এখানে কেউ থাকে বলে তো মনে হয় না, কাদাভরা পথ ধরে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বলল রবিন। একটা বাড়িও দেখলাম না। লাইসেন্সের ঠিকানাটাও নকল না তো?
জমাট বাঁধছে রহস্য, গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসল মুসা। অন্ধের কি দরকার ড্রাইভিং লাইসেন্স? তা-ও ভিখিরি। তার পরেও আবার নকল।
হঠাৎ ঝুপ করে যেন নিচে পড়ে গেছে পথটা। জায়গাটাকে দেখে মনে হয় পাহাড়কে আঙুল দিয়ে টিপে ওখানটায় বসিয়ে দিয়েছে কোন মহাদানব। সরু একটা নহর বইছে ওখানে। খাদের মত জায়গাটার ওপাশ থেকে আবার উঠে গেছে পথ। ওখানে উঠে থামল ছেলেরা। সামনে একটা গিরিখাত। শুকনো মৌসুমে। বোধহয় শুকনোই থাকে, কিন্তু এখন বাদামী ঘোলাটে পানির তীব্র স্রোত বইছে। পথের বাঁয়ে গিরিখাতের একেবারে ধার ঘেঁষে পুরানো একটা গোলাবাড়ি জাতীয় বাড়ি, দোতলায় বড় বড় জানালা। ছাঁইচে লাগানো একসারির টিউব লাইট। এক প্রান্তে বড় করে সাইনবোর্ড লেখাঃ নুমেরি ইন।
নুমেরির সরাইখানা, বাংলায় বিড়বিড় করল কিশোর।
রেস্টুরেন্ট মনে হচ্ছে? রবিন বলল।
পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে লাইসেন্সে লেখা ঠিকানাটা দেখল আবার কিশোর। একশো বিরাশি নম্বর। হ্যাঁ, ঠিকই আছে। ওই যে, নতুন মেইলবক্সটার নম্বর লেখা রয়েছে।
পেছনে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। নিচু জায়গায় জমে থাকা পানি ছিটিয়ে এল একটা লাল স্পোর্টস কার? গাড়ির চালক হালকা পাতলা, ধূসর চুল, বিষণ্ণ চেহারা, ছেলেদেরকে যেন চোখেই পড়ল না। মুমেরিজ ইন-এর কঁচা চত্বরে কাদা জমে আছে। সেখানে গিয়ে থামল গাড়ি। নেমে একটা লাঠি বের করল চালক। তাতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠল বাড়ির সিঁড়িতে। প্রায় ভাঙা একটা স্ক্রীন ডোর টান দিয়ে খুলে চলে গেল ওপাশে, পেছনে বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা।
খোঁড়া! ফিসফিসিয়ে বলল মুসা। কাল রাতে খোঁড়াতে দেখেছ না লোকটাকে?
অ্যাক্সিডেন্টের পর। গাড়ির ধাক্কায় পায়ে আঘাত লেগেছিল হয়ত। এই লোকটা কি ওই লোকটার মত? কিশোর জিজ্ঞেস করল। দেখতে?
শ্রাগ করল রবিন। সাইজটাইজ তো একই রকম। বয়েসও এক। একজনের সঙ্গে আরেকজনের এরকম মিল থাকতেই পারে।
বেশ। আমি যাচ্ছি।
গিয়ে কি করবে? মুসা বলল। হ্যামবার্গার কিনবে?
