রবিনের বিপদের আশঙ্কায় শঙ্কিত হল কিশোর।
স্টোরেজ কোম্পানির দিকে এগোচ্ছে রবিন। এলাকাটা নির্জন। শেকলের তৈরি উঁচু বেড়া। বিল্ডিংটায় কোন জানালা দেখা যাচ্ছে না। কাদামাথা কয়েকটা সাদা রঙের মুভিং ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। গেট থেকে সোজা চলে গেছে ড্রাইভওয়ে, এবড়োখেবড়ো, জায়গায় জায়গায় গর্ত, পানি জমে আছে। গেট বন্ধ।
কাউকে চোখে পড়ছে না। বাইরে থেকে কোম্পানি-এলাকার চারদিকে চক্কর দিতে শুরু করল রবিন। ঘাস জন্মে আছে জায়গায় জায়গায়। বাড়ির একধারে ভাঙা বাক্স আর বাতিল কাগজের স্তূপ। ভ্যান গাড়িগুলোর জন্যে পেছনদিকটা ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে না। চত্বরের ভেতরে কোথাও থেকে গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
দাঁড়িয়ে কান পাতল সে। কথা বোঝা যাচ্ছে না। বেড়ার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটা গাড়ি, ওটার দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে, লম্বা দম নিয়ে উঠতে শুরু করল বেড়া বেয়ে ওপরে উঠে বেড়া ডিঙিয়ে নামল ভ্যানের ছাতে।
ছাতের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে রইল কয়েক সেকেণ্ড। দম নিয়ে, উঠল। মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিল চত্বরের দিকে।
সময় মত শুকায় না, বলল একজন। না শুকাক, বলল আরেকটা কণ্ঠ। এভাবেই নেব।
রবিন যেটার ছাতে রয়েছে, ওটার কাছাকাছি আরেকটা ভ্যান। মাঝে ফাঁক সামান্য। উঠে এক লাফে চলে এল দ্বিতীয় ভ্যানের ছাতে। পায়ে স্নিকার থাকায় শব্দ হল না। হামাগুড়ি দিয়ে এগোল। উঁকি দিতেই চোখে পড়ল লোকদুটোকে। তার দিকে পেছন, তাকিয়ে রয়েছে চকচকে রঙ করা সাদা একটা ট্রাকের দিকে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল আবার রবিন, সাবধানে মুখ তুলে দেখতে লাগল।
ও-কে, ডিক, বলল একজন। চিনতে পারল রবিন, মাইস। কোমরে হাত দিয়ে, মাথা একপাশে কাত করে দেখছে লোকটা। ভাল কাজ দেখিয়েছ।
বিচিত্র একটা শব্দ করল শুধু ডিক, কথা বলল না। এক হাতে রঙের টিন, আরেক হাতে ছোট ব্রাশ। বাতাসে রঙের কড়া গন্ধ। নতুন করে নাম লেখা হয়েছে সাদা ট্রাকটায়। প্যাসিফিক স্টোরেজ কোম্পানির নাম বদলে লেখা হয়েছেঃ রিচার্ডসনস মেরিটাইম সাপ্লাইজ।
আপনমনেই হাসল রবিন। ছদ্মবেশী ট্রাক।
ব্রাশ নেড়ে ট্রাকটার দিকে ইঙ্গিত করল ডিক। এত কষ্টের দরকার ছিল?
