হায় হায়, আগুন লেগে গেছে! ককিয়ে উঠল এলসি।
কাত হয়ে ভাসছে এখন টিনা, ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। এলসি কাঁদছে। আগুনের আলোয় দেখা গেল, তার দুগালে অশ্রুধারা। কাঁদতে কাঁদতে বলল, নিশ্চয় ফুয়েল লাইন ফেটে গেছে!
টিনার ডেক থেকে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ল একজন, তারপর আরেকজন। শেষে আরও দুজন।
নোঙরটা তুলে নাও একজনে, কঠিন কণ্ঠে বলল এলসি। বিন্দুমাত্র মায়া করবে না। আমাদের বোটে যেন উঠতে না পারে।
পারবে না, ম্যাডাম, কথা দিল মুসা। দুহাতে ধরে তুলে নিয়েছে ভারি নোঙরটা।
স্পীডবোটের দিকে সাঁতরে আসতে দেখা গেল একজনকে। সিটের নিচে লাইফজ্যাকেট আছে, আবার বলল এলসি। বের কর ওগুলো।
রবিন আর কিশোর মিলে বের করল। একটা জ্যাকেট ছুঁড়ে দিল কিশোর। ওটা ধরে সাঁতরে আরও কাছে চলে এল বিল, স্পীডবোটে ওঠার ইচ্ছে। বাড়ি মারার জন্যে নোঙর তুলল মুসা। থেমে গেল বিল। আর কাছে আসার চেষ্টা করল না। অন্য তিনজনও স্পীডবোট থেকে দূরে রইল। একটা করে জ্যাকেট ছুঁড়ে দিল সবাইকে কিশোর।
লম্বা একটা দড়ি খুঁজে বের করল রবিন। বোটের সঙ্গে একমাথা বেঁধে দড়িটা ছুঁড়ে দিল পানিতে। যাতে ওটা ধরে ভাসতে পারে বিল আর তার তিন সঙ্গী।
দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। গ্রাস করে নিয়েছে পুরো বোটটাকেই। আলোয় আলোকিত করে ফেলেছে সাগরের একটা অংশ। বিস্ফোরণের বিকট শব্দ, উড়ে চলে গেল বোটের একাংশ, বাকিটা টুপ করে ডুবে গেল পাথরের মত।
অবশেষে এল কোস্ট গার্ডদের জাহাজ। তখনও দুর্ঘটনার জায়গায়ই অপেক্ষা করছে স্পীডবোট। দড়ি ধরে ঢেউয়ের মধ্যে খাবি খাচ্ছে চার ডাকাত। টিনা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
২১
এক হপ্তা পর। আবার উত্তরে চলেছে তিন গোয়েন্দা। মোড় নিয়ে সাইপ্রেস ক্যানিয়ন ড্রাইভে নামল তিনটে সাইকেল। নুমেরিজ ইন-এ পৌঁছে দেখল, ওদেরই অপেক্ষা করছেন মিস্টার ভিকটর সাইমন। সাগরের দিকে মুখ করা মস্ত ঘরটায় বসে আছেন তিনি। কাচের টেবিলে খাবার সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিম, হাসি হাসি চেহারা। ছেলেদের দেখেই ঘোষণা করল, আজ সব আমেরিকান খাবার। গুবারের পানাট-বাটার-মার্শম্যালো-ফ্লাফ স্যাণ্ডউইচ। রসাল ফ্র্যাঙ্কফর্টারস। বার্গার অন সানশাইন ব্র্যান বান, আর পিকি পিকল টেস্ট-ট্রিট রেলিশ। বলে চওড়া হাসি উপহার দিয়ে বাউ করে বেরিয়ে গেল ভিয়েতনামী।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিস্টার সাইমন। ব্র্যাণ্ড নেম বলে টিভিতে বিজ্ঞাপন না দিলে বাজারে গিয়ে মনে হয় খাবারই কিনতে পারত না কিম।
খাবারগুলো দেখে কিন্তু ভালই মনে হচ্ছে, রবিন বলল।
ভ্রূকুটি করলেন লেখক। পানাট-বাটার-মার্শম্যালো-ফ্লাফ স্যাণ্ডউইচ খেতে পারবে তুমি?
দ্বিধায় পড়ে গেল রবিন। জানি না। তবে ফ্র্যাঙ্কফুর্টার খেতে পারব।
বাকিগুলোও না পারার কোন কারণ নেই, মুসা বলল। অবশ্যই যদি শুয়োরের মাংস না থাকে।
শুরু করে দাও তাহলে, বললেন সাইমন।
দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল হ্যামবার্গার আর ফ্রাঙ্কফুর্টারগুলো। কিন্তু স্যাণ্ডউইচগুলো ছুঁয়েও দেখল না কেউ। সন্দেহের চোখে বার বার ওগুলোর দিকে তাকাচ্ছে মুসা। বলল, কয়েকটা খেয়ে দেখলে কেমন হয়? কিমের কথায় মনে হল, ওগুলোতেই বেশি আগ্রহ তার। না খেলে দুঃখ পাবে বেচারা।
পেলে আর কি করা? তাকে বুঝতে হবে, স্বাদ পায় বলেই খায় লোকে। বিস্বাদ হলে খেতে পারত না। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে ওষুধ দরকার, কিন্তু সহজে খেতে চায় কেউ? হাত নাড়লেন সাইমন। খাবারের আলোচনা থাক। কেসের কথা বল। কয়েকবার ফোন করেছি এলসিকে, জবাবই দিতে চায় না। মেজাজ তেতে তার চুলের মতই লাল হয়ে আছে। বিলের কথা শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে।
এত রাগ নিশ্চয় টিনার জন্যে? মুসা বলল।
না। পুলিশ বিলের গায়ে তাকে হাত লাগাতে দেয়নি বলে।
হাসল কিশোর। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে বিল। নাক-মুখের চামড়া আর থাকত তাহলে। যা বড় বড় নখ দেখেছি এলসির হাতে।
রাগে অন্ধ হয়ে আছে মেয়েটা। ভাগ্যিস টিনার বীমা করা আছে। নইলে আত্মহত্যাই করে বসত। তোমাদের তদন্তের কথা খুলে বলবে, প্লীজ? খবরের কাগজে যা যা জেনেছি, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারছি না। জীবনভর গোয়েন্দাগিরি করে করে স্বভাব খারাপ হয়ে গেছে, খুঁটিনাটি না জানলে এখন আর ভাল লাগে না। খালি খুঁতখুঁত করে মন।
কেস রিপোর্ট পড়তে চান? রবিনের হাতে বড় একটা খাম, সেটা দেখিয়ে, জিজ্ঞেস করল। মিস্টার ক্রিস্টোফারের অফিসে গিয়েছিলাম। তিনি নেই। দেশের বাইরে গেছেন। এলে তারপর দেব। ইচ্ছে করলে পড়তে পারেন।
চাই মানে? হাত বাড়ালেন সাইমন। দেখি।
নীরব হয়ে গেল ঘরটা। কোস্ট হাইওয়েতে শোনা যাচ্ছে যানবাহনের শব্দ। পাতার পর পাতা উল্টে চলেছেন সাইমন, গভীর মনোযোগে পড়ছেন। পড়া শেষ করে তাকালেন সাগরের দিকে। বললেন, অনেক সময় ছোটখাটো ব্যাপারই মানুষের সর্বনাশ করে ছাড়ে। রক ওই মানিব্যাগের লোভটা না করলেই আর ধরা পড়ত না। ধরা পড়ায় অবশ্য ভালই হয়েছে। অনেক লোকের জীবন বেঁচেছে। অস্ত্রগুলো নিয়ে যেতে পারলে কত লোক যে মারা যেত জানতেই পারতাম না কোনদিন।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বিলের মত মানুষ মেসা ডিওরোতে আরও আছে। আমরা শুধু অস্ত্রের একটা চালান বন্ধ করতে পেরেছি।