ঠাস করে কিশোরের গালে চড় মারল রক।
মাথা নাড়তে নাড়তে বিল বলল, বোকামি করে ফেলেছ তুমি, রক। তোমাকে যেতেই হচ্ছে আমাদের সঙ্গে। যা করলে না…।
ঝট করে পিস্তল বেরিয়ে এল রকের হাতে।
ছেলেটা তাহলে সত্যিই বলেছে, চকচকে নলটার দিকে তাকিয়ে বলল বিল।
পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল পিনটো, তার কথা ভুলেই গিয়েছিল রক। নড়ে উঠল সে। এত দ্রুত, গুলি করারও সময় পেল না রক। ঘাড়ে এসে লাগল কারাতের কোপ। একবার মাত্র চিৎকার করল রক, হাত থেকে খসে পড়ল পিস্তল, টলে উঠে মেঝেতে পড়ে গেল সে।
পিস্তলটা তুলে রকের দিকে তাক করল বিল।
গুঙিয়ে উঠল রক। ঘাড়ে হাত ডলতে ডলতে উঠে বসল। কলার চেপে ধরে তাকে টেনে তুলল পিনটো। টানতে টানতে নিয়ে গেল বাইরে। বিল গেল পেছনে।
ঝমঝম করে একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে মোটেলের ছাতে। টানাটানি করে বাঁধন খোলার চেষ্টা করল এলসি।
আটকে রাখার চেষ্টা করলাম ওদেরকে, যতক্ষণ পারলাম, কিশোর বলল। পনেরো মিনিট সময় দিয়ে এসেছিলাম মিস্টার রোজারকে। নিশ্চয় পুলিশকে খবর দিয়েছে। পালাতে পারবে না ওরা, তার আগেই পৌঁছে যাবে পুলিশ।
আমি ভাবছি অন্য কথা, গম্ভীর কণ্ঠে বলল মিসেস নিকারো। পুলিশের আগেই অন্য কিছু আসবে। আমরা এঘর থেকে বেরোনোর আগেই।
কি? বলেই চমকে উঠল এলসি। একটা শব্দ! ঝড়-বৃষ্টির নয়। মনে হল, শব্দটা এসেছে মাটির নিচ থেকে। বিচিত্র এক ধরনের গোঙানি। কাছেই কোথাও ঝনঝন করে কাচ ভাঙল জানালার।
মাই গড! চেঁচিয়ে উঠল এলসি।
আমার স্বপ্ন! ফিসফিসিয়ে বলল, মিসেস নিকারো। বলেছিলাম না বিপদ! ভয়ানক বিপদ আসছে! হুঁশিয়ার করেছিলাম ছেলেটাকে, শুনল না! রবিনের উদ্দেশে বলল সে। চোখ মুদে বিড়বিড় শুরু করল ইটালিয়ান ভাষায়, প্রার্থনা করছে।
মড়মড় করে উঠল কাঠ। আবার কাচ ভাঙল। থরথর করে কাঁপছে বাড়িটা। ভূমিকম্পের মতই, কিন্তু ভূমিকম্প নয়-ভাবল রবিন। ইঞ্চি ইঞ্চি করে পিছলে সরে যাচ্ছে মোটেলের নিচের মাটি।
২০
দুলে উঠল ঘরটা।
মেঝেতে পড়ে ল্যাম্প ভাঙল, ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে গেল, ফুলিঙ্গের ফুলঝুরি ছিটাচ্ছে।
আগুন যেন না ধরে! ঈশ্বর! প্রার্থনা করছে এলসি। আগুন ধরতে দিয়ো না!
আরও ফুলঝুরি ছিটল কয়েক সেকেণ্ড, তীব্র নীলচে সাদা আলো ঝিলিক দিল। তারপর অন্ধকার। কাঠের গোঙানি বাড়ছে। রোম-খাড়া-করা কিচকিচ আওয়াজ তুলে কাঠের শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে জোড়ার পেরেকগুলো।
ভীষণ ভাবে দুলে উঠল আরেকবার ঘরটা। চেঁচিয়ে উঠল মিসেস নিকারো।
বাঁচাও! আল্লা! চিৎকার শুরু করল মুসা। এই কেউ শুনছ? বাঁচাও!
