- বইয়ের নামঃ দি বিগ ফোর
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী, উপন্যাস
দি বিগ ফোর
১. আমার স্বদেশ
০১.
আমার স্বদেশ ইংল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে আমার দু-চোখ জলে ভরে উঠল। জীবিকার তাগিদে আমাকে আর্জেন্টিনায় থাকতে হয়। স্ত্রীকে সেখানে রেখে, মাস কয়েকের জন্যে দেশে ফিরছি। ভেবেছি, পুরোন বন্ধু এরকুল পোয়ারোর ফ্ল্যাটে হঠাৎ হাজির হয়ে ওকে চমকে দেব।
পোয়ারো একজন বিখ্যাত গোয়েন্দা। তবে সে এখন আর রহস্যভেদের নেশায় ইংল্যান্ডের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটোছুটি করে না। গোয়েন্দা না বলে তাকে এখন কনসালটিং ডিটেকটিভ বলাই ভালো।
লন্ডনে পৌঁছে, একটা হোটেলে মালপত্র রেখে পোয়ারোর ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হয়ে তাকে চমকে দিলাম।
–আরে হেস্টিংস, বলে সে চেঁচিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরল আমাকে।
আমি তার কাছে থাকার অভিপ্রায় জানালে সে আমাকে দুঃখপ্রকাশ করে জানালো যে, দেড় বছর বাদে আমি আর্জেন্টিনা থেকে ইংল্যান্ডে ফিরলাম, আর এক ঘন্টার মধ্যে তাকে ইংল্যান্ড থেকে আর্জেন্টিনায় যেতে হচ্ছে। জাহাজ (তখনও বিমানযাত্রা এত স্বাভাবিক হয়নি) কারণ মার্কিন কোটিপতি আবে রাইল্যান্ডের সেক্রেটারী তার সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছিল, তাদের রিয়ো-ডি-জেনিরোর একটা মস্তবড় কোম্পানিতে নাকি মস্ত একটা গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। সে যেন সে সম্পর্কে রিয়োতে গিয়ে তদন্ত করে। ব্যাপারটা নাকি খুবই গোেপনীয়। তাই ঘটনাস্থলে পোয়ারোকে পৌঁছে সবকিছু জানাতে হবে। ফী হিসাবে রাইল্যান্ড নাকি বিরাট অঙ্কের টাকা দিতে রাজি হয়েছে; পোয়ারো ঠিক করেছে এই কেসটার পর আর্জেন্টিনাতে একটা সম্পত্তি কিনে বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটিয়ে দেবে।
পোয়ারো বলল, মোটা অঙ্কের টাকাটা না পেলে আমি যেতে রাজি হতাম না। কারণ, নিজেরই উদ্যোগে আর একটা ব্যাপারে আমি এখানে তদন্ত শুরু করেছিলুম। চতুরঙ্গ বলে একটা মস্ত অপরাধী সঙ্রে ব্যাপারে। ওরা সারা পৃথিবীতে জাল পেতেছে আর চারজন লোক তাদের চালাচ্ছে।
আমি পোয়ারাকে বললাম, তাহলে তোমার এখানেই থাকা উচিত, রাইল্যান্ডের কাজটাকে নাকচ করে দাও।
শুনে পোয়ারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার কথার কখনও নড়চড় হয় না, তা তো তুমি জানো। একমাত্র যদি কারো প্রাণসঙ্কট হয়, তবেই আমি থাকতে পারি।
হঠাৎ আমি উৎকর্ণ হয়ে শুনলাম, ভিতরের ঘর থেকে যেন একটা আওয়াজ এলো।
-কে, কে ওখানে?
পোয়ারো হেসে বলল, কোনো আগন্তুক হয়তো।
-কিন্তু ভেতরকার ঘরের তো একটাই দরজা। সেই দরজা দিয়ে ঢুকতে গেলে আমাদের সামনে দিয়ে ছাড়া যাবার উপায় নেই।
-বুদ্ধি খাটাও।
–ও, হা জানলা আছে বটে।
বলতে না বলতে ভিতরকার ঘরের দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। দেখলাম, সর্বাঙ্গে ধূলা-কাদা মাখা একটা পাংশু, শীর্ণ মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে তারপর মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল। ওর মুখে খানিকটা ব্র্যান্ডি ঢেলে দিলাম। জ্ঞান ফিরতে জিজ্ঞেস করলাম, কাকে চান? কী চান আপনি?
–মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো, ১৪ নম্বর ফারাওয়ে স্ট্রীট।
পোয়ারো আমাকে ডাক্তার রিজওয়েকে ফোনে ডাকতে নির্দেশ দিলো। তিনি এলেন। রোগীকে দু-একটা প্রশ্ন করতে কোনো জবাব পাওয়া গেল না। কাগজ পেন্সিল এগিয়ে দিতে সে দুর্বল হাতে গোটা গোটা অক্ষরে শুধু লিখলো : ৪, ৪, ৪, ৪ ডাক্তার বললেন, খুব সম্ভব ও লিখতে চায় ১৪; ১৪ ফারাওয়ে স্ট্রীট। যাই হোক, বিকেলে আমি ওকে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করবো। পোয়ারোর বিদেশযাত্রার কথা শুনে তিনি বললেন, ঠিক আছে, এখানে ও একাই থাকুক, ল্যান্ডলেডী যেন মাঝেমধ্যে ওকে একটু দেখে যান। তিনি চলে গেলেন।
পোয়ারো বলল, ব্যাপারটা রহস্যময়। ঠিক তখনই আমাদের অপরিচিত অতিথি হঠাৎ উঠে বসে তন্দ্রাচ্ছন্ন গলায় বলল : লি চ্যাং ইয়েন।…চতুরঙ্গের বড়কর্তা। আমি তাই নাম দিয়েছি পয়লা নম্বর। দোসরার নাম কেউ কখনও উল্লেখ করে না। তার প্রতীক হচ্ছে পেটকাটা এস–অর্থাৎ ডলার। মনে হয়, সে আমেরিকার মস্ত ধনী লোক। তিননম্বর একটি ফরাসী মহিলা। আর চার নম্বর
ব্যগ্র গলায় পোয়ারো বলল, কে সে?
