কথার ফাঁকে ফাঁকে গেলাসে চুমুক দিয়েছে কিশোর। পানি প্রায় শেষ। আরেক গেলাস চাইতে পারে। কিন্তু দরকার কি? আর তেমন কিছু জানার নেই। এক ঢোকে বাকি পানিটুকু শেষ করে গেলাসটা পাশের টেবিলে রেখে দিল।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আর দেব?
না, লাগবে না। মিস্টার আমানকে আপনার কথা বুলব। বলা যায় না, কোন ছবিতে একসঙ্গে কাজ করতেও পারেন দুজনে।
ভালই হবে।
ও, এতক্ষণ কথা বললাম, আপনার নামটাই জানা হল না।
সিনথিয়া ব্যানালিস। ডাক নাম সিনথি।
ও-কে। পানি খাইয়েছেন, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
গেট দিয়ে বেরিয়ে নার্সারি স্কুলের দিকে রওনা হল কিশোর। মনে মনে খুশি। বোকার অভিনয় করে অনেক কথাই জেনে এসেছে। কিন্তু মোড় নিয়ে ডেলটন অ্যাভেন্যুতে পড়েই গুঙিয়ে উঠল।
ট্রাকটা নেই। চলে গেছে মুসা আর বোরিস, বোধহয় তার দেরি দেখেই।
দূর! দেরি করতে বলা উচিত ছিল, জোরে জোরে বলল সে। বাস ছাড়া আর উপায় নেই।
উইলশায়ারের দিকে রওনা হল সে। হাঁটতে হাঁটতেই একটা সন্দেহ মাথা চাড়া দিল তার মনে।
১০
ডেস্কের ওপাশ থেকে দুই বন্ধুর দিকে তাকাল কিশোর। লাঞ্চের পর হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে। সিনথিয়ার সঙ্গে কি কি কথা হয়েছে, জানিয়েছে দুজনকে।
ধর, কিশোর বলল। অন্ধ ভিক্ষুকটা যদি পুরুষ না হয়ে মেয়েমানুষ হয়?
এক মুহূর্ত ভাবল রবিন। মাথা নাড়ল। আমার মনে হয় না।
কিন্তু হতে তো পারে? সিনথি মেকাপ আর্টিস্ট। রোজারের সাথে পরিচয় আছে। মুসা, তোমার কথাই হয়ত ঠিক। সিনথির সঙ্গে ওই ডাকাতি, অন্ধ ভিখিরি আর মীটিঙের সঙ্গে কোন যোগাযোগ আছে।
ওই লোকটা সিনথি নয়, জোর দিয়ে বলল রবিন। খুব কাছে থেকে দেখেছি অন্ধকে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল। দু-দিন শেভ করেনি। মেকাপ করে ওরকম দাড়ি বানানো সম্ভব?
হুঁম্ম্! হতাশ হল কিশোর। যা-ই হোক, রোজারের কাছ থেকে ব্যাংকের খবর জানাটা তো কঠিন না, চেনা যখন। তারপর অন্ধ গালকাটাকে…।
কাটাটা নকল, রবিন বলল।
ভুরু কোঁচকাল কিশোর। লাইব্রেরিতে জেনে এসেছ নাকি?
হ্যাঁ, কোলের ওপর ফেলে রাখা বড় খামটা হাতে নিল। কয়েকটা ম্যাগাজিন বের করল ওটা থেকে। মেসা ডিওরো একটা দেশ বটে। ছোট, মাত্র পনেরো হাজার বর্গমাইল, লোক সংখ্যা চল্লিশ লাখের কম, কিন্তু গণ্ডগোল কম নয়। একটা ম্যাগাজিন খুলল সে। ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স পত্রিকায় কয়েক বছর আগে একটা আর্টিকেল বেরিয়েছিল। সেটারই সারমর্ম তুলে দেয়া হয়েছে এই ম্যাগাজিনে। দেশটার ইতিহাস অনেকখানি জানা যায় শুধু এটুকু পড়লেই। একসময় স্প্যানিশ কলোনি ছিল ওখানে। তারপর আঠারশো পনেরো সালে ওদেশী জমিদারেরা একজোট হয়ে উৎখাত করল ওখানকার বিদেশী সরকারকে। নতুন প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করে নর্জুন সংবিধান চালু করল।
ভাল করেছে, মুসা বলল। কিন্তু এর সঙ্গে অন্ধ আর ডাকাতের কি সম্পর্ক?
হয়ত কিছুই না। আমি ব্যাকগ্রাউণ্ড বলছি। তারপর আঠারশো বাহাত্তর সালে একটা বিদ্রোহ হয়। অনেক লোক মারা যায়। মরছে এখনও।
রবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর।
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। আঠারশো বাহাত্তরে শুরু হয়ে এখনও চলছে? তুমি বানিয়ে বলছ।
আমাকে বলতে দাও, হাত তুলল রবিন। অনেকটা ফরাসী বিপ্লবের মত। ঊনিশশো সতেরো সালে রাশিয়ায়ও হয়েছিল এরকম। মেসা ডিওরোর জমিদারেরা ভয়ানক দুর্নীতি শুরু করল। দিনকে দিন বড়লোক হতে লাগল ওরা, গরিব হল আরও গরিব। তাদেরকে কিছুই দিত না ধনীরা। অথচ এসব জমির মালিক একসময় ওই গরিবেরাই ছিল। ওরা জাতে ইনডিয়ান।
অবশেষে হুয়ান করুসসা নামে এক ইনডিয়ান একটা দল গঠন করল। বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে লাগল দেশের এখানে সেখানে। গরিবের অধিকার আদায়ের কথা বলল। তাকে ধরে জেলে পাঠিয়ে দিল কর্তৃপক্ষ।
বিপ্লবের কথা বলছিলে তুমি, মনে করিয়ে দিল কিশোর।
সেকথাই তো বলছি। সাংঘাতিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ততদিনে কসো। তাকে জেলে ভরায় লোকে গেল আরও খেপে। দলে দলে রাজধানীতে এসে চড়াও হল ওরা, জেল থেকে বের করে আনল করসোকে। প্রেসিডেন্ট অ্যারতোরো রডরিগেজকে ধরে ফাঁসি দিয়ে দিল। প্রেসিডেন্টের ছেলে অ্যানাসত্যাসিও রডরিগেজ পাল্টা আক্রমণ চালাল। অনেক রক্তক্ষয় হল, কয়েকবার সরকার বদল হল। অবেশেষে কসোই হল প্রেসিডেন্ট। অ্যানাসত্যাসিও পালিয়ে গেল মেকসিকো সিটিতে।
ওখানে ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেলেই ভাল হত, বলে যাচ্ছে রবিন। কিন্তু অ্যানাসত্যাসিও পরাজয় মেনে নিতে পারল না, রাজ্যহারা রাজার মত গুমড়াতে লাগল। কিন্তু কিছু করার ছিল না তার। জমিদাররা যারা বেঁচে রইল, তারাও পালিয়ে আসতে লাগল মেকসিকোয়, কারণ মেসা ডিওরোতে তাদের টেকা মুশকিল হয়ে উঠেছিল। শ্রমিকেরা সংখ্যা গরিষ্ঠ। ভোট দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। ধনীদেরকে বাধ্য করেছে বেশি ট্যাক্স দিতে।
হুঁ, বুঝতে পারছি শোচনীয় হয়ে পড়েছিল জমিদারদের অবস্থা,মুসা বলল।
খুবই শোচনীয়। একজোট হল আবার জমিদারেরা। পুরানো দিনের কথা মনে করে আফসোস করত তারা। বলত, আহা, কি সব দিনই না ছিল। প্রেসিডেন্ট অ্যারতোররার সময়। ওরা গঠন করল আরেকটা দল, দেশের মধ্যে থেকেই, নাম দিল সোলজার্স অভ দ্য রিপাবলিক। প্রতিজ্ঞা করল, তারা জিততে পারলে অ্যানাসত্যাসিওকে এনে প্রেসিডেন্ট করবে। পুরানো পতাকাই ব্যবহার করল ওরা, নীলের মাঝে সোনালি ওকপাতা। হুয়ান করুসসা নতুন পতাকা চালু করেছে, সবুজের মাঝে নীল।