উঠল সে। হাঁটতে শুরু করল রাস্তা ধরে। ড্রাইভওয়ের উল্টো দিকে এসেই দেখতে পেল অফিসে নেই এলসি। মিসেস নিকারোর চেয়ারে বসে ডেস্কে পা তুলে দিয়ে আয়েশ করছে বিল। সিগারেট টানছে, ধোঁয়া ছাড়ছে ছাতের দিকে। ডেস্কের ওপর আসন-পিড়ি হয়ে বসেছে তার বন্ধু। ভাবসাব দেখে মনে হয় গল্প শোনাচ্ছে বিলকে। মাঝে মাঝে হাত নেড়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে।
কিন্তু এলসি গেল কোথায়? বাড়িতে, শাশুড়ির সঙ্গে রয়েছে? বিল আর তার বন্ধুকে এখন ওই অবস্থায় দেখলে কি করবে মেয়েটা, ভেবে হাসি পেল কিশোরের।
ভালমত খেয়াল করতে বাড়িটাও শূন্য মনে হল। জানালার পাল্লাগুলো বন্ধ, পর্দা টানা। এই সময় ড্রাইভওয়েতে ঢুকল একটা গাড়ি, বাড়ির সামনে গিয়ে থামল। গাড়ি থেকে নামল সাদা-চুল এক বৃদ্ধা, বোধহয় মিসেস নিকারোর মেহমান, হাতে একটা প্যাকেট। দরজায় গিয়ে বেল বাজাল। কেউ বেরোল না। মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে থেকে আবার বেল বাজাল বৃদ্ধা। সাড়া না পেয়ে চলল অফিসের দিকে।
দেখতে পেয়েছে বিল। উঠে দাঁড়াল। তার বন্ধু আগের মতই বসে রয়েছে।
বিলের সঙ্গে কি কথা হল বৃদ্ধার। তারপর একটুকরো কাগজে কিছু লিখে ভঁজ করে দিল বিলের হাতে। ফিরে এল গাড়ির কাছে। রেগেছে খুব।
গাড়িটা চলে গেলে আবার চেয়ারে বসল বিল। ভাঁজ করা কাগজটা দলেমুচড়ে ফেলে দিল ময়লা ফেলার ঝুড়িতে।
হেসে উঠল তার বন্ধু।
এবার সতর্ক হল কিশোর। ঘুরে হাঁটতে শুরু করল উল্টো দিকে। চলে এল এমন একটা জায়গায়, যেখান থেকে বাড়িটার জন্যে অফিস দেখা যায় না। তারমানে অফিস থেকে এখন কেউ দেখতে পাবে না তাকে। রাস্তা পেরিয়ে দ্রুত বাড়িটার দিকে এগোল সে।
রান্নাঘরের দরজার পাশে একটা জানালা, ছিটকানি খোলা। টান দিতেই পাল্লা খুলে গেল। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দরজার নব নাগাল পাওয়া গেল, মোচড় দিতেই কট করে খুলে গেল তালা। ঘরে ঢুকে আস্তে লাগিয়ে দিল পাল্লাটা, তালা খোলাই রাখল। তাড়াহুড়ো করে বেরোনোর দরকার হতে পারে।
রান্নাঘরের ভেতরটা প্রমোট। খাবারের গন্ধে বাতাস ভারি। স্টোভে বসানো পাত্রে সুপ তৈরি হচ্ছে। গরম রোস্ট ঠাণ্ডা হয়নি এখনও। সালাদের সজি কেটে রাখা হয়েছে।
নিঃশব্দে ডাইনিং রুমে চলে এল কিশোর। টেবিলে বাসনপেয়ালা সাজানো, তিনজনের জন্যে। পর্দা টেনে দেয়ায় ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার। লিভিং রুমেও একই অবস্থা। বাতাসে খাবারের গন্ধের পাশাপাশি ঝাঁঝালো আরেকটা গন্ধ। কিছুক্ষণ আগে এই গন্ধ ছিল না, সে যখন কথা বলছিল মিসেস নিকারোর সঙ্গে। একটা সিগারেটের পোড়া টুকরো চোখে পড়ল, পা দিয়ে পিষে নেভানো হয়েছে।
সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়াল কিশোর। আস্তে ডাকল। জবাব নেই। গলা আরেকটু চড়িয়ে ডাকল, মিসেস নিকারো? আছেন? আমি, কিশোর।