-সে হচ্ছে জল্লাদ–বলতে বলতে লোকটি আবার মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল। আমরা ওকে শুইয়ে রেখে সাদামটনের ট্রেন ধরতে স্টেশনে পৌঁছলাম। কিন্তু সাদামটনের কয়েক মাইল আগে লাইন ক্লিয়ার না পেয়ে ট্রেনটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। পোয়ারো চিৎকার করে বলল, লাফিয়ে পড়ো হেস্টিংস, বলে পোয়ারো লাইনের উপর লাফ দিলো।
-সুটকেসগুলো ফেলে দাও, নেমে এসো।
নামলাম, ট্রেনও তখুনি স্টার্ট দিলো।
ব্যাপার কি? জিজ্ঞেস করতে পোয়ারো বলল, ব্যাপারটা এতক্ষণে স্পষ্ট বুঝলাম। চলো এখুনি, আমাদের লন্ডনে ফিরতে হবে।
.
০২.
আমরা একটা গাড়ি ভাড়া করে ফিরে চললাম। পোয়রো বলল, জান হেস্টিংস, চতুরঙ্গ আমাকে তাদের পথের কাটা মনে ভাবে, তাই আমাকে সরিয়ে দিতে যাচ্ছিল।
-তার মানে?
–মানে, অতি সহজ। সেই অচেনা অতিথির কোনো বিপদ ঘটবেই।
ফ্ল্যাটে ফিরলাম। ল্যান্ডলেডী দরজা খুলে দিলো। তার মুখে শুনলাম কেউ আমাদের ফ্ল্যাটে ঢোকেনি। তাড়াতাড়ি আমরা ঘরে গেলাম।
পোয়ারো আমাকে জানালো, হেস্টিংস, সে..সেই মানুষটি…মারা গেছে। মোটামুটি ঘণ্টা দুয়েক আগে সে মারা গেছে।
ডাক্তার চলে যাবার পর স্কটল্যান্ড-ইয়ার্ডে ফোন করে পোয়ারো ইন্সপেক্টর জ্যাপকে ডাকল। সে তার পুরনো বন্ধু।
খানিক বাদেই মিসেস পিয়ারসন এসে খবর দিলেন যে, হ্যাঁনওয়েলের উন্মাদাশ্রম থেকে ইউনিফরম পরা একজন রক্ষী আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
আমরা তাকে ওপরে পাঠিয়ে দিতে বললাম। সে এলো। জানালো, আমাদের গারদ থেকে একজন পাগল কাল রাতে পালিয়েছে। আপনাদের ফ্ল্যাটে সে ঢোকেনি তো?
ঢুকেছিল। সে মারা গেছে। শুনে যেন লোকটা খুশী হল। বলল, বাঁচা গেছে। এমনিতে লোকটা শান্ত ছিল। আজগুবি সব কথা বলত। বলত কে যেন এক চীনেম্যান ওকে খুন করতে চায়। প্রায় দু-বছর সে গারদে ছিল।
লোকটাকে সনাক্ত করার জন্য পোয়ারো রক্ষীকে ভিতরকার ঘরে নিয়ে গেল। সে দেখে বলল, হ্যাঁ সেই বটে। আচ্ছা এখনি চলি, মরাটাকে সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করি গে। আর তদন্ত যদি হয়, আপনাদের সাক্ষী দিতে হবে।
লোকটা চলে যাবার খানিক বাদে জ্যাপ এসে পৌঁছাল। সব শোনার পর মৃতদেহ দেখে সে চমকে উঠল, আরে এ যে মেয়ার লিং।
কে মেয়ার লিং?
–পুলিশের লোক নয়, সিক্রেট সার্ভিসের লোক। বছর পাঁচেক আগে রাশিয়ায় গিয়েছিল। তারপর আর কেউ ওর খোঁজ পায়নি। সবাই ধরেই নিয়েছিল, বিদেশে ও খুন হয়েছে।
জ্যাপ চলে যাবার পর পোয়ারো বলল, আচ্ছা হেস্টিংস, ওকে রেখে চলে যাবার সময় তুমি কি জানলাগুলো খুলে দিয়েছিলে?
-না তো। জানলা তখন বন্ধই ছিল।
তবে ঘরে ঢোকার জন্যে যদি কেউ জানলা খুলে থাকে, তাহলে মাত্র একটা জানলা খুললেই তো চলতো। তাহলে এ-ঘরের আর বসবার ঘরের সমস্ত জানলাগুলো সে খুলতে গেল কেন? আমার মনে হচ্ছে, আমরা বেরিয়ে যাবার পর কেউ এ ঘরে ঢুকে ওর মুখের ওপর প্রুসিক অ্যাসিড চেপে ধরে ওকে হত্যা করেছে।
বলো কি? পোস্টমর্টেমে এসব নিশ্চয় টের পাওয়া যাবে।
–কিচ্ছু টের পাওয়া যাবে না। নাকের ওপর প্রুসিক অ্যাসিড চেপে ধরলে মৃত্যু অনিবার্য। শুধু ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্যে একটা তীব্র গন্ধ থেকে যায়। হত্যাকারী গন্ধ হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার জন্যে জানলাগুলো খুলে দিয়েছে। শরীরে কোনো চিহ্ন না থাকার জন্যে সবাই ভাবছে এ মৃত্যু স্বাভাবিক।
মুখ তুলে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো উত্তেজনায় চীৎকার করে উঠল, ঘড়ি! দেওয়াল ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখো হেস্টিংস। চারটে বাজে, কিছু বুঝছো?
আমি ঘাড় নাড়লাম। পোয়ারো বলল, মেয়ার লিং আততায়ীর পরিচয় জানিয়ে একটা সঙ্কেত রেখে গেছে। কাটা ঘুরিয়ে বাজিয়ে, ঘড়িটাকে সে বন্ধ করে দিয়েছে। কেন? অর্থাৎ হত্যাকারী চতুরঙ্গের চার নম্বর কর্তা সেই জল্লাদ।
পোয়ারো এরপর হালওয়েল উন্মাদাশ্রমে ফোন করে জানালো সেখান থেকে কাল রাত্তিরে কোনো পাগলা পালায়নি।
ফোন রেখে পোয়ারো বলল, হেস্টিংস, আমার ধারণা উন্মাদাশ্রমের ঐ রক্ষীই হচ্ছে চার নম্বর। তুমি ভাবছো অসম্ভব। কিন্তু সবই মেকআপ আর ছদ্মবেশের ব্যাপার। খানিক বাদেই তার সাজ পোষাক, গলার আগের স্বর সবকিছু পাল্টে যাবে। একেবারে অন্য মানুষ ভবিষ্যতে কেউ চিনতে পারবে না।
-তাহলে ভবিষ্যতে দেখা হবে?
নিশ্চয়ই। প্রথম রাউন্ডে ওরা জিতে গেল। কিন্তু রাউন্ড এখনও বাকি আছে। ওরা ভেবেছিল আমাকে লন্ডন থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় সরিয়ে দেবে। তাতে ওরা হেরেছে। আর পোয়ারো যে লন্ডনে আছে, এটা ওদের কাছে নিশ্চয়ই সুখবর নয়।
.
০৩.
বলা বাহুল্য আমরা যাকে উন্মাদাশ্রমের রক্ষী ভেবেছিলাম, সে আর ফিরে আসেনি। যাই হোক, ময়না তদন্তের সময় পোয়ারো স্পষ্ট কোনো প্রমাণ নেই বলে জুরিকে বিশ্বাস করানো যাবে না এই ভেবে এবং চতুরঙ্গের কারসাজিটা আমরা টের পেয়েছি, এটা তারা বুঝতে পারলে সতর্ক হয়ে যাবে, এই সমস্ত চিন্তা করে চুপ করে রইল।
জুরি রায় দিলেন, এ মৃত্যু আকস্মিক। কয়েকদিন চুপচাপ কাটানোর পর পোয়ারো প্রস্তাব দিলো, চলো তোমাকে মিঃ জন ইনগ্লেসের কাছে নিয়ে যাই, চীনা গুপ্ত সমিতিগুলো সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট খবরাখবর রাখেন।
মিঃ ইনগ্লেসের বাড়িতে গেলাম। চীনা ভৃত্য দরজা খুলে দিল। মিঃ ইনগ্লেস বললেন, বসুন। আপনাদের চিঠি পেয়েছি। কার সম্বন্ধে খবর চান আপনারা? পোয়ারো বলল, লি চ্যাং ইয়েন সম্পর্কে।
নাম শুনে ইনগ্লেস যেন চমকে উঠলেন, বললেন চিনি, তবে যতটা চেনা দরকার ততটা নয়। পৃথিবীর একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যাবতীয় সামাজিক এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার–সে ওলট-পালট ঘটিয়ে দিতে চায়। তেমন ওলট পালট যে এখানে ওখানে ঘটছে, আমার বিশ্বাস সেটা লি চ্যাং-এর নির্দেশেই। সে চায়, পৃথিবী জুড়ে তার ক্ষমতার জাল বিছাতে। তার টাকার অন্ত নেই। বিশ্ববিখ্যাত কয়েকজন বিজ্ঞানীকেও সে হাত করেছে।
–কোথায় থাকে সে? কেউ তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করেনি?
–পিকিংয়ে থাকে। আমি যতদূর জানি চারজন তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করেছে এবং তারা এখন কেউ জীবিত নয়। প্রথমজন একটা কাগজে প্রবন্ধ লিখেছিল, তাতে সে পিকিংয়ের দাঙ্গার জন্য চ্যাং দায়ী এরকম আভাস দেওয়ায় ছুরিকাহত হয়। দ্বিতীয়জন এবং তৃতীয়জন বক্তৃতায় লি চ্যাংয়ের নামোল্লেখ করাতে তাদেরও এক সপ্তাহের মধ্যে একজনকে বিষ খাইয়ে মারা হল, অন্যজন কলেরায়; অথচ কলেরায় আক্রান্ত হবার মতো কোনো কারণই ছিল না। চতুর্থজনকেও বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কোনো আততায়ী ধরা পড়েনি। প্রমাণও কিছু থাকে না বলে মামলাগুলো আদালতে খোপে টেকে না। বছর কয়েক আগে এক অল্পবয়সী চীনা কেমিস্টের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তাকে দিয়ে জঘন্য সব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করানো হতো। সে হতাশায় ভেঙে পড়ে আমার কাছে এক রাত্তিরের জন্যে আশ্রয় চায়। আশ্রয় তাকে দিয়েছিলুম। ভেবেছিলাম রাত্তিরটা কাটলে পরেরদিন তাকে সব প্রশ্ন করবো। কিন্তু সেই রাত্তিরেই আমার বাড়িতে আগুন লাগল। সে পুড়ে মরলো। প্রমাণ কিছু নেই।
পোয়ারো বলল, দিন কয়েক আগে আমার ফ্ল্যাটেও একজন অচেনা আগন্তুকের মৃত্যু হয়। সে চারজন মানুষের code নাম দিয়েছিল। প্রথমজন লি চ্যাং; দ্বিতীয়জন এক মার্কিন কোটিপতি, তৃতীয়জন একজন ফরাসী মহিলা। চতুর্থজন–সে বলছিল একজন জল্লাদ। আপনি চতুর্থজনের নাম শুনেছেন?
শুনেছি। আমার এক আলাপী বন্ধু আছে, লোকটি পাঁচ মাতাল, ভবঘুরে গোছের। হাতে কিছু পয়সা জমলেই সে জাহাজে উঠে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াত। সম্প্রতি সে আমাকে একটা চিঠি লিখেছে, তাতে সে আমার কাছে অবিলম্বে দুশো পাউন্ড চেয়ে পাঠিয়েছে। টাকাটা না পাঠলে সে নির্ঘাত চতুরঙ্গের হাতে মারা পড়বে। কেননা টাকা তার আছে কিন্তু সে টাকা তুলতে গেলেই সে মারা পড়বে। তার ঠিকানা হল, গ্লানিট বাঙ্গলো, হপাটন, ডার্টমুর। সত্যি বলতে কি আমি টাকা পাঠাইনি, আমি জানি এটা তার কিছু টাকা হাতাবার কারসাজি। কিন্তু এখন ব্যাপারটা আপনাদের কি মনে হচ্ছে?
-খুবই গুরুতর মঁসিয়ে। এক্ষুনি আমরা হপাটনের দিকে রওনা দেব।
–আমি যদি যাই আপত্তি আছে?
–কিছুমাত্র নয়? পোয়ারো বলল।
হপাটন স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে প্রথমে একজন বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলাম, গ্রানিট বাঙ্গলোটা কোনোদিকে?
-কেন? পুলিশ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে দেখা করতে চান? এই বাড়িতে একটা খুন হয়ে গেল যে।
–কে খুন হয়েছে?
–কেন, বাড়ির মালিক। বৃদ্ধের জবাব, নাম জোনাথন হোয়েলি।
আমরা কিছুমাত্র সময় নষ্ট না করে তক্ষুনি গ্রানিট বাঙ্গলোয় পৌঁছালাম। আমরা জ্যাপের বন্ধু শুনে তিনি বললেন, আসুন আজ সকালেই খুনটা হয়েছে। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছিল প্রায় সত্তর।
আমরা ঘরে পৌঁছে দেখলাম, মেঝের উপর গলা কাটা একটা লাশ পড়ে। চারদিকে রক্ত ভাসছে। ইন্সপেক্টর মেডোজ বলতে লাগলেন, এ বাড়িতে যে মেয়েটা রান্না করে তার নাম বেটসী। সে স্থানীয় বাসিন্দা। বাড়ির অপর মানুষ হল চাকর রবার্ট গ্রান্ট। সে সকালে দুধ আনতে গিয়ে পড়শীর সঙ্গে মিনিট কুড়ির মতো গল্প জুড়েছিল। এই ধরুন দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে মিনিট কুড়ি। খুনটা হয় তারই মধ্যে। গ্রান্ট প্রথমে ফিরে আসে। তারপর আসে বেটসী। গ্র্যান্ট নিজের ঘরে চলে যায়। বেটসীই প্রথম দেখতে পায় কর্তা খুন হয়েছে। সে চীৎকার করে ওঠে। অর্থাৎ খুনের সময় দুজনেই বাইরে ছিল। অন্ততঃ তাদের কথানুযায়ী। আমরা আমাদের কাজ শুরু করলাম। রক্তের ওপর জুতোর ছাপ ধরে আমি গ্রান্টের ঘরে পৌঁছলাম। দেখলাম, তার জুতোর সঙ্গে ছাপ মিলে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়। বৃদ্ধ জোনাথনের কতকগুলো চীনা পুতুল ছিল। যেগুলো সে আগলে রাখতো, সেই পুতুলগুলো গ্রান্টের ঘর থেকে পাওয়া গেল, তার ঘরে পাওয়া কাগজপত্র থেকে জানা গেল তার আসল নাম আব্রাহাম বিগস। চুরির দায়ে ওকে এর আগে একবছর জেল খাটতে হয়েছিল। সুতরাং তাকে আমরা গ্রেফতার করলাম।
হুম, পোয়ারো বলল, এর আগে কোনো খুনীকে এত প্রমাণ রেখে বোকার মতো কাজ করতে দেখিনি। যাই হোক, চলুন, তার ঘরটা একবার দেখে অসি। আমি ঈষৎ চাপা গলায় পোয়ারোকে প্রশ্ন করলাম, ব্যাপার কি এরকুল, এর মধ্যে আবার কোনো রহস্যের গন্ধ পেলে নাকি?
–ব্যাপারটা একবার চিন্তা করে দেখ। হোয়েলি তার চিঠিতে লিখেছিল চতুরঙ্গ তার পিছু নিয়েছে। কিন্তু গ্রান্ট যদি সত্যিই চতুরঙ্গের লোক হতো তবে কি সে পুলিশের হাত ধরা পড়ার জন্যে বসে থাকত। তাও এমনভাবে প্রমাণ সাজিয়ে? না, হেস্টিংস আমি হয়তো জুতোর ছাপ মাপবো না; কিন্তু বুদ্ধি খাটাবো।
.
০৪.
লাশ সরিয়ে নেবার পর ইন্সপেক্টার আমাদের ঐ ঘরে বসতে বললেন। গ্রান্টের জুতোজোড়া এনে বললেন, এই জুতোর সঙ্গে মেঝের ছাপ মিলিয়ে নিতে পারেন। আমি একটা কাজ সেরে আসছি, বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
ইন্সপেক্টর বেরিয়ে যাবার পর আমরা দেখলাম লাশটার জায়গা থেকে দু-সারি ঢুকবার আর দু-সারি বেরিয়ে যাবার দাগ রয়েছে। ছাপ জুতোজোড়ার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে।
পোয়ারো বলল, হুম, খুনী যদি খুন করে বেরিয়ে যায়, তো দুসারি দাগ থাকবে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে দু-সারি ঢোকার, দু-সারির বেরিয়ে যাবার দাগ। তবে কি খুনী বেরিয়ে যাবার পর আবার কিছু নিতে দ্বিতীয়বার এঘরে ঢুকেছিল? ঐ পুতুলগুলো? পুতুলগুলো তো গ্রান্টের ঘরে পাওয়া গেছে।
ঘুরতে ঘুরতে আমরা ভাড়ার ঘরে ঢুকলাম। সেখানে পোয়ারো বরফের কুচি মাখানো একখানা খাসীর ঠ্যাং আবিষ্কার করে চীৎকার করে উঠল। খুব সম্ভবত কসাই-এর ডেলিভারি দিয়ে গেছে। সেটা আবার আলমারীতে সে রেখে দিল। আমরা আবার বসবার ঘরে গিয়ে বসলাম। ইতিমধ্যে ইন্সপেক্টর মেজাজে এসে গেলেন।
পোয়ারো আমাকে জিজ্ঞেস করল, হেস্টিংস আজ কি বার?
–সোমবার।
-খুনীরা এটুকু বোঝে না যে, সপ্তাহের প্রথম দিনে, উষ্ণতা সত্তর ডিগ্রী ফারেনহাইট তখন অন্ততঃ কসাইয়ের ছদ্মবেশে খুন করতে নেই।
তার কথার মাথামুণ্ড কিছুই আমাদের মাথায় ঢুকল না। এরপর পোয়ারো ইন্সপেক্টর মেডোজের দিকে তাকিয়ে বললো, একটা অনুরোধ, আমি একবার গ্রান্টের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তারজন্যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অনুমতি আমি আনিয়ে দেব। সাক্ষাৎটা খুবই জরুরী। আমি জানি গ্রান্ট খুনী নয়। যে খুন করেছে সে অল্পবয়সী। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে, হাতে ছোরা নিয়ে ঢুকেছিল। তারপর হোয়েলের গলায় ছোরা বসিয়ে, বেরিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে সে চলে যায়।
তাই যদি হতো, কেউ তাকে দেখতে পেত না?
-ইন্সপেকটর মেজােজ, পরে আপনাকে সব বলব, আপাততঃ এটুকু জেনে রাখুন, খুনীকে সবাই লক্ষ্য করেছে কিন্তু নজর করেনি।
সবাই মিলে থানায় গেলাম। আমি আর পোয়ারো গ্রান্টের কাছে গিয়ে, তাকে সব কথা খুলে বলতে লাগলাম, যদি সে জেল থেকে ছাড়া পেতে চায়।
গ্রান্ট অনেক ইতস্ততঃ করে বলল, আমি দুধ নিয়ে এসে সরাসরি কর্তার ঘরে ঢুকেছিলুম। কর্তা খুন হয়েছেন দেখে, আমি ভাবলাম আমার পালানো উচিত। কারণ আমি এর আগে চুরির দায়ে বারকয়েক জেল খেটেছি। তাই তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে এলুম। ইতিমধ্যে বেটসী এসে চীৎকার করে ওঠায় সকলে চলে আসে। যার ফলে আমি আর পালাতে পারিনি।
–আর ঐ পুতুলগুলো? ওগুলো তোমার ঘরে এলো কি করে?
গ্রান্ট একটু লজ্জিতভাবে জানালো, ওগুলো কর্তার ঘর থেকে বেরোবার সময় নিজের ঘরে নিয়ে চলে আসি।
মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, স্বভাব যায় না মলে। তোমার মনে হল, পালাবেই যদি, তখন একটা কিছু হাতিয়ে পালানো যাক। যাকগে এবার বলল একাজটা তোমাকে কে জুটিয়ে দিয়েছিল।
-এক ভদ্রলোক, নাম সণ্ডার্স। তার মাথায় কালো টুপী আর চোখে চশমা ছিল। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করে বলেন যে, আমি যদি সৎপথে থাকি তাহলে তিনি একটা কাজ জুটিয়ে দেবেন।
পোয়ারো বলল, আর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় তোমার নিশ্চয়ই একজোড়া জুতো কেনবার পয়সা ছিল না। তাই মিঃ সণ্ডার্স তোমাকে একজোড়া জুতো দান করেছিলেন, তাই না? গ্রান্ট অবাক হয়ে বলে, হ্যাঁ দিয়েছিলেন। সেই জুতোই আমি পরতুম।
হাজত থেকে বেরিয়ে–আমি, পোয়ারো আর মিঃ ইনগ্লেস একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম।
ইনগ্লেস বললেন, কী, রহস্য পরিষ্কার হল?
-জলের মতো পরিষ্কার। এ কাজ যে চতুরঙ্গের; তাতে কোনো সন্দেহই নেই। সণ্ডার্স আসলে ওদের লোক। খুনের পরিকল্পনা করেই সণ্ডার্স একই সাইজের দু-জোড়া জুতো কেনে এবং গ্রান্টকে একজোড়া দেয়। নিজে সেই জুতো পায়ে দিয়ে আসে এবং খুন করে জুতোজোড়াকে হাতে ঝুলিয়ে গাড়িতে ওঠে। ঘরের মধ্যে দু-জোড়া একই রকম ছাপ দেখেছি কারণ দু-জোড়া জুতোই একই রকমের।
ইনগ্লেস বললেন, কিন্তু দিনদুপুরে তাকে কেউ দেখতে পেল না?
মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, খুনী এসেছিল কসাইয়ের ছদ্মবেশে। দৃশ্যটা এতই স্বাভাবিক ছিল যে কেউ নজর করে দেখেনি।
আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললাম, খাসীর ঠ্যাংটা দেখে তুমি সব বুঝতে পেরেছো, তাই না?
–ঠিক। গতকাল ছিল রবিবার, কসাইয়ের দোকান বন্ধ থাকে। অথচ ও মাংস শনিবারের হওয়াও সম্ভব নয়, কারণ এই সত্তর ডিগ্রী ফারেনহাইট টেম্পারেচারে মাংসের গায়ে নিশ্চয়ই বরফের কুচি লেগে থাকত না। সণ্ডার্স তার ছদ্মনাম এবং বেশটাও ছদ্মবেশ।
.
০৫.
খুনের আসামী হিসেবে রবার্ট গ্রান্টকে আদালতে পেশ করা হয়েছিল, কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ ছিল, এরকুল পোয়ারোর সাক্ষ্যের পর সেগুলি আর ধোপে টিকলো না।
সপ্তাহ কয়েক পরের কথা। পোয়ারোর ফ্ল্যাটে একদিন সকালবেলায় কথাবার্তার সময় ইন্সপেক্টর জ্যাপ এসে হাজির। তার সঙ্গে আর একজন ভদ্রলোক।
জ্যাপ বলল, মঁসিয়ে পোয়ারো, এই ভদ্রলোকের নাম ক্যাপ্টেন কেন্ট। ইনি মার্কিন সিক্রেট সার্ভিসের একজন কর্মী। ইনি আপনাকে কিছু বলতে চান। ক্যাপ্টেন কেন্ট বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি জানি আপনি খুবই ব্যস্ত মানুষ। তাই কোনো ভূমিকা না করেই বলি, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে, মাস কয়েক আগে আমেরিকার উপকূলের কাছে পরপর কয়েকটা জাহাজডুবি হয়েছিল। তার ঠিক আগেই জাপানে ভূমিকম্প হয়। আমরা ভূমিকম্পের ফলে জলস্ফীতির, কারণে জাহাজডুবি হয়েছে বলে মেনে নিলাম। তার কিছুদিন পরে একদল দুবৃর্তের কাছ থেকে যে সব কাগজপত্র পাওয়া যায়, তাতে বলতে পারি জাহাজডুবির অন্য কোনো কারণ থাকা সম্ভব। আরও জানতে পারি চতুরঙ্গ নামে একটা সংগঠনের কাছে এমন একটা অস্ত্র আছে যা দূর থেকে মারণ রশ্মি বিকিরণ করে কোনো বস্তুকে ধ্বংস করে দিতে পারে। আমরা এ ব্যাপারে খোঁজখবর করার চেষ্টা করেছি। শেষ পর্যন্ত আমাকে আমেরিকা থেকে ব্রিটেনে পাঠানো হয়। আমাকে একজন বিজ্ঞানীর কাছে পাঠানো হয়েছে। সেই বিজ্ঞানী এক বিজ্ঞান সম্মেলনে বক্তৃতায় বলেন, মারণরশ্মি আবিষ্কার করা এবং অস্ত্র হিসেবে তাকে কাজে লাগনো মোটেই অসম্ভব ব্যাপার নয়।
ক্যাপ্টেন থামতেই পোয়ারো বলল, বিজ্ঞানীর নাম কী?
–মিঃ হ্যালিডে। এঁর বয়স খুব অল্প।
–তার সঙ্গে দেখা করেছেন?
–না। সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছেন।
চমকে উঠে পোয়ারো প্রশ্ন করল, কতদিন আগে তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিল?
-প্রায় ছ-মাস হবে।
পোয়ারো এবারে ইনস্পেক্টর জ্যাপের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইন্সপেক্টর, এই ভদ্রলোকটি নিখোঁজ হবার পর তার আত্মীয় স্বজনরা কি পুলিসকে সে কথা জানিয়েছিল?
জ্যাপ বলল, হ্যাঁ, তার স্ত্রী নিজে আমাদের কাছে এসে বিস্তর কান্নাকাটি করেছিলেন।
-কেন?
–মুচকি হেসে জ্যাপ বলল, প্যারিসে গিয়ে যারা নিরুদ্দেশ হয়, তাদের কখনও পাওয়া যায় না।
প্যারিসেঃ মিঃ হ্যালিডে কি প্যারিসে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন নাকি?
–হ্যাঁ, এতে অবাক হবার কি আছে?
–অবাক হচ্ছি…কারণ মেয়ারলিং-এর কথানুযায়ী চতুরঙ্গের তিননম্বর কর্তা একজন ফরাসী মহিলা! এখন তুমি শুধু মিসেস হ্যালিডের ঠিকানাটা আমাকে দাও। কালই তার সঙ্গে আমি দেখা করব।
জ্যাপ ঠিকানাটা একটা কাগজে লিখে দিয়ে বিদায় নিল।
পরদিনই আমরা মিসেস হ্যালিডের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তার পাশেই দাঁড়িয়ে বছর পাঁচেকের একটি ফুটফুটে মেয়ে। তার একমাত্র সন্তান।
মিসেস হ্যালিডে বললেন, দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার খ্যাতির কথা আমি শুনেছি। ফরাসী পুলিশের ধারণা, প্যারিসে গিয়ে আমার স্বামী কোনো ফরাসী সুন্দরীর প্রেমে পড়েছেন এবং গা ঢাকা দিয়েছেন কিন্তু আমার স্বামী ছিলেন সত্যিকারের বিজ্ঞানসাধক।
পোয়ারো বললেন, মাদাম, আমি আপনার স্বামীকে খুঁজে বার করব, কথা দিচ্ছি। এখন বলুন আপনার স্বামী কবে প্যারিসে গিয়েছিলেন? কি কাজে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আপনাকে কোনো চিঠি দিয়েছিলেন কিনা, দয়া করে সব খুলে বলুন।
-আমার স্বামী ২০শে জুলাই প্যারিস যান। বৃহস্পতিবার। কথা ছিল, প্যারিসে পৌঁছে তিনি মাদাম অলিভিয়ের এবং আরও কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে দেখা করবেন।
-তারপর? প্যারিসে গিয়ে আপনার স্বামী কোথায় উঠেছিলেন?
-সন্ধ্যা নাগাদ প্যারিসে পৌঁছে তিনি ক্যাস্তিলিয়ন হোটেলে ওঠেন। পরদিন সকালে তিনি অধ্যাপক বুর্গোনুর সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি কাফে রয়্যাল-এ যান এবং সেখানে লাঞ্চ সারেন। টুকিটাকি কাজ সেরে যান প্যাসি অঞ্চলে। সেখানে মাদাম অলিভিয়ের সঙ্গে দেখা করে তিনি বিকেল ছটা নাগাদ আবার পথে বেরিয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় তিনি কোথায় গিয়েছিলেন তা কেউ জানে না। রাত এগারোটা নাগাদ তিনি হোটেলে ফিরে জিজ্ঞেস করেন তার নামে কোনো চিঠি এসেছে কিনা। এরপর তিনি নিজের ঘরে চলে যান। পরদিন সকালে তিনি হোটেলে থেকে বেরিয়ে যান। তারপর আর কেউ তাকে দেখেনি।
–সকালে কটার সময়ে তিনি হোটেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন?
–খুবই সকালে।
–এমনও তো হতে পারে যে, সকালে নয়, রাত্তিরে হোটেলে ফিরে এসে আবার রাত্তিরেই তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন?
-না, আমার তা মনে হয় না। হোটেলে সারারাত দারোয়ান থাকে, সে নিশ্চয়ই তাহলে লক্ষ্য করত।
-ঠিক কথা। তার মালপত্র কি হোটেলেই পড়েছিল?
-না, সব মালপত্র নয়। হোটেল থেকে বেরিয়ে যাবার সময় তাঁর সঙ্গে একটা সুটকেশ ছিল। পোয়ারো বলল, মাদাম, আপনার স্বামী নিরদ্দেশের সন্ধ্যাটা কোথায় কাটিয়েছিলেন, সেটা জানলে অনেকখানি জানা যাবে। আচ্ছা সেদিন হোটেলে কি কোনো চিঠি এসেছিল?
-হ্যাঁ, আমার মনে হয় সে চিঠি আমারই লেখা। তার প্যারিস যাত্রার দিনই আমি তাকে একটা চিঠি পাঠাই।
শুনে পোয়ারো কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। বললেন, আমার মনে হয় এখানে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। কালই আমি প্যারিসে যাব।
বিদায় নেবার আগে পোয়ারো মিসেস হ্যালিডেকে জিজ্ঞেস করলেন, মাদাম, আপনার স্বামী কখনও আপনার কাছে চতুরঙ্গ নামে কোনো সমিতির কথা বলেছেন?
-চতুরঙ্গ? এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মাদাম বললেন, না, এমন নাম কখনও শুনেছি বলে আমার মনে হয় না।
.
০৬.
প্যারিসে পৌঁছে আমরা অধ্যাপক বুর্গোনুর সঙ্গে দেখা করলাম। তার থেকে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। পোয়ারোর সন্দেহ যে, হ্যালিডেকে গুম করে দেওয়া হয়েছে, গুম করেছে চতুরঙ্গ।
এরপর আমরা গেলাম মাদাম অলিভিয়ের বাড়িতে, অবশ্যই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে। দীর্ঘাঙ্গী মুখখানি লম্বা শীর্ণ, গালের উপরে একটি পোড়া দাগ। বছর তিনেক আগে তার ল্যাবরেটরিতে একটা মারাত্মক বিস্ফোরণে মাদামের স্বামী মারা যান। গালের ঐ দাগটা বোধহয় তারই স্মৃতিচিহ্ন।
মাদাম জানালেন যে, তিনি দুঃখিত, হ্যালিডের নিখোঁজের ব্যাপারে তিনি আমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবেন না।
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলো, মঁসিয়ে হ্যালিডে তার বিজ্ঞান সম্মেলনের বক্তৃতায় যে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রের কথা বলেছিলেন, আপনি কি মনে করেন যে, তা তৈরি করা সম্ভব?
–অবশ্যই সম্ভব। এ বিষয়ে আমিও কিছু গবেষণা করেছি। রেডিয়াম-সি-নামক পদার্থ থেকে যে রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়, তার আকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে এমন কিছু রহস্য আমার কাছে ধরা পড়েছে, যার ফলে, মঁসিয়ে হ্যালিডের কথাকে মোটেই আজগুবি বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। তার গবেষণা সম্পর্কে আমার আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। সেই বিষয়েই আমাদের আলোচনা হয়েছিল ঐদিন।
-আপনারা ল্যাবরেটরি একবার দেখতে পারি?
–বিলক্ষণ। আমাদের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাওয়া হলো। যে দরজা দিয়ে আমরা ঢুকেছিলাম সেটা ছাড়া ল্যাবরেটরিতে আরও দুটি দরজা রয়েছে। একটি দিয়ে বাগানে যাওয়া যায়, অন্যটি দিয়ে ছোট্ট চেম্বারে।
মাদাম, পোয়ারো প্রশ্ন করল, মঁসিয়ে হ্যালিডের সঙ্গে যখন আপনার কথা হয় কেউ শুনেছিল।
-না, আমার সহকারী দুজন এঘরে ছিল না। তারা পাশের ঐ ছোট্ট চেম্বারে ছিল। সেখান থেকে কোনো কথা শোনা সম্ভব নয়।
-আচ্ছা মাদাম, মঁসিয়ে হ্যালিডে আপনার এখান থেকে বিদায় নেবার পর কোথায় থাকবেন সে বিষয়ে কিছু বলেছিলেন?
-না।
আমরা বিদায় চাইলাম। ল্যাবরেটরি থেকে আমরা হলঘরে বেরিয়ে দেখি, হলঘরের সদর দরজা দিয়ে একজন মহিলা এসে বাড়ির মধ্যে ঢুকেছেন। মুখটা দেখা গেল না। তাঁর স্বচ্ছন্দ হাঁটাই বলে দিচ্ছে তিনি ঐ বাড়ির বাসিন্দা।
কম্পাউণ্ডে বেরিয়ে পোয়ারো বলল, অদ্ভুত মহিলা।
আমি বললাম, ওঁর মুখটা পর্যন্ত তুমি না দেখে অদ্ভুত মহিলা কিভাবে বলছো?
–একথা মনে হবার কারণ এই যে, ওঁর হাতে ছিল চাবির গোছা। এখন বাড়ির বাসিন্দা যদি বাড়ির মধ্যে ঢুকে গিয়ে দেখে যে, ভিতর থেকে দুজন অপরিচিত মানুষ বেরিয়ে যাচ্ছে, তাহলে তাদের সম্পর্কে কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক, এক্ষেত্রে উনি আমাদের দিকে তাকালেন না পর্যন্ত। আচরণটা একটু অদ্ভুত। কিন্তু এ কি…সরে যাও…সরে যাও।
ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিতেই দেখি একটা মস্ত গাছ ভেঙে পড়ল আমাদের ঠিক পাশেই।
পোয়ারো বলল, একটুর জন্যে বেঁচে গেলাম। চতুরঙ্গ জানে না আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সোজা নয়। আমি পোয়ারোকে বলি, এখন আমরা কি করব?
–চিন্তা করি। শুক্রবার রাত্রে দারোয়ান তাকে শেষ দেখা দেখেছিল। কিন্তু দারোয়ানতো তাকে আগে কখনও দেখেনি। চতুরঙ্গের চারনম্বর কর্তাটি একটি পাকা অভিনেতা। সে সেদিন রাত্রে হ্যালিডের ঘরে ঢুকে রাত কাটিয়ে পরদিন বেরিয়ে যায়। খুব সম্ভব বিকেলবেলাতেই হ্যালিডে চতুরঙ্গের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে হ্যালিডে মাদামের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে তার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। তারপর?
হঠাৎ পোয়ারো আমার হাত চেপে ধরে বলল, চলো হেস্টিংস এবার নিরুদ্দেশ নাটকের দৃশ্যে অভিনয় করা যাক।
মাদামের বাড়ির প্রবেশপথের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে পোয়ারো বলল, এবারে আমরা পথে নামব। হ্যালিডে যেমন নেমেছিলেন।
খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পোয়ারো বলল, পথ এখানে ডাইনে মোড় নিয়েছে। হয়তো এপথে এগোতেই হ্যালিডেকে খুব সম্ভব কোনো নারী এসে বলেছিল, মঁসিয়ে মাদাম অলিভিয়ের আপনাকে আর একবার ডেকেছেন। শুনে হ্যালিডে যেতে রাজী হলেন। মেয়েটি তখন তাকে এদিকে এই নির্জন পথে নিয়ে গেল। আর হ্যালিডেকে বলেছিল, এইপথে আসুন শর্টকাট হবে, এবার জনাকয় লোক হ্যালিডের ওপর চড়াও হয়। তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যায় ওপাশের ঐ বাড়িটার দিকে।
-তাহলে এখন আমাদের কর্তব্য কি?
এখন আমরা ঐ মহিলার সঙ্গে দেখা করব যিনি আমাদের মুখটা পর্যন্ত দেখাতে চাননি। ঐ মহিলাই হয়ত মাদামের সেক্রেটারি।
মাদামের বাড়িতে বেল টিপে আমরা ঐ মহিলার বর্ণনা দিতে দারোয়ান তাকে ডেকে দিল। তিনি নিঃশব্দে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াতে আমরা অবাক হয়ে গেলাম? এ যে আমাদের পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্টেস রসাকোফ। পোয়ারো বলল, কাউন্টেস রসাকোফ…
শ শ শ, এখানে আমাকে ও-নামে ডাকবেন না। আমার নাম এখন ইনেজ ভেরোনু। আপনার জ্বালায় লন্ডন থেকে পালিয়ে প্যারিসে এলাম, এখানেও নিস্তার নেই। আমার আসল পরিচয় ফাস করে দিয়ে চাকরীটা খতম করার জন্যে এখানে এসেছেন?
-না, মাদাম। আমি ওদিককার বাড়িটায় একবার ঢুকতে চাই। আমি জানি মঁসিয়ে হ্যালিডেকে ওখানে রাখা হয়েছে। আমি ওঁকে উদ্ধার করে আনতে চাই।
–তিনি ও বাড়িতে নেই।
–কোথায় আছেন?
