প্রায় ছুটে নেমে এল দুজনে। হাত তুলে ঝর্নার ভাটির দিকে দেখাল মুসা, ওদের বাঁয়ে।
কই? রবিন জিজ্ঞেস করল। আমি তো কিছু দেখছি না।
এখান থেকে দেখা যাবে না, কিশোর বলল। চল ওখানে যাই। ঝোপঝাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ল সে। ছুটতে শুরু করল। তার পিছে রবিন। কয়েক মিনিট পরেই সিঁড়িটা দেখল ওরাও। অনেক পুরানো, কাঠের তৈরি। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে আসা পড়ন্ত রোদে সোনালি দেখাচ্ছে। আশেপাশে ঝোপ গজিয়ে উঠেছে। পর্বতের গা থেকে অর্ধেক নেমে এসেছে সিঁড়ি, নিচের অংশ নেই।
পানির তোড়ে ভেঙে চলে গেছে, কিশোর আন্দাজ করল, কিংবা পুরানো হতে হতে আপনাআপনিই ভেঙে পড়েছে। সিঁড়ির অবস্থা খুব খারাপ।
আরেক দিক দিয়ে ঘুরে এসে ওদের পাশে দাঁড়াল মুসা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মহা ধড়িবাজ ছিল কারমলটা। ক্রিক থেকে হাজার চেষ্টা করেও দেখা যাবে না। আমি পলকের জন্যে দেখেছি রাস্তার ওপর থেকে।
আশা করি, হেসে বলল কিশোর, তোমার মত ঈগল চোখ নেই শুঁটকির। এস।
পুরানো নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে পর্বতের ওপরের একটা ভোলা চত্বরে উঠে এল ছেলেরা। বড় বড় ঘাস জন্মে রয়েছে, তৃণভূমিই বলা চলে জায়গাটাকে। অনেক দূর দিয়ে ওটার পাশ কাটিয়েছে পার্কের মেইন রোড। পঞ্চাশ গজমত দূরে একটা বাস স্টপেজ। চত্বরের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্রোঞ্জের একটা ছোট মূর্তি।
কিশোর! রবিন বলল, মূর্তিটা!
কাউবয়ের মূর্তি, দাঁড়িয়ে আছে গ্র্যানাইটের বেদির ওপর। গুলি ছোঁড়ার ভঙ্গিতে পিস্তল তুলে রেখেছে কাউবয়।
পিসটল, প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। দ্য লেডি ফ্রম ব্রিস্টল, অ্যাণ্ড অল আলোন, অর্থাৎ একা!
পিস্তলটা কোনদিক নির্দেশ করছে? নিজেকেই প্রশ্ন করল যেন কিশোর।
বেদিতে চড়ে কাউবয়ের হাতে গাল লাগিয়ে পিস্তল কোনদিকে নিশানা করছে দেখল মুসা। তারপর চোখ মিটমিট করতে করতে মাথা নাড়ল। না, তেমন কিছুই তো দেখলাম না।
রবিনও উঠে দেখল। বলল, শুধু গাছপালা।
বেদির দিকে তাকাল কিশোর। একবার চিমটি কাটল নিচের ঠোঁটে। মাথা দোলাল, হমম্। ঘোরানো যায় মূর্তিটা। ভূমিকম্প হলে ঝাঁকুনি লেগে ঘুরে যায়।
মানে? ভ্রূকুটি করল মুসা। ইদানীং তো ভূমিকম্প হয়নি।
মাথা নাড়ল কিশোর, না, ভুমিকম্পে নয়। পায়ের গোড়ায় তাজা চিহ্ন, পাথরের গুড়োও পড়ে আছে। ঘোরানো হয়েছে।
শুঁটকি! গুঙিয়ে উঠল মুসা।
তাছাড়া আর কে? গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। এটাকে ঘুরিয়ে রেখে গেছে, যাতে আমরা বুঝতে না পারি কোনদিক নির্দেশ করছে।
তাহলে পরের ধাঁধার সমাধান কি করে করব? রবিন বলল।
শুঁটকির ঘাড় চেপে ধরে।
যাওয়ার জন্যে ঘুরল ওরা। গাছের তলায় গোধূলির ছায়া। সেখান থেকে বেরিয়ে পার্কের রাস্তার দিকে ছুটে গেল একটা ছায়ামূর্তি।
আমাদের ওপর চোখ রাখছিল! রবিন বলল।
