মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না কিশোর। দরজার আড়াল থেকে বেরিয়েই দিল দৌড়। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় শুনল বিলের চিৎকার। ফিরেও তাকাল না। নিচে নেমে, রান্নাঘরের দরজা খুলেই একলাফে একেবারে বাইরে।
১৭
একছুটে নিকারোদের সীমানা পেরিয়ে গিয়ে হাইওয়েতে উঠল কিশোর। লুকাতে হলে, বিলের হাত থেকে বাঁচতে হলে তাড়াতাড়ি কোথাও লুকিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু কোথায়?
পথের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা গাড়ি, কোন ক্যাম্পারের হবে। পেছনের দরজা খোলা। গাড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে ক্যাম্পারের মালিক। কাগজের তোয়ালে দিয়ে হাত মুছছে।
বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না কিশোর। নিঃশব্দে উঠে পড়ল গাড়িতে। কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেয়, কতগুলো ঝিনুকের ঝুড়ির পাশে। গায়ের ওপর টেনে দিল একটা পুরানো তেরপল। খানিক পরেই দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল ক্যাম্পারের দরজা। ইঞ্জিন স্টার্ট নিল।
চলতে শুরু করল গাড়ি। শখানেক মিটার দক্ষিণে এগিয়ে, পুরো ঘুরে আবার উত্তরে রওনা হল। গতি বাড়ছে। তেরপল সরিয়ে উঠে বসল কিশোর, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। নিকারোদের সীমানা পার হওয়ার সময় বিলকে দেখতে পেল সে। রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথায় চোখ বোলাচ্ছে লোকটা। হাতের মুঠো শক্ত। অবাক।
হেসে উঠল কিশোর।
নিকারোদের ডক আর অক্সনার্ডের মাঝামাঝি এসে প্রথমবারের মত থামল ক্যাম্পার, ট্রাফিক সিগন্যাল দেখে। এই অপেক্ষাতেই ছিল কিশোর। গাড়ির গতি কমে আসতেই খুলে ফেলল পেছনের দরজা, থামার সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ল। হাঁটা দিল মোড়ের দিকে।
দশ মিনিটে পৌঁছে গেল একটা বাস টার্মিনালে। সান্তা মনিকার বাস এল, উঠে পড়ল তাতে।
দক্ষিণে ছুটেছে বাস। ভাবছে কিশোর। বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আর, বিল নজর রাখে রোজারের ওপর। কিশোরের সাথে কি কি কথা হয়েছে রোজারের, সব জানে। কিন্তু কিভাবে? নিশ্চয় কারও কাছে বলেছে রোজার। কার কাছে? সিনথিয়া?
নিকারোদের ডক পার হচ্ছে বাস। পার্কিং লটে কেউ নেই। অফিসটা নির্জন। বিল আর তার বন্ধু গেল কোথায়? এলসি আর তার শাশুড়িই বা কোথায়? ওদের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে বিলের হাত নেই তো? …আরও নানারকম প্রশ্ন ভিড় করে এল কিশোরের মনে। হঠাৎ শঙ্কিত হয়ে উঠল সে। রোজার কি নিরাপদ?
সান্তা মনিকায় বাস থামতে প্রথম নামল কিশোর, নামল না বলে দরজা দিয়ে ছিটকে বেরোল বলা যায়। মোড়ের কাছ থেকে ট্যাক্সি নিয়ে চলল ডলফিন কোর্টে।
চারটে চল্লিশ মিনিটে রোজারের দোড়গোড়ায় কিশোরকে নামিয়ে দিল ট্যাক্সি। বেল বাজাল। রোজারকে দরজা খুলে দিতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।
কি ব্যাপার? এত উত্তেজিত? কোন খবর আছে নাকি? জিজ্ঞেস করল রোজার।
আছে। রোজারের পিছু পিছু রান্নাঘরে এসে বসল কিশোর। বসেই জিজ্ঞেস করল, মিস্টার রোজার, কাল আমি যাওয়ার পর কার সঙ্গে কথা বলেছেন?
কথা বলেছি! কই, কারও সঙ্গে না তো। ঘর থেকেই বেরোইনি।
তাহলে কেউ ফোন করেছিল। কিংবা আপনার ঘরে এসেছিল। যার সঙ্গে বলেছেন।
না, কেউ ফোনও করেনি; আসেওনি। আমার অত বন্ধুবান্ধব নেই। কেন? খুব জরুরি। ভাবুন, মিস্টার রোজার। ভাল করে ভেবে দেখুন। কাল বিকেলে অন্ধ ভিখিরি আর নিকারোদের কথা আলোচনা করেছিলাম। নিশ্চয় সেসব কথা কারও কাছে বলেছেন। জিনো নামে কাউকে চেনেন?
ভাবল রোজার। মাথা নাড়ল, না, চিনি না। কেউ আসেনি এখানে, রক ছাড়া। তাকেও কিছু বলিনি। রাতে ফিরেই ওপরে চলে গেল। ঘরে ঢুকে তালা লাগিয়ে দিল।
আজ সকালে?
না, আজ সকালেও না। শুধু কেমন আছ, ভাল, ওই পর্যন্তই।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। শূন্য চোখে চিনির পাত্রটার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে চিমটি কাটল নিচের ঠোঁটে। রক রেনান্ডের কথা ভাবছে। কালো গলাবন্ধ শার্ট, কালো চশমা। অদ্ভুত! আনমনে বলল সে।
কি বললে?
আচ্ছা, আপনার পড়শীদের সম্পর্কে কি ভাবে রক?
কি আর ভাববে? খুব সাধারণ লোক।
সে নিজে খুব অসাধারণ, না?
শ্রাগ করল রোজার।
আবার চিনির পাত্রের দিকে তাকাল কিশোর। আচ্ছা, কবে থেকে কফিতে চিনি খাওয়া আরম্ভ করেছে রক? আচমকা প্রশ্নটা যেন ছুঁড়ে দিল সে। সব সময় খায় না, তাই না? সেরাতে প্রথম যেদিন এলাম আমরা, শুধু কালো কফিই খেয়েছে, চিনি ছাড়া।
আঁ…হ্যাঁ, তা ঠিক। এই দুএকদিন আগে থেকে চিনি খাওয়া আরম্ভ করেছে। চিনি খেলে নাকি দ্রুত শক্তি পায় সে।
চকচক করছে কিশোরের চোখ। টেনে নিল পাত্রটা। চিনির ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে দিল। উজ্জ্বল হল চেহারা। আস্তে করে বের করে আনল প্লাস্টিকের একটা বাক্স, একপাশে ছোট ছোট ছিদ্র।
জিনিসটার দিকে তাকিয়ে আছে রোজার। ওটা কি?
একধরনের শ্রবণ-যন্ত্র, মিস্টার রোজার, স্পাইরা বলে বাগ। রকের কথা বলার প্রয়োজন ছিল না আপনার সঙ্গে। চিনির পাত্রে এই জিনিস ঢুকিয়ে টেবিলে রেখে গেছে। আমাদের কথা সব শুনেছে সে। উঠে টেলিফোনের দিকে এগোল কিশোর। টি এক্স ফোর-এ কাজ করেছেন। নিশ্চয় নাম্বার জানেন।
নাম্বার বলল রোজার। ডায়াল করল কিশোর। রিসিভার কানে ধরে রেখে ঘড়ি দেখল। চারটে ঊনষাট। ওপাশে রিসিভার ভোলা হলে রক রেনাল্ডকে চাইল সে। ওরা জানাল ওই নামে ওখানে কেউ কাজ করে না।
কিন্তু টি এক্স ফোরেই তো কাজ করতেন মিস্টার রেনাল্ড। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন?