দেখার ইঙ্গিত। খুঁজলেন। কিছুই বের করতে পারলেন না।
কারণ, দ্বিতীয় জার্নালটা তিনি পাননি, কিশোর বলল। চিঠিতে বলা হয়েছেঃ শেষ নির্দেশ অনুসরণ কর। তার মানে শেষ জার্নাল দেখার কথাই, বলেছেন। চিঠি লেখার আগের দুমাসের কথা লেখা রয়েছে ওতে। ওই দুমাসে কি কি করেছিলেন বাওরাড ডাই?
নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে জার্নালটা রেখে দিল ডিনো। গুপ্তধনের কথা কিছু বলেনি। খালি বাজে বকবক-কোথায় কোথায় গিয়েছিল, নোরিয়াকে চমকে দেয়ার জন্যে কি কি বানিয়েছে, এসব কথা।
নাহ্, কোন সূত্র নেই, বুঝলে, তিন গোয়েন্দাকে বলল এড। কিছুই বুঝলাম।
আমিও বুঝিনি, স্বীকার করল কিশোর। মিসেস ডাই, বাওরাড ডাই বাড়িতে কি ভালবাসতেন, জানেন? লকের গোপন রহস্যটাই বা কি?
আমি কিছুই বলতে পারব না, কিশোর, কি ভালবাসতেন বাওরাড। তবে লকের ব্যাপারে পুরানো একটা কিংবদন্তী আছে স্কটল্যাণ্ডে, ডাইদের এলাকায়। ওদের কোন এক পূর্বপুরুষ নাকি অপঘাতে মারা যায়। তারপর মাঝে মাঝে দেখা গেছে তাকে, শীতের সকালে, কুয়াশার মধ্যে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে নাকি চেয়ে থাকত হ্রদের দিকে। শত্রু খুঁজত। নয় শতকে ভাইকিংরা মেরে ফেলেছিল তাকে। তার নামেই নামকরণ করা হয়েছিল হ্রদের।
বাহ, চমৎকার, বলল এড। গুপ্তধনের সঙ্গে ভূতের গল্প। ভালই জমে।
টিক বানাউই সেই ভূত কিনা কে জানে, মুসা বলল।
সবুজ ফোক্সওয়াগেনের লোকটা কে? রবিনের প্রশ্ন।
আর আমাদের বাড়িতে চোর ঢোকারই বা কি ব্যাখ্যা? রবিনের কথার যেন প্রতিধ্বনি করল এড।
ডিনো নীরব হয়ে আছে।
চোর ঢোকার সম্ভবত একটাই ব্যাখ্যা, কিশোর বলল। টিক বানাউ কোনভাবে পেয়েছে চিঠিটা। পড়ে বুঝেছে, জার্নালে খোঁজার কথা বলা হয়েছে। প্রথম জার্নালের শেষ পাতার শেষ তারিখ, আর বাওরাড ডাইয়ের খুন হওয়ার মাঝের দুটো মাস ফাঁকা। অর্থাৎ জার্নাল যেদিন শেষ হয়েছে, তার দুমাস পরে মারা গেছেন বাওরাড। ওই দুই মাস কি তিনি জার্নাল লেখেননি? জার্নাল বা ডায়েরী লেখা যাদের অভ্যাস, তারা সাধারণত না লিখে পারে না। একথা জানা আছে টিক বানাউয়ের। সন্দেহ করেছে, নিশ্চয় দ্বিতীয় আরেকটা জার্নাল আছে। আমার ধারণা, চুরি করে ডাই লজে ঢুকে সেটাই খুঁজেছে সে।
গাধা আরকি, বিড়বিড় করল ডিনো। গুপ্তধন শিকারী। হুঁহ!
গুপ্তধন শিকারী হলেই গাধা হয় না, জোর আপত্তি জানাল কিশোর। চিঠিতে কি লিখেছেন বাওরাড? শেষ এই জরুরি কথাগুলো বলতে হচ্ছে আমাকে, আরও অনেকেই পড়বে এই চিঠি সেকথা মনে রেখে। একটা ধাধা বানিয়ে রেখে গেছেন। তিনি ভেবেছিলেন, নোরিয়া সেটার সমাধান করতে পারবেন। আমার বিশ্বাস আরও বাড়ছে, এখন। নিশ্চয় গুপ্তধন লুকিয়ে রেখে গেছেন বাওরাড়। ধাঁধার সমাধান করতে পারলেই বের করা যাবে। আর সমাধানের সূত্র রয়েছে দ্বিতীয় জার্নালে।