আরি, আমার বোট! হঠাৎ চিৎকার করে বলল মিসেস নিকারো।
বাড়িটা অন্ধকার, অফিসটাও। জেটির ধারে সাদা ট্রাকটা এখন নেই। একশো মিটার দূরে দেখা গেল ছুটন্ত আলো, টিনার।
ডাকাত! ডাকাতেরা আমার বোট নিয়ে গেল? চেঁচিয়ে বলল এলসি। যদি মনে করে থাকে। বাক্যটা শেষ করল না সে। দৌড় দিল জেটির দিকে।
এস! বলেই রবিনের হাত ধরে টানল মুসা। ছুটল এলসির পেছনে।
মিস্টার রোজার, কিশোর বলল। পুলিশকে বলুন কোস্ট গার্ডককে জানাতে। বোটের লোকগুলো আর্মস স্মাগল করছে।
তুমি যাও, মিসেস নিকারো বলল। আমি বলছি সব।
মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে কিশোরও দৌড় দিল।
ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে অফিসে ঢুকল এলসি। টান মেরে খুলল একটা ড্রয়ার। একটা চাবি তুলে নিয়ে মুসাকে বলল অফিসের পেছনের লকার থেকে দুটো দাঁড় নিয়ে আসতে।
হাইওয়েতে হট্টগোল শুরু হল। গর্জে উঠল একটা বড় ট্রাকের ইঞ্জিন। বিকট শব্দ করে আছড়ে পড়ে ভাঙল মোটেলটা, ভাঙা টুকরো-টাকরা ছিটকে গেল এদিক ওদিক। বাড়ি-ভাঙা জিনিসপত্রে বোঝাই হয়ে গেল রাস্তার একপাশের অর্ধেকটা। ভেঙে গেছে সুইমিং পুলের পাড়, ঢাল বেয়ে গড়িয়ে এল কাদা মেশানো পানির স্রোত। বান ডাকল যেন পথের ওপর।
সেদিকে চেয়ে মাত্র একটা মুহূর্ত নষ্ট করল এলসি। তারপর ঘুরেই দৌড় দিল বৃষ্টিভেজা ডকের দিকে। পেছনে তিন গোয়েন্দা।
সাইমনের স্পীডবোটটা নেব আমরা, এলসি বলল। টিনার চেয়ে স্পীড বেশি ওটার।
জেটিতে বাঁধা রয়েছে একটা দাড়টানা নৌকা। লাফ দিয়ে তাতে উঠল এলসি। দুলে উঠল নৌকাটা। তিন গোয়েন্দাও উঠল। দড়ি কেটে দিল কিশোর। ছপাৎ করে পানিতে দাঁড় ফেলল মুসা।
আরে, টিনার আলো কই! এলসি বলল। দেখা যাচ্ছে না আর।
উপকূল ধরে যাচ্ছে। মোড় নিয়েছে বোধহয়, বলল কিশোর।
সারেঙও না সারেঙের জাতও না বিল। পাথরে ধাক্কা লাগিয়ে বোটটা ডোবাবে আজ!
স্পীডবোটের গায়ে লাগল নৌকা। টান দিয়ে ককপিটের তেরপল সরাল ওরা। এলসি উঠল, আগে। তারপর মুসা আর রবিন। ইতিমধ্যে বয়ার সঙ্গে নৌকাটা বেঁধে ফেলেছে কিশোর। খুক করে ছোট্ট কাশি দিয়েই স্টার্ট হয়ে গেল চমৎকার ইঞ্জিন। ছুটল বোট।
বৃষ্টির বিরাম নেই। বাতাসাওও পাল্লা দিয়ে চলেছে। বড় বড় ঢেউ। বোটের তলায় চাপড় মেরে যেন কামানের গর্জন তুলছে। অভিজ্ঞ দক্ষ হাতে হুইল ধরেছে এলসি। গাদাগাদি করে বসে বোটের ধার আঁকড়ে ধরে রেখেছে ছেলেরা, যাতে ঝাঁকুনির চোটে উড়ে গিয়ে না পড়ে সাগরে।
আলোটা প্রথম রবিনের চোখে পড়ল। দূরে চলে গেছে। অস্পষ্ট। হাত তুলে বলল, ওই যায়!