ধর ব্যাটাকে, বলেই দৌড় দিল কিশোর।
গাছপালার ভেতর দিয়ে ছুটল ওরা। সামনে রাস্তায় গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ হল। ওরা রাস্তায় পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক দূরে চলে গেল গাড়িটা।
গাড়িটা চিনেছ? কিশোরের প্রশ্ন।
না, মুসা বলল, তবে শুঁটকির নয় এটা ঠিক।
আবার তৃণভূমিতে ফিরে এল ওরা। সিঁড়ি বেয়ে ঢালে নেমে এল ওয়াইনেজ ক্রিকের কাছে। ঘনায়মান সাঝের ম্লান আলোয় সাইকেল চালাতে চালাতে রবিন বলল, কিশোর, নিশ্চয় সেই দৈত্যটা।
কিন্তু ছায়ামূর্তিটা তো ছোট দেখলাম। না রবিন, অন্য কেউ।
পথের পাশে গাছপালার আড়ালে ঘন ছায়া। সেদিকে তাকিয়ে অস্বস্তি লাগল মুসার। মনে পড়ল, টেলিফোনে হুঁশিয়ারির কথা।
শুঁটকিকে কোথায় খুঁজব? রবিন জানতে চাইল। আর ধরে জিজ্ঞেস করলেই কি বলবে নাকি আমাদেরকে?
না, বলবে না, একমত হল কিশোর। তবে উল্টোপাল্টা কথা শুরু করবে। আর বেশি কথা বলতে গিয়েই কিছু ভুল করে ফেলবে, সব সময় যা করে। চলো আগে ওর বাড়িতে দেখি। দেরি এমনিতেই হয়ে গেছে আমাদের, আর কয়েক মিনিটে কিছু হবে না।
বাড়িতে নেই শুঁটকি। তার মা বললেন, বাবার সঙ্গে নাকি কোথায় বেরিয়েছে।
এবার? রবিন বলল।
নজর রাখব ওর ওপর, বলল কিশোর। আমার মনে হয় না আজ রাতে আর গুপ্তধন খুঁজতে বেরোবে ও। রাইমিং স্ল্যাঙের কথা বলতে শুনেছে আমাদেরকে। বলা যায় না, বঁটকির পক্ষেও এখন ধাঁধার সমাধান করে ফেলা হয়ত সম্ভব।
কিশোর, মুসা প্রশ্ন তুলল। শুঁটকিকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে পারব না আমরা। ওর গাড়ি আছে। আমাদের নেই।
দরকারও নেই। ভূত-থেকে-ভূতের সাহায্য নেব আমরা।
৮
কয়েক ঘন্টা পর রিসিভার রেখে আপনমনেই বলল মুসা, যাক, ভূতকে টেলিফোন করা শেষ। পেছনে যে বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন, খেয়াল করেনি।
কি বললে? জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার আমান। ভূতকে ফোন করেছ? তোমার শরীর ভাল তো?
অ্যাঁ… না না, ভূত নয়, ভূত-থেকে-ভূতে। কিশোরের আবিষ্কার। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের খবর পৌঁছে যাবে রকি বীচের সমস্ত ছেলেমেয়ের কাছে।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত ছেলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমান। মাঝে মাঝেই দুর্বোধ্য কথাবার্তা বলে তিন গোয়েন্দা, জানা আছে তার। এ-নিয়ে আর চাপাচাপি করলেন না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, কি জানি, হবে হয়ত।
হাসল মুসা। শুঁটকির ব্যবস্থা করা গেছে। তিন গোয়েন্দার সঙ্গে লাগতে আসার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাবে এবার। শহরের কয়েকশো জোড়া চোখ এখন সর্বক্ষণ থাকবে তার ওপর। কোথায় যায়, কি করে, সব জেনে যাবে ওরা, ফোনে জানাবে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে।