রক্তিম গাল তার। চোখা পাতলা নাক। রোদে পোড়া মুখের চামড়া। কালচেধূসর ঘন ভুরুর নিচে চোখ দুটো নীল। রিল্যাক্স, ইয়াং ফ্রেণ্ড, ভয়ের কিছু নেই। ইচ্ছে করলেও কিম তোমাকে গুলি করতে পারবে না।
সাবধানে হাত নামাল কিশোর। ফিরে তাকাল কিমের দিকে।
তুমি মনে কুরেছিলে পিস্তল ঠেকিয়েছি, নিজের চালাকিতে খুব সন্তুষ্ট কিম। বাড়ি এশিয়ায়, চেহারা দেখেই বোঝা যায়। কিশোরের সমান লম্বা, স্বাস্থ্যও প্রায় তার মতই, মুখের চামড়া মসৃণ। হাতে একটা কাঠের চামচ, সেটাই ঠেকিয়ে রেখেছে কিশোরের পিঠে। দেখলে তো, পিস্তল নয়। টেলিভিশন দেখে শিখেছি।
ও নিসান জাং কিম, ভিয়েতনামে বাড়ি। পরিচয় দিলেন ধূসর-চুল দ্রলোক। অল্প দিন হল এসেছে এদেশে। সুযোগ পেলেই টেলিভিশনের সামনে। গিয়ে বসে, ইংরেজি শেখার চেষ্টা করে। এখন তো দেখি আরও অনেক কিছুই। শিখছে।
বাউ করল ভিয়েতনামী। ওপর তলায় আটকা পড়লে কি করতে হবে জান? কিশোরকে বলল সে। বিছানার চাদর ছিঁড়ে পাকিয়েলড়ি বানাতে হবে। সেটা বেয়ে নেমে গেলেই হল। আর যদি বিছানা না-ই পাও, নাগালের মধ্যে পাইপ পেয়েই যাবে।
আরেকবার বাউ করে কফি শপের দিকে চলে গেল কিম। কৌতূহলী চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল কিশোর।
কি যেন শুধু জানতে এসেছিলে? জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।
আঁ, ও! ও, হ্যাঁ…এদিকে একটা নদী আছে। নদীর ওপারেও কি আছে রাস্তাটা? নদী পেরোনোর ব্যবস্থা আছে?
রাস্তা এপারেই শেষ। আর নদী পেলে কোথায়, ওটা তো গিরিখাত। এখন পেরোনোর চেষ্টাও কর না, নির্ঘাত মরবে। যা স্রোত।
অ, আনমনে বলল কিশোর, কথা শুনছে বলে মনে হল না। লবির কোণে রাখা একটা বাক্সের দিকে চেয়ে আছে। ওটার ওপরে ছটা বই, একই বইয়ের ছটা কপি। কালো মলাটের ওপর উজ্জ্বল লাল রঙে লেখা নাম। কভারের ছবি-নীল পায়রার বুকে ছুরি বিদ্ধ। বইটার নাম বু পিজিয়ন।
ভিকটর সাইমন! হঠাৎ বলে উঠল কিশোর। এগিয়ে গিয়ে একটা বই তুলে পেছনটা উল্টে দেখল। পেছনের কভারে একটা ফটোগ্রাফ।
এ-তো আপনার ছবি! বলল সে। আপনিই ভিকটর সাইমন। টেলিভিশনে দেখেছি আপনাকে।
দেখতে পার। কয়েকবার সাক্ষাৎকার দিয়েছি।
ব্লু পিজিয়ন পড়েছি আমি, নিজের কানেই অদ্ভুত লাগছে কিশোরের কণ্ঠস্বর। ভীষণ উত্তেজিত। সাংঘাতিক বই! দারুণ লেখা! কিলারস গেমও পড়েছি। মিস্টার সাইমন, আপনার তো ব্যাংক ডাকাতির দরকার পড়ে না!
করেছি ভাবছ নাকি! হাসলেন সাইমন। নদীর খোঁজ নিতে এখানে আসনি তুমি। কেন এসেছ?
লাল হল কিশোরর গাল। আমি…আমি…সরি, মিস্টার সাইমন, মিথ্যে কথা বলেছি। আপনার মানিব্যাগ হারানো গেছে?
তাকিয়ে আছেন সাইমন। জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢোকালেন। চাপড় দিয়ে দেখলেন অন্যান্য পকেটগুলো। আরে! নেই তো। তুমি পেয়েছ?
রবিন পেয়েছে, আমার বন্ধু! সংক্ষেপে সব জানাল কিশোর।
আশ্চর্য! একেবারে ডেভিস ক্রিস্টোফারের সিনেমার মত। …কি ব্যাপার? হাসছ যে?
উনি আমাদের বন্ধু, স্যার। আমাদের কেসের কাহিনী লেখে রবিন, গল্প ভাল হলে সেটা দিয়ে ছবি করে ফেলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার।
কি ধরনের কেস? আর তোমার বন্ধু রনি এখন কোথায়?
রাস্তায়। নিয়ে আসছি। ছুটে ঘর থেকে চত্বরে বেরোল কিশোর। পার্কিং লটে এসে হাত নেড়ে ডাকল, এই, তোমরা এস। কাছে এল দুই সহকারী গোয়েন্দা।
কি ব্যাপার? জিজ্ঞেস করল রবিন। মিস্টার ভিকটর সাইমন। জান তিনি কে? পরস্পরের দিকে তাকাল মুসা আর রবিন। মাথা নাড়ল মুসা। জানি না।
হাসল কিশোর। বু পিজিয়নের লেখক। কিলারস গেম, শক ট্রিটমেন্টও তিনিই লিখেছেন। টিভিতে দেখাল না তাঁর সাক্ষাৎকার? একটা বই সিনেমাও হতে, যাচ্ছে, কিলারস গেম।
ও, হ্যাঁ, মাথা দোলাল মুসা। মনে পড়েছে। কিলারস গেম-এর কথা সেদিন বাবা আলোচনা করছিল। ইনিই ভিকটর সাইমন?
হ্যাঁ, কণ্ঠের উত্তেজনা যায়নি এখনও কিশোরের। নিউ ইয়র্ক সিটিতে গোয়েন্দা ছিলেন তিনি অনেকদিন, রিপোর্টেও থেকেছেন। প্লেন চালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলেন। একটা পা ভেঙে গিয়েছিল। পা সারার জন্যে ঘরে বসে থাকতে হয় অনেকদিন। তখনই ঠিক করলেন, বই লিখবেন। নিজের জীবনের
অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেও ফেললেন শক ট্রিটমেন্ট। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বেস্টসেলার হয়ে গেল বইটা। এই সেই ভিকটর সাইমন, গোয়েন্দা-কাম-লেখক। চল, চল, দেখা করবে না তার সঙ্গে? রবিন, মানিব্যাগটা আছে তো?
তোমাকেই তো দিয়েছিলাম, রবিন বলল। ভুলে গেছ?
আঁ, ও তাই তো, নিজের পকেট চাপড়াল কিশোর। আছে। চল।
লেখকের সঙ্গে দুই সহকারীর পরিচয় করিয়ে দিল গোয়েন্দাপ্রধান। ওদেরকে বড় জানালাওয়ালা ঘরটায় নিয়ে এলেন সাইমন। কয়েকটা ফোল্ডিং চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। একটা টেবিল ঘিরে রাখা হয়েছে চেয়ারগুলো। টেবিলটার ওপরের অংশ কাচের তৈরি। টেবিল, চেয়ার, টেলিফোনটা ছাড়া আর কোন আসবাবপত্র নেই ঘরে।
মাত্র গত হপ্তায় এসে উঠেছি, জানালেন সাইমন। আমি আর কিম।
এখানে থাকবেন? মুসা জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ। খোঁড়াতে খোঁড়াতে লবিতে গিয়ে কিমকে ডাকলেন তিনি।
কফির সরঞ্জাম নিয়ে এল ভিয়েতনামী। তাকে জিজ্ঞেস করলেন লেখক, ছেলেদের জন্যে কিছু আছে ফ্রিজে?
লেমোনেড। একেবারে খাঁটি জিনিস, নেচারাল ফ্লেভার।
হাসল কিশোর। নেচারাল ফ্লেভার শব্দটাও নিশ্চয় টেলিভিশন থেকে শিখেছে কিম, লেমোনেডের বিজ্ঞাপন দেখে।