সাড়া নেই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এল কিশোর।
বেডরুমের জানালার খড়খড়ি ভোলা। আলো আসছে। বড় বড় কাঠের আসবাব এঘরে। একটা দেরাজ বোঝাই ছবি। হলরুমে ঢুকল সে। এঘরের আসবাবগুলো সাদা দেয়ালে টাঙানো রঙিন ফটোগ্রাফ। ঘরটায় খোঁজাখুজি করছে কিশোর, এই সময় বাজল টেলিফোন। রীতিমত চমকে উঠল সে। ফোনটা একটা টেবিলে রাখা। জানালা দিয়ে উঁকি দিল অফিসের দিকে।
অফিসের সেটটার দিকে তাকিয়ে আছে বিল। দ্বিধা করছে মনে হয়।
আবার রিঙ হল।
রিসিভার তুলল বিল। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল বেডরুমের ফোনের রিঙ। হাসল কিশোর। এটা অফিসের ফোনের এক্সটেনশন। আস্তে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল সে।
সি, বলল বিল।
স্প্যানিশ ভাষা। কিছু কিছু বোঝে কিশোর। রিসিভার জোরে কানে চেপে ধরে যতটা সম্ভব বোঝার চেষ্টা করছে।
ওপাশের লোকটা নিজের নাম বলল জিনো। বলল, মাইসের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। টাকার কথা কি যেন বলল। নিকারোর নাম বলল, তারপর বলল কিশোরের নাম! মনে করিয়ে দিল, রোজারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল কিশোর পাশা, সেখানে মিসেস নিকারো আর অন্ধ লোকটার কথা আলোচনা করেছে। বিলকে হুঁশিয়ার থাকতে বলল। বিল জবাব দিল, থাকবে। জানাল, সে আর পেক সব নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। পেক বোধহয় অফিসে বসা লোকটার নাম, আন্দাজ করল কিশোর। আরও কয়েকটা কথা বলে লাইন কেটে দিল জিনো।
রিসিভার রেখে আবার জানালা দিয়ে উঁকি দিল কিশোর। অফিসের বাইরে। বেরোল বিল। সৈকতে চোখ বোলাল একবার। তারপর ফিরে চেয়ে ডাকল বন্ধুকে।
সে বেরোল, ইশারায় কটেজটা দেখাল।
কটেজের দিকে হাঁটতে শুরু করল পেক।
নিকারোদের বাড়ির দিকে ফিরল বিল। কৌতূহলী হয়ে উঠেছে যেন হঠাৎ করেই। পায়ে পায়ে রওনা হল এদিকে।.
চট করে সরে এল কিশোর। নিশ্চয় রিসিভার রাখার শব্দ পেয়েছে বিল। নইলে সন্দেহ হল কেন?
সিঁড়িতে উঠে থামল পায়ের শব্দ। তালায় চাবি ঢোকানো হল। পৌঁছে গেছে বিল। যে-কোন মুহূর্তে উঠে আসবে ওপরে। নিচে নামার আর সময় নেই। ধরা পড়ে যাবে কিশোর, তারপর…।
তারপর-কি?
বেডরুমের লাগোয়া বাথরুম আছে। টিপ টিপ করে পানি পড়ার শব্দ আসছে ভেতর থেকে।
সামনের দরজা খোলার মৃদু আওয়াজ হল।
তিন লাফে ঘর পেরিয়ে আরেক ঘরে চলে এল কিশোর। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিল। ফিরে এল বেডরুমে। খাটের নিচে ক্যামেরাটা লুকিয়ে রেখে নিজে এসে লুকাল দরজার আড়ালে।
দুপদাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠল বিল। হ্যাঁচকা টান দিয়ে খুলল বেডরুমের দরজা। দাঁড়িয়ে রইল এক মুহূর্ত, বাথরুমের দিকে চেয়ে। তারপর এগিয়ে গেল সেদিকে।