কেউ জবাব দিল না। সাহায্য করতে এল না কেউ।
আর বাঁচব না! এলসি বলল। পাহাড়টাই ধসে যাবে রে, আর বাঁচব না…!
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই হড়কে আরও দুই মিটার সরে গেল বাড়িটা। অন্ধকারে এদিক ওদিক ছিটকে পড়ল চেয়ারগুলো। মুসা গিয়ে পড়ল বিছানার ওপর, কিশোরের চেয়ারটা গেল কাত হয়ে।
মিসেস নিকারো? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনি ঠিক আছেন?
আমাকে জিজ্ঞেস করছ? এই অবস্থায় ভাল থাকা যায়? এলসি, তুমি কোথায়?
মেঝেতে।
পুলিশ আসবেই, কিশোর বলল। নিশ্চয় খবর দিয়েছে মিস্টার রোজার। রবিন, ভাল আছ? মুসা, কোথায় তুমি?
আছি, গলা কাঁপছে রবিনের।
আমি এখানে, জবাব দিল মুসা।
অপেক্ষা করছে ওরা। শুনছে। জলস্রোতের শব্দ কানে এল, ছাত থেকে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ নয়। বেকায়দা ভঙ্গিতে কাত হয়ে আছে কিশোর। হাত ব্যথা করছে, বাধা জায়গাগুলোতে। কাদা আর রাসায়নিক পদার্থের ভেজা ভেজা একটা গন্ধ আসছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সে। বুঝতে পারল, ভেঙে যাচ্ছে। সুইমিং পুলের পাড়। হাজার হাজার গ্যালন পানি এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওদের ওপর, কুটোর মত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
খাইছে! পানি আসছে কোত্থেকে! অন্ধকারে শোনা গেল মুসার গলা।
কিশোরের মত এলসিও বুঝে গেছে কারণটা। সাহায্যের জন্যে চেঁচাতে শুরু করল আবার।
এইবার জবাব মিলল।
ওখানে! চিৎকার করে বলল একটা কণ্ঠ। ওরা ওখানে!
দরজা খোলার চেষ্টা করল কেউ। কিন্তু আটকে গেছে ওটা। ভয়ঙ্কর আরেক দুলুনি। পুলের দিকে মুখ করা জানালাগুলো ভেঙে কাচের গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। আলো দেখা গেল। টর্চ হাতে ঘোরাঘুরি করছে দুজন লোক। হইচই করছে। কলকল করে পানি ঢুকতে আরম্ভ করল ঘরে। ভাঙা জানালার সামনে দেখা গেল একটা মুখ।
মিসেস নিকারোকে আগে তুলুন, চেঁচিয়ে বলল কিশোর। মিসেস নিকারো!,
জানালা দিয়ে ঢুকল একজন পুলিশ। তার পেছনেই একজন ফায়ারম্যান। টর্চের আলোয় বন্দিদের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠল সে, সর্বনাশ…!
চোখের পলকে এসে মিসেস নিকারো আর এলসিকে তুলে নিল দুজনে, বাঁধা অবস্থায়। গলা ফাটিয়ে এখনও ঈশ্বরকে ডেকে চলেছে দুই মহিলা। আরও লোক ঢুকল ঘরে। তিন গোয়েন্দাকেও বের করা হল। বাঁধন কেটে দেয়া হল সকলের। একটা মুহূর্ত আর দেরি করল না কেউ। নামতে শুরু করল পাহাড় থেকে। বার বার হোঁচট খেয়ে, পিছলে পড়ে, অনেক কষ্টে অবশেষে হাইওয়েতে নেমে এল ওরা।
সেখানে গাড়ির ভিড়, অনেক ইঞ্জিনের গুঞ্জন। সার্চলাইটের আলো যেন ঝাড়ু দিয়ে ফিরছে সমস্ত পাহাড়টাকে।
বলেছিলাম না, ওখানেই আছে! ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসতে লাগল রোজার। কাছে এসে কিশোরের হাত ধরে প্রায় নাচতে শুরু করল। আমি বলেছি ওদের, তোমরা ওখানে। যাক বাঁচা গেল। থ্যাঙ্ক গড!