উঠে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে চত্বর ধরে রওনা হল অন্ধ।
আহা বেচারা! জিভ দিয়ে চুকচুক করল মহিলা। কতদূর যেতে হবে কে মানে।
এই যে, শুনুন, রবিন ডাকল। এই সাহেব।
শুনল না লোকটা। লাঠি ঠুকতে ঠকতে চলেছে।, এইই! গলা চড়াল রবিন। এগিয়ে গিয়ে চত্বর থেকে একটা মানিব্যাগ কুড়িয়ে নিল।
ততক্ষণে একটা সাইড স্ট্রীটের কাছে পৌঁছে গেছে লোকটা। লাঠির ডগা ঠুকে অনুমান করল কোথায় রয়েছে, তারপর নেমে গেল সাইড স্ট্রীটে। হেডলাইটের আলো পড়ল তার গায়ে। বেশ জোরে ছুটে আসছে একটা গাড়ি। স্টপ সাইন দেখে ব্রেক কষল, চাকা পিছলে গেল ভেজা পথে। প্রায় একই সঙ্গে চিৎকার করে উঠল রবিন আর মহিলা। আবার জোরে ব্রেক কষল কারের ড্রাইভার, কিইইচ করে আর্তনাদ করে উঠল টায়ার। পাশ কাটাতে চাইল। সরতে গিয়েও পারল না লোকটা। ধাক্কা দিয়ে তাকে রাস্তায় ফেলে দিল গাড়িটা।
থেমে গেছে গাড়ি। লাফিয়ে বেরিয়ে এল ড্রাইভার। দৌড় দিয়েছে রবিন, মহিলাও ছুটে আসছে তার পেছনে। পড়ে থাকা লোকটার ওপর একসাথে এসে ঝুঁকল তিনজনে।
হাঁটু গেড়ে পাশে বসে লোকটার হাত ধরার চেষ্টা করল ড্রাইভার।
নাআআ! চেঁচিয়ে উঠল অন্ধ। ঘুসি মারল। ঝটকা দিয়ে মুখ সরিয়ে ফেলল ড্রাইভার।
আ-আমার চশমা! রাস্তা হাতড়াচ্ছে অন্ধ।
কালো চশমাটা তুলে নিল মহিলা। ভাঙেনি। ধরিয়ে দিল অন্ধের হাতে।
চশমা পরে লাঠি খুঁজতে শুরু করল অন্ধ।
গাড়ির ড্রাইভার এক যুবক। হেডলাইটের আলোয় তার মুখের দিকে তাকাল রবিন,ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহারা, ভয়ে। লাঠিটা তুলে রাখল সে অন্ধের হাতের তালুতে।
লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল অন্ধ। মাথা নাড়ল, বঁকি দিল, হাঁটতে পারবে কিনা বোধহয় আন্দাজ করে নিল, এগোতে শুরু করল আবার সাইড স্ট্রীট ধরে। এখন খোঁড়াচ্ছে। পা ফেলেই গুঙিয়ে উঠছে ব্যথায়।
এই মিস্টার, শুনুন, ডাকল ড্রাইভার।
পুলিশকে ফোন করা দরকার, মহিলা বলল। লোকটা অনেক ব্যথা পেয়েছে।
চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে অন্ধ। লাঠি ঠুকছে, খোঁড়াচ্ছে, গোঙাচ্ছে, কিন্তু হাঁটছে আগের চেয়ে জোরে।
দৌড় দিল রবিন। থামতে বলছে।
একসারি দোকানের ওপাশে একটা গলিতে ঢুকে পড়ল লোকটা। পিছু নিল রবিন। এত অন্ধকার, প্রায় কিছুই দেখা যায় না। সামনে হাত বাড়িয়ে যেন বাতাস হাতড়ে হাতড়ে রবিনও এগোল অনেকটা অন্ধের মতই। বেশ কিছুটা দূরে একটা বাড়ির পেছনের দরজার ওপরে বাল্ব জ্বলছে। তলায় একটা ময়লা ফেলার ড্রাম। মলাটের একটা বাক্স পড়ে আছে ড্রামের পাশে, ভিজে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আরেকটা রাস্তা চোখে পড়ল রবিনের। ঘুরে আরেকদিক দিয়ে গিয়ে উইলশায়ার বুলভারে উঠেছে।
কিন্তু অন্ধকে দেখতে পেল না। বাতাসে মিলিয়ে গেছে যেন।
২
অন্ধ না-ও হতে পারে, রবিন বলল। চোখে না দেখলে এত তাড়াতাড়ি পালাল কি করে?
