অস্বস্তি লাগছে মুসার। এখানে তার কোন অধিকার নেই। পালিয়ে যাওয়ার জোর ইচ্ছেটা দমন করল কিশোরের কথা ভেবে, কিশোর অসন্তুষ্ট হবে। নিশ্চয় কোন ধরনের সভার আয়োজন হয়েছে এখানে, যাতে অন্ধ লোকটার কথা আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর এই সভায় টিকেটের প্রয়োজন নেই, যে খুশি আসতে পারে, মুসার অন্তত তা-ই মনে হল। তার দিকে তাকাচ্ছেও না কেউ। সন্দেহজনক কিছু না করলে তাকাবে বলেও বোধহয় না।
একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে। পাশে এসে বসল মোটাসোটা এক লোক। ওপরে ওঠার পরিশ্রমে বেজায় হাপাচ্ছে। তার দিকে চেয়ে খাতির-জুমানো-হাসি হাসল মুসা।
আরও লোক আসছে। সব চেয়ার ভরে গেল। এরপরও যারা এল, মোটেলের সিঁড়িতে, সুইমিং পুলের ধারের দেয়ালে উঠে বসতে লাগল। মোটেলের ভেতরে কোন আলো নেই। ব্যাপার কি?-ভাবল মুসা। গরমের সময় ছাড়া এই মোটেল, খোলে না নাকি?
অন্ধকার হয়ে আসছে, এই সময় একটা টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল বিল। ছবিগুলোর সামনে রাখা হয়েছে টেবিলটা। মোটেলের অফিসের পেছন থেকে মার্চ করে এগিয়ে এল তার এক বন্ধু, হাতে নীল মখমলের পতাকা, সোনালি বর্ডার, মাঝে একগুচ্ছ সনালি ওকপাতা।
গান শুরু করল এক মহিলা। যোগ দিল আরেক মহিলা। তাদের সঙ্গে গলা মেলাল এক লোক। তারপর একে একে সবাই। উঠে দাঁড়িয়ে গাইছে। মুসাও গাওয়ার ভান করছে। সুরটা তার অপরিচিত, কখনও শোনেনি। লড়াইয়ের গানের মত মনে হল তার। শেষ হল গান। গুঞ্জন শুরু হল। কেশে উঠল মুসা। চেয়ারে বসার মচমচ। টেবিলের সামনে থেকে সরে এল বিল।
তার জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল এক স্প্যানিশ ভদ্রলোক, বৃদ্ধ। দেশী ভাষায় কথা শুরু করল। মনে মনে গুঙিয়ে উঠল মুসা। স্প্যানিশ বোঝে না সে।
মোলায়েম ভঙ্গিতে আরম্ভ করেছিল, ধীরে ধীরে গলার জোর বাড়ল বক্তার। মুঠো তুলে আঁকাতে লাগল, যেন শাসাচ্ছে উপস্থিত জনতাকে। কিংবা এই মোটেলের সীমানার বাইরে কোন জনগোষ্ঠীকে।
বক্তৃতা শেষ হতেই তুমুল করতালি আর চিৎকার করে তাকে সমর্থন করল জনতা। তারপর বক্তৃতার জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল অল্পবয়েসী এক মহিলা, মাথায় লম্বা সোনালি চুল। জনতার দিকে মুখ করে চেঁচিয়ে কিছু বলল, মুসার মনে হল, শ্লোগান। আবার হাততালি, চিৎকার, শিস। মাটিতে পা ঠুকল কেউ কেউ।
মহিলা হাত তুলতেই চুপ হয়ে গেল জনতা। কথা শুরু করল সে। ভাষা না বুঝলেও মুসার অনুমান করতে কষ্ট হল না, জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা চলছে। ফ্লাডলাইটের আলোয় জ্বলছে, যেন বক্তার-চোখ। মাঝে মাঝেই হাত তুলে ইঙ্গিত করছে অন্ধ লোকটার ছবির দিকে, হুল্লোড় করে উঠছে জনতা।
বক্তৃতা শেষ হলে আবার কোলাহল। মহিলা সরল। আবার সে-জায়গায় এসে দাঁড়াল বিল। ধীরে ধীরে চুপ হয়ে গেল জনতা। তারপর, মুসাকে আতঙ্কিত করে দিয়ে লোক বাছাই করতে আরম্ভ করল সে, যাদেরকে বক্তৃতা দিতে হবে। যাদেরকে ইশারা করল, এক এক করে বক্তব্য রাখল তারা। প্রথম সারি থেকে বলল একজন লোক, তারপর মাঝখান থেকে এক মহিলা, শেষে সিঁড়িতে বসে থাকা এক কিশোর। স্প্যানিশ ছাড়া আর কিছু বলছে না। কি বলল তিনজুনে, এক বর্ণ বুঝতে পারল না মুসা।
হঠাৎ মুসার দিকে হাত তুলল বিল। সব কটা চোখ ঘুরে গেল তার দিকে।
মাথা নাড়ল মুসা। কিন্তু তাকে ঠেলে তুলে দিল পাশে বসা মোটা ভদ্রলোক।
দুঃস্বপ্ন দেখছে যেন মুসা। ভাবনাও চলছে না আর, জমে গেছে যেন মগজ।
কিছু বলল বিল। হেসে উঠল জনতা,। ওদের মুখের দিকে তাকাল সে। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে, অপেক্ষা করছে।
দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করছে তার। দ্রুত তাকাল এদিক ওদিক। চেয়ারগুলোর পাশ দিয়ে গিয়ে ড্রাইভওয়েতেও পৌঁছতে পারবে না, তার আগেই ধরা পড়ে যাবে। সে গুপ্তচর, এটা যদি বুঝে যায় ওরা…
মোলায়েম গলায় কিছু বলল পাশে বসা ভদ্রলোক। প্রশ্ন করল? নাকি হুমকি?
আচমকা গলা চেপে ধরল মুসা। হাঁ করে বিচিত্র একটা শব্দ করল। মাথা নাড়ল জোরে জোরে।
ও! বলল পাশে বসা লোকটা। ল্যারিনজাইটিস!
মাথা ঝাঁকাল মুসা, জোর করে হাসল। আবার হেসে উঠল জনতা। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সে, বসে পড়ল। তার পিঠ চাপড়ে সহানুভূতি জানাল ভদ্রলোক। অন্যদিকে চোখ ফেরাল জনতা। আরেকজন লোকের দিকে হাত তুলল বিল। সেই লোকটা উঠে কিছু বলল।
বক্ততার পালা শেষ। একটা ঝুড়ি নিয়ে এগোল বিল আর তার এক বন্ধু, দুজনে দুদিকে ধরেছে। এগোল সারির ভেতর দিয়ে। থামছে প্রতিটি লোকের সামনে। উঠে দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী কণ্ঠে জনতাকে কি সব বলছে সেই অল্পবয়েসী মহিলা। বোধহয় মুক্ত হস্তে দান করার অনুরোধ জানাচ্ছে।
মুসার সামনে যখন এল ঝুড়িটা, অনেক টাকা জমে গেছে। সে-ও ফেলল একটা ডলার। ড্রাইভওয়ে থেকে চেঁচিয়ে কি যেন বলল একজন। চোখের পলকে কোথাও উধাও হয়ে গেল ঝুড়ি।
দেখতে দেখতে জনতার সামনে দুটো গিটার আর একটা অ্যাকর্ডিয়ন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল বিল আর তার দুই বন্ধু। গিটারে টোকা দিল বিল। বেজে উঠল অ্যাকর্ডিয়ন। মিষ্টি সুরে গান ধরল অল্পবয়েসী মহিলা।
তার সঙ্গে গলা মেলাল অনেকে। আঞ্চলিক গান, সুরে বোঝা যায়।
মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল। ফিরে চেয়ে মুসা দেখল, উঠে এসেছে একজন পুলিশ, হাইওয়ে পেট্রলম্যান।
হাত নাড়ল গায়িকা। থেমে গেল সঙ্গীত।