মনে হয় আসল জায়গায় ঢিল মেরেছি! কিশোর জানাল। অফিসের বৃদ্ধা মহিলা মিসেস নিকারো। আর তরুণী তার ছেলের বৌ। সে বলল, তার শাশুড়ির স্বপ্ন নাকি সব ফলে যায়।
তারমানে বলতে চাইছ, ঘটনা ঘটার আগেই সেটা স্বপ্নে দেখে মহিলা?
হয়ত। যা ঘটে গেছে, সেটাও বোধহয় দেখে। এবার দেখেছে, একটা, মানিব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে রাখছে এক লোক, অন্ধ, হাতে লাঠি। গালে কাটা দাগ। লোকটা নাকি মহিলার জন্যে বিপজ্জনক।
যাহ্, বানিয়ে বলছ!
মোটেও না। মহিলা যা বলল, তা-ই বললাম। ভয় পাচ্ছে। ভয় ওই লোকটাও পেয়েছে, উইণ্ডব্রেকার পরা, খানিক আগে ইঞ্জিনে কাজ করছিল যে। মহিলার স্বপ্নের কথা শুনেই আঁতকে উঠেছে। নিশ্চয় অন্ধ লোকটার কথা কিছু জানে সে। এবং সেটা প্রকাশ করতে চায় না। আমাদের এই রহস্যের সঙ্গে সম্পর্ক আছে তার।
৭
মুসা নিজেই প্রস্তাব দিল, জেটির কাছে থেকে বিলের ওপর নজর রাখবে। বলল, যদি কিছু করে, দেখতে পারব। তোমাকে চিনে ফেলেছে সে। আমাকে চেনে না, কাজেই কাছাকাছি থাকা সহজ হবে। খেয়ালই করবে না।
খুব সাবধান, সতর্ক করল কিশোর।
থাকব।
সাইকেল নিয়ে রওনা হয়ে গেল কিশোর। রাস্তা পেরিয়ে সৈকতের দিকে চলল মুসা। তাপর সাইকেল ঘুরিয়ে চলে এল একটা খিলানের নিচে, পানির কিনারে। খিলানের সঙ্গে শেকল পেঁচিয়ে তালা দিয়ে রাখল সাইকেল। ভাবসাব এমন, যেন নিকারোদের ব্যাপারে কোন আগ্রহই নেই। যে-ই দেখুক, ভাববে, সাইকেল রাখার নিরাপদ জায়গা খুঁজছে।
সৈকত ধরে কিছুদূর এগোল সে, কয়েকজন মাছশিকারির পাশ কাটাল। তারপর একটা শুকনো জায়গা বেছে বসে পড়ল বালিতে। চোখ রাখল টিনার ওপর। আবার বোটে উঠেছে বিল। পেতল ঘষছে৷৷
সুন্দর কাটছে সকালটা। খিলানের কাছে সৈকতে খেলতে এল একদল ছেলেমেয়ে। ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলল মুসা। কথায় কথায় জানল, ওরা কাছাকাছিই থাকে। আরও জানল, হাইওয়ের ধারে ছোট একটা বাড়িতে বাস করে বিল। আরও দুজন বন্ধু থাকে তার সাথে। বিদেশী ভাষায় কথা বলে। সহজেই এত তথ্য জানতে পেরে খুশি হল মুসা। ভাবল, কিশোরও এরচেয়ে বেশি কিছু করতে পারত না।
কাছের একটা ছোট বাজার থেকে স্যাণ্ডউইচ কিনে লাঞ্চ সারল মুসা। আবার ফিরে এসে বসল আগের জায়গায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পাঁচটা বাজল। পাঁচটার সামান্য পরে জেটি থেকে রাস্তায় গিয়ে উঠল বিল। পিছু নিল মুসা।
রাস্তার দিকে মুখ করে আছে ছোট কটেজটা। পুরানো। দেখে মনে হয় ধসে পড়বে যে-কোন সময়। বালিতে অসংখ্য খুঁটি গাড়া, তার ওপর রয়েছে বাড়িটার পেছনের ভার। ঢুকে গেল লোকটা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুসা ভাবতে লাগল, এবার কি করবে? কি করে জানবে বিলের সঙ্গে অন্ধ ভিক্ষুকের কি সম্পর্ক?
পুরানো একটা ট্রাক বিকট গর্জন তুলে ছুটে এল হাইওয়ে ধরে। কটেজের কাছে এসে থামল। নামল এক যুবক। হাত নেড়ে ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানিয়ে, রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে ঢুকল বাড়িতে।ট্রাক চলে গেল নিজের পথে।
কয়েক মিনিট পর এল তৃতীয় আরেকজন, সে-ও যুবক। পুরানো একটা বুইক চালিয়ে। বাড়ির পাশে ঘাসে ঢাকা একটুকরো সমতল জমিতে গাড়িটা পার্ক করে রেখে গিয়ে বাড়িতে ঢুকল সে, দড়াম করে বন্ধ করল সামনের দরজা।
সৈকতে মাছশিকারির সংখ্যা কমে এসেছে। পশ্চিমে ডুব দেয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে যেন সূর্য। মুসা ঠিক করল, আর দশ মিনিট, তারপর বাড়ি রওনা হবে।
কথাটা ভেবে সে শেষও করতে পারল না, খুলে গেল কটেজের দরজা। তিনজনেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাইওয়ে ধরে এগোল। পিছু নিল মুসা। নিকারোদের বাড়ি পেরোল তিন যুবক, উঠতে শুরু করল আঁকাবাঁকা একটা ড্রাইভওয়ে ধরে। চূড়ায় একটা বাড়ি, সাগরের দিকে মুখ। সাইনবোের্ড রয়েছেঃ প্যাসিফিক মোটেল।
প্রায় চূড়ার কাছে পৌঁছে গেছে তিনজন, এই সময় একটা গাড়ি এসে মোেড় নিয়ে মোটেলের ড্রাইভওয়ে ধরে উঠতে শুরু করল। ওটার পর পরই এল আরেকটা গাড়ি, প্রথমটাকে অনুসরণ করল। তারপর এল আরেকটা, দাঁড়িয়ে গেল পথের ধারে। তৃতীয় গাড়ি থেকে একজন মহিলা আর একজন পুরুষ নেমে ড্রাইভওয়ে ধরে হেঁটে উঠতে লাগল। ঠিক তাদের পেছনেই এল মোটরসাইকেল আরোহী দই তরুণ, ইঞ্জিনের প্রচণ্ড গর্জন তুলে উঠে চলল ড্রাইভওয়ে দিয়ে।
দেখছে আর ভাবছে মুসা, অবাক হওয়ার মত কিছু আছে কি? যখন এক ভ্যান বোঝাই তরুণ তরুণী এসে হাজির হল, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে, এবার কিছু একটা করা দরকার। ছোট একটা সেডান এসে রাস্তার পাশে থামতেই হাইওয়ে পেরোল সে। গাড়ি থেকে নামল মাঝবয়েসী এক দম্পতি। তাদের সঙ্গে দুটো ছেলে, তেরো থেকে পনেরোর মধ্যে ওদের বয়েস। দম্পতির পেছনে হেঁটে চলল ছেলেদুটো। ওদের কয়েক গজ পেছনে রইল মুসা।
পরিবারটার পিছু পিছু চূড়ায় উঠে এল সে। ঘুরে এগোল মোটেলের পেছনে পার্কিং লট আর সুইমিং পুলের ধার দিয়ে। পেছন দিকের সব দরজা খোলা। ওদের মাথার ওপরে বাড়ির ছাঁইচে ইতিমধ্যেই হেসে উঠেছে উজ্জ্বল আলো। পুলের চারপাশে আর পার্কিং লটের কালো রঙ করা চত্বরের কিছুটা জুড়ে সাজানো হয়েছে ফোল্ডিং চেয়ার। পুল থেকে দূরে একটা খোলা জায়গায় রয়েছে বিল আর তার দুই বন্ধু, তাদের সামনে মস্ত ইজেলে বিশাল তিনটে ফটোগ্রাফি। সাদা-কালো একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে সাদা-চুল একজন মানুষ, পরনে নানারকম কাজ করা ইউনিফর্ম। আরেকটা রঙিন ছবি, একটা শহরের ওপর পড়েছে সোনালি উজ্জ্বল রোদ। তৃতীয় ছবিটা দেখে চমকে গেল মুসা। এটাও একজন লোকের, ধূসর চুল, গালে কাটা দাগ, চোখে কালো চশমা। রবিনের অন্ধ ভিখারির প্রতিকৃতি।