কেউ কেউ পারে, বলল কিশোর। চোখ হারালে কানের ক্ষমতা বেড়ে যায়। প্রায় চোখওয়ালা লোকের মতই চলতে পারে তখন। চোখওয়ালাদের অন্ধকারে চলতে অসুবিধে, অন্ধের সেই অসুবিধেও নেই।
পরদিন সকালে, পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে আগের দিন সন্ধ্যার কথা আলোচনা করছে তিন গোয়েন্দা। বৃষ্টি শেষ। উজ্জ্বল, পরিষ্কার সকাল। যে মানিব্যাগটা কুড়িয়ে পেয়েছিল রবিন, সেটা পড়ে আছে ওঅর্কশপের ওঅর্কবেঞ্চের ওপর।
ধরে নিলাম অন্ধ নয়। তাহলেও দৌড় দেবে কেন? রবিনের প্রশ্ন। এমন ভাব দেখাল, যেন আমাদের ভয় পেয়েছে। এক মুহূর্ত ভাবল সে। সবাই বোধহয় কাল বোকামি করেছি আমরা। গলি থেকে ফিরে এসে দেখি মহিলা চলে গেছে। বাস আসতেই হয়ত উঠে পড়েছে। কারের ড্রাইভার তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। অন্ধকে পাইনি, একথা জানাতেই গাড়িতে উঠে চলে গেল। হাতে মানিব্যাগটা নিয়ে গাধার মত দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। একবারও মনে হয়নি, আমার নাম, অন্ধ লোকটার নাম তাকে জানিয়ে রাখা উচিত ছিল।
একে বোকামি বলা যায় না, কিশোর বলল। ওরকম জরুরি পরিস্থিতিতে অনেকেই অমন করবে।
কাজ করতে করতে রবিনের কথা শুনছে সে। হপ্তাখানেক আগে পুরানো একটা নষ্ট টেলিভিশন সেট কিনে এনেছিলেন রাশেদ পাশা, সেটা মেরামত করছে। বাতিল পার্টসগুলো বদলে নতুন লাগাচ্ছে। কদিন ধরেই করছে কাজটা, এখন শেষবারের মত ফাইন টিউনিং করে সকেটে ঢোকাল প্লগ।
সুইচ অন করতেই মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। হুঁ, ঠিক হয়েছে মনে হয়।
হবেই, হেসে বলল মুসা। কার হাত লেগেছে দেখতে হবে না।
জবাব না দিয়ে একটা নবে মোচড় দিল গোয়েন্দা প্রধান। পুরানো যন্ত্রপাতি মেরামতের হৰি আছে কিশোরের, অসাধারণ মেধার পরিচয় দেয়। তিনটে মিনি ওয়্যারলেস সেট বানিয়েছে, যেগুলো অনেক কাজে লাগে তিন গোয়েন্দার। ওঅর্কশপের এক কোণে দাঁড়ানো ছাপার মেশিনটাও বাতিল হিসেবে কিনে আনা হয়েছিল, সারিয়ে নেয়ার পর এখন দিব্যি কাজ চলে। হেডকোয়ার্টারের ছাতে লাগানো পেরিস্কোপ সর্বদর্শন তৈরির কৃতিত্বও অনেকখানিই তার। ট্রেলারে ঢোকার গোপনপথগুলোর পরিকল্পনাও সে-ই করেছে।
মনে হচ্ছে, আবার বলল মুসা। হেডকোয়ার্টারের জন্যে একটা টিভিও হয়ে গেল আমাদের।
তাঁর কথায় বাধা দিল টেলিভিশনের ঘোষকঃ …সকালের খবর নিয়ে। উপস্থিত হচ্ছি আপনাদের সামনে।
সংবাদ-পাঠকের ছবি ফুটল পর্দায়। গুড মর্নিং জানিয়ে শুরু করল। প্রথমেই জানাল ঝড়ের খবর। প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি বিশেষ কোন ক্ষতি না করে লস অ্যাঞ্জেলেস আর দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দূরে সরে গেছে। তবু আগামী কিছুদিন আবহাওয়া অস্থির থাকবে।