বোটের গতি আরও বাড়িয়ে দিল এলসি। উত্তাল এই সাগরে মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে।
হঠাৎ জ্বলে ওঠা উজ্জ্বল আলো ক্ষণিকের জন্যে যেন অন্ধ করে দিল ওদের। উত্তেজনায় এতক্ষণ খেয়াল করেনি, এখন কানে আসছে হেলিকপ্টারের রোটরে ক্যাট-ক্যাট-ক্যাট-ক্যাট। গাঢ় অন্ধকারে চাদর ফুড়ে কালো পানিতে বদমাশদের খুঁজে বেড়াচ্ছে সার্চলাইট।
কোস্ট গার্ড! এলসি বলল।
নিভিয়ে ফেলা হয়েছে টিনার আলো। কালো আকাশের পটভূমিতে কালচে একটা ছায়ার মত এখন চোখে পড়ছে ওটা। কাছে চলে এসেছে স্পীডবোট। আবছামত দেখা যাচ্ছে চলার পথে টিনার রেখে যাওয়া ফেনিল জলরেখা।
এহ্হে! চেঁচিয়ে উঠল এলসি। গভীর সাগরের দিকে চলে যাচ্ছে। শয়তানের দল! বেরিয়ে যাবে!
একবারে হুইলের পুরো অর্ধেকটা ঘুরিয়ে দিল সে। মোড় নিতে গিয়ে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে কাত হয়ে গেল স্পীডবোট। গোঁ গোঁ করে তীব্র প্রতিবাদ জানাল ইঞ্জিন। টিনার জলরেখা ধরে ছুটল লাফিয়ে লাফিয়ে। দেখতে দেখতে চলে এল বোটটার পাশে। রাইফেলের শব্দ শোনা গেল, স্পীডবোটকে সই করে গুলি আরম্ভ করেছে।
ইতরের বাচ্চা! গাল দিল এলসি।
সামনে চলে এল স্পীডবোট। শাঁ করে বেরিয়ে গেল বোটের নাকের ডগা দিয়ে। ধাক্কা বাঁচাতে গিয়ে বোটেরও নাক ঘুরিয়ে ফেলতে হল। কাত হয়ে যাচ্ছে। উল্টে যাওয়ার ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে কমিয়ে দেয়া হল গতি।
আবার গুলির শব্দ। এবারও ব্যর্থ হল নিশানা। বোটের কাছে পানিতে পড়ল বুলেট।
এই সময় খোলা সাগরের দিক থেকে ফিরে এল হেলিকপ্টার। ওটার শক্তিশালী নীলচে-সাদা আলো যেন বিদ্ধ করল টিনাকে।
পেয়েছে এতক্ষণে! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। তাকাল তীরের দিকে। ওখানকার আলোগুলো বেশি কাছে মনে হচ্ছে এখন।
কিন্তু কোস্ট গার্ডদের কাটারটা কই? জাহাজটাকে দেখার জন্যে এদিক ওদিক তাকাল এলসি।
টিনার গতি আবার বেড়েছে। একেবেঁকে ছুটছে, যেন জেঁকের মত লেগে থাক্কা হেলিকপ্টারের আলোকরশ্মি ঝেড়ে ফেলতে চাইছে গা থেকে। তীরের দিকে গিয়ে বাঁচতে পারবে না, বুঝে গেছে, আবার মুখ ঘোরাল খোলা সাগরের দিকে।
হা-হা করে হেসে উঠল এলসি। আবার স্পীডবোটটাকে নিয়ে এল টিনার গলুইয়ের সামনে। ধাক্কা লাগার ভয়ে আবার গতি কমাতে বাধ্য হল বোটের সারেঙ।
বাঁয়ে দেখল কিশোর, মাথায় ফেনার মুকুট পরে তাথৈ নৃত্য জুড়েছে ঢেউ। ভীমগতিতে ধেয়ে আসছে বিশাল এক ঢেউ, যেন ছোটখাট এক পাহাড়।
হুঁশিয়ার! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
বনবন করে স্টিয়ারিং ঘোরাল এলসি। কাত হয়ে উল্টে যাওয়ার অবস্থা হল স্পীডবোটটার। পানির পাহাড়ের প্রায় গা ছুঁয়ে বেরিয়ে চলে এল কোনমতে।
টিনা পারল না। গা বাঁচাতে গিয়ে পাশে কাটল। চোখা পাথরে ঘষা লেগে ছিঁড়ে রয়ে গেল অর্ধেকটা তলা। কাঠ ভাঙার মড়মড় তো নয়, মুসার মনে হল বোটটার অন্তিম আর্তনাদ। লাফ দিয়ে পানির ওপরে উঠে গেল টিনা, ঝপাং করে পড়ল আবার। চেঁচাতে শুরু করল আরোহীরা। লকলক করে উঠল কমলা-আগুনের জিভ।