কোন ঝুঁকি নিতে চাই না, জবাব দিল মাইস। এ-ধরনের গাড়ি নিকারোদের ওখানে দেখলেই লোকে ভুরু কুঁচকে তাকাবে।
ঘুরল মাইস। হেঁটে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল জানালা-বিহীন বিরাট বাড়িটার ভেতরে। মুহূর্ত পরে তার সঙ্গীও পিছু নিল। কিছুক্ষণ কংক্রিটের মেঝেতে শুধু কাঠ ঘষার শব্দ কানে এল রবিনের। অবশেষে আবার বেরোল মাইস। একটা ডোলিতে করে তিনটে কাঠের বাক্স নিয়ে আসছে। ট্রাকের দিকে এগোল।
ডিক বেরোল আরেকটা ডোলি নিয়ে। তাতেও একই রকম বাক্স। মাইসের মত নিরাপদে যেতে পারল সে, দুই মিটার যেতে না যেতেই গর্তে পড়ল ডোলি। ঝাঁকুনি লেগে মাটিতে পড়ে খুলে গেল একটা বাক্স। ছড়িয়ে পড়ল ডজনখানেক ছোট ছোট বাক্স।
অ্যাই, কি করছ! চিৎকার করে বলল মাইস।
ঠিক আছে ঠিক আছে, তুলে ফেলছি।
ছোট বাক্সগুলো কুড়িয়ে আবার বড় বাক্সটায় ভরল ডিকু। ডোলিতে তুলল। মাটিতে পড়ে ছোট বাক্সও দুএকটা খুলে গিয়েছিল। ভেতরের জিনিস ছিটকে পড়েছে মাটিতে। ওপর থেকে রবিন দেখলেও ডিক বা মাইস কেউই খেয়াল করেনি। দম বন্ধ করে পড়ে রইল সে, উত্তেজনায় দুরুদুরু করছে বুক ট্রাকে মাল তুলে আরও আনার জন্যে আবার বাড়িটাতে গিয়ে ঢুকল দুজনে। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এল।
প্রায় আধ ঘন্টা ধরে মাল বোঝাই করল ওরা। নানারকম বাক্স। কোনটা কাঠের, কোনটা ঢেউ খেলানো মলাটের। কোনটা এত ভারি, দুজনে ধরে তুলতেও কষ্ট হল। মাল তোলা হলে ট্রাকের দরজা বন্ধ করে হুড়কো লাগিয়ে দিল শক্ত করে।
ইহ্, মেলা পরিশ্রম, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল ডিক। আরেকজন লোক আনলে পারতাম।
না, এইই ভাল হয়েছে। কষ্ট একটু বেশি হয়েছে, তবে সাক্ষী থাকল না।
আবার বাড়িতে গিয়ে ঢুকল ওরা। অপেক্ষা করছে রবিন। পাঁচ মিনিট গেল…দশ…বেরোচ্ছে না একজনও। অনুমান করল সে, ট্রাক নিয়ে ওই দুজনের কেউ যাবে না।
হামাগুড়ি দিয়ে ভ্যানের সামনের দিকে চলে এল রবিন। নিঃশব্দে হুডের ওপর নামল, সেখান থেকে মাটিতে। দ্রুত এগোল যেখানে জিনিসগুলো পড়ে আছে। ঘাসের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে সামান্য খুঁজতেই হাতে লাগল একটা। তুলে দৈখেই চমকে উঠল। বুলেট!
মৃদু একটা শব্দ হল, বোধহয় নিঃশ্বাসের। নীরবতার মাঝে কান এড়াল না রবিনের। ফিরে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেল, যেন জমাট বরফ। ঢোক গেলার চেষ্টা করল, গলা শুকিয়ে কাঠ। এমনকি ভয়ে যে কাপবে, সেই শক্তিও নেই যেন।
তার দিকে তাকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর এক কুকুর! ডোবারম্যান পিনশার! কুকুর গোষ্ঠীর হিংস্রতম প্রাণীগুলোর একটা। মাত্র তিন মিটার দূরে। কুচকুচে কালো চোখের তারা স্থির হয়ে আছে রবিনের ওপর, কান খাড়া। ঘেউ ঘেউ করছে না। দৃষ্টি দিয়ে ঘায়েলের চেষ্টা করছে যেন অনধিকার প্রবেশকারীকে।
অ্যাইই! ফিসফিসিয়ে বলল রবিন, কুকুর! লক্ষ্মী কুকুর!
খুব ধীরে ধীরে নড়ল সে। সোজা হল। পিছাল এক পা।
ওপরে ঠোঁট উঠে গেল কুকুরটার। ভীষণ দাঁত বের করে ভেঙচি কাটল নীরবে। ধীরে ধীরে গলার গভীর থেকে বেরোল অতিচাপা গর্জন।