পাওয়া গেলে। কিংবা ঠিকানা জিজ্ঞেস করব। আসলে জানার চেষ্টা করব লোকটা কে? রবিন, লুকিয়ে পড়। তোমাকে চিনে ফেলতে পারে। গণ্ডগোল করতে পারে।
আমিও থাকি, মুসা বলল। গণ্ডগোল করে যারা, তাদের পছন্দ করি না। আমি।
ভয় পাও? হাসল রবিন।
না। বুড়ো হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু আমার কাম্য।
বাহ্, ভাল কথা শিখেছ আজকাল, কিশোরও হাসল। রাস্তার ধারে দুই বন্ধুকে রেখে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে চলে এল চত্বরে। দেয়ালে ওটা ঠেস দিয়ে রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল বারান্দায়। ছোট বারান্দা পেরিয়ে এসে দাঁড়াল স্ক্রীন ডোরের সামনে। হাতল ধরে টানতেই খুলে গেল পাল্লা।
ভেতরে আবছা অন্ধকার। পালিশ করা শক্ত কাঠের মেঝে, গাঢ় রঙের কাঠের প্যানেলিং। নাক বরাবর সামনে চওড়া দরজার ওপাশে বিশাল একটা ঘর, শূন্য। ওটার সামনের দেয়াল পুরোটাই জানালা। বাইরের গাছপালা, রোদে আলোকিত সাগর, সব চোখে পড়ে। কিশোর অনুমান করল, একসময় ওটা রেস্টুরেন্টের মেইন ডাইনিং রুম ছিল। বোঝা যায়, রেস্টুরেন্ট আর নয় এখন বাড়িটা।
প্রশস্ত একটা প্যাসেজওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে সে, যেটাকে বড় ঘরটার লবি বলা চলে। লবির প্রান্তে ছড়ানো একটা জায়গায় অবহেলায় পড়ে রয়েছে কফি বানানোর সরঞ্জাম, কাঠের কাউন্টার, টুল, বুদ, ধুলোয় ঢাকা। কফি শপ ছিল ওটা এককালে। ডানের দেয়ালে দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটা দরজা। নানারকম বাক্স স্তূপ হয়ে আছে কফি শপ আর লবিতে। বড় ঘরটার কাঠের মেঝেতে রয়েছে আরও কিছু বাক্স। একটা বাক্স খোলা।
ধীরে ধীরে এগোল কিশোর। ডাক দিতে যাবে এই সময় কানে এল ক্রেডল থেকে রিসিভার ওঠানোর শব্দ। স্থির দাঁড়িয়ে কান পাতল। বড় ঘরটায় কেউ রয়েছে, দেখতে পাচ্ছে না সে, টেলিফোন করছে।
কথা শোনা গেল, ভিকটর বলছি।
এক মুহূর্ত নীরবতার পর আবার কথা, হ্যাঁ, জানি, দামি। দাম বেশি তো হবেই, এটা একটা কথা হল নাকি। খরচ করতে রাজি আছি আমি। ঠিক এই সময় কিশোরের পিঠে শক্ত কিছু চেপে ধরা হল।
স্বর্গে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলে নড়ো না, পেছন থেকে ভাঙা ইংরেজিতে বলল কেউ। দুটুকরো করে ফেলব।
৩
মাথার ওপর হাত তুলল কিশোর। ঘাড়ের কাছে শিরশির করছে। আমি…আমি…।
চুপ কর, শান্তকণ্ঠে আদেশ হল।
কাঠের মেঝেতে পায়ের শব্দ। চওড়া দরজায় দেখা দিলেন ধূসর চুল মানুষটা। হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মাথা সামান্য কাত করে তাকালেন কিশোরের দিকে। ভুরু কোঁচকানো। কি হয়েছে, কিম? ছেলেটা কে? …
ভ্রূকুটি করল কিশোর। লোকটাকে কোথায় দেখেছে। কণ্ঠস্বর, ওভাবে মাথা কাত করে কথা বলার ভঙ্গি…কোথায় দেখেছে? কবে?
চুরি করে ঢুকেছে এখানে, জবাব দিল কিম। এখানে দাঁড়িয়ে আড়িপেতে, আপনার কথা শুনছিল।
আমি শুধু ঠিকানা জানতে এসেছি, নিরীহ কণ্ঠে বলল কিশোর। সাইনবোর্ড দেখলাম, মুমেরিজ ইন। রেস্টুরেন্ট, তাই না? চুরি করে ঢুকিনি। দরজা খোলাই ছিল।
ছিল, হাসলেন তিনি। লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে এগিয়ে এলেন কাছে। রেস্টুরেন্ট ছিল আগে। তা দরজা খোলা ছিল, না?