–যদি না বলি।
-তাহলে হেস্টিংসকে আপনার পাহারায় দেখে পুলিশে জানাব, লন্ডনে আপনার নামে গোটা পাঁচেক মামলা ঝুলছে।
একথার পর কাউন্টেস ফোন তুলে বলল, কে, আঁদ্রে? আমি ইনেজ বলছি। এখানে। বেলজিয়াম গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো ঝামেলা বাঁধিয়েছে। তোমরা যদি হ্যালিডেকে ছেড়ে না দাও তাহলে আমি বিপদে পড়ব। তাকে হোটেলে পৌঁছে দাও। কাউন্টেস বলল, এবারে আপনি খুশী তো।
না। আপনাকে আমাদের সঙ্গে হোটেলে যেতে হবে। ওখানে হ্যালিডেকে দেখলে আপনাকে ছেড়ে দেব।
কাউন্টেসকে নিয়ে হোটেলে গিয়ে হ্যালিডেকে আমাদের ঘরে দেখতে পেলাম। পোয়ারো তার বাঁ হাতের একটা জড়ুল চিহ্ন পরীক্ষা করে নিল।
এবার কাউন্টেসের দিকে ফিরে পোয়ারো বলল, মাদাম, এবার আপনি যেতে পারেন। একটা প্রশ্ন, আপনার সঙ্গে চতুরঙ্গের যোগাযোগ ঘটল কবে থেকে।
মাদাম কোনো উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
আমরা এবার হ্যালিডের কাছে সব জানতে চাইলাম। তিনি বলেন, আমার কিছুই বলার নেই। আমার উপর কী অত্যাচার যে গেছে, তা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। মঁসিয়ে পোয়ারো চতুরঙ্গের নাম আপনি শুনেছেন?
–শুনেছি।
–তারা যে কতখানি শক্তিশালী আর নিষ্ঠুর আপনি জানেন না। আমি যদি তাদের সম্বন্ধে একটা কথাও ফাস করি, তাহলে শুধু আমাকে নয়, আমার স্ত্রী কন্যাকেও হত্যা করা হবে। অতএব আমার বলার কিছুই নেই।
চেয়ার থেকে উঠে হ্যালিডে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলেন।
কাউন্টেস বেরিয়ে যাবার পর আমি একটা চিরকূট পেলাম। পোয়ারো বলল, ইচ্ছে করেই ফেলে যাওয়া হয়েছে, ওটা।
চিরকুটে লেখা, আবার দেখা হবে। I.V.”।
মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, I.v. অর্থাৎ ইনেজ ভেরোনু। কিন্তু, রোমান হরফে ওটা চার-ও হতে পারে। চার হচ্ছে চতুরঙ্গের প্রতীক। শুনে শিউরে উঠলাম।
.
০৭.
পরদিনই হ্যালিডে ইংল্যান্ডে ফিরে গেলে। আমি আর পোয়ারো প্যারিসেই রইলাম।
আমি পোয়ারোকে বললাম, দোহাই পোয়ারো, এবারে উঠে পড়ে লাগো।
-কার বিরুদ্ধে আমরা উঠে পড়ে লাগব
–কেন চতুরঙ্গের বিরুদ্ধে।
-ভালো, কিন্তু চতুরঙ্গের ঘাঁটি কোথায়, ওদের বিরুদ্ধে অস্পষ্ট কোনো প্রমাণও আমাদের হাতে নেই। তার চেয়ে চুপচাপ আঘাতের প্রতীক্ষায় বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। কেননা, তাদের প্রতিটি কাজই আমাদের জন্য হাসিল হচ্ছে না। সুতরাং আমাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা তারা করবেই।
পোয়ারোর কথার মধ্যেই একটি অপরিচিত লোক আমাদের ঘরে এসে ঢুকল। গায়ে। ওভারকোট, টুপিটা চোখ অবধি নানামো।
–অনুমতি না নিয়ে ঢোকার জন্যে ক্ষমা করুন। আমি একটা দরকারে আপনার কাছে এসেছি মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি আমার বন্ধুদের কাজে বাধা দিচ্ছেন কেন?
–কে আপনার বন্ধু?
লোকটি টেবিলের ওপর চারটি সিগারেট পাশাপাশি সাজালো। মুখে কিছু বলল না।
পোয়ারো বলল, বুঝেছি। কিন্তু চতুরঙ্গ আমার কাছে কী চায়?
–তারা চায় ছোট খাট চুরি-ডাকাতির কেস নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। রাঘব-বোয়ালদের ঘাঁটাতে যাবেন না।
–তাদের অনুরোধ যদি না শুনি?
–বড়ই কষ্ট পাবে আমাদের বন্ধুরা। কিন্তু তাতে কি কোনোও মৃত মানুষ জীবিত হয়?
সোজাসুজি বল, তাহলে আমাকে হত্যা করা হবে এই তো? আর যদি অনুরোধ শুনি, তার বিনিময়ে কি পাব?
–বিনিময়ে আপনি দশলক্ষ ফ্রা পাবেন। তার মধ্যে এক লক্ষ ফ্রা আমি এখুনি দিচ্ছি। মানিব্যাগ খুলে লোকটি নোট বার করল। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। বললাম, আপনার এতবড় সাহস আপনি পোয়ারোকে ঘুষ দিতে চান?
শান্ত গলায় পোয়ারো বলল, উত্তেজিত হয়োনা হেস্টিংস। তারপর আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে বলল, যদি আপনাকে আটকে রেখে পুলিশে খবর দিই।
–আমাকে এখানে আটকে রাখা আপনাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
–পোয়ারো ফোন তুলতেই আমি আগন্তুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আশ্চর্য, আমাকে একটা প্যাঁচে ধরাশায়ী করে সে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
একটা চিরকূট ফেলে গেছে তাতে লেখা আগামী শুক্রবার সকাল এগারোটায়, ৩৪ নং রু দ্য এস্কেল-এ আমাদের পরবর্তী বৈঠক হবে।
পোয়ারো বলল, স্বেচ্ছায় কারো ফাঁদে পা দেবার ইচ্ছে আমার নেই। সবই সাজানো ব্যাপার। ভেবেছে ঐ চিরকূট পড়ে আমি ওদের ফাঁদে পা দেব। না। আমরা এখনেই বসে থাকবো। আসবার হলে চতুরঙ্গের লোকেরাই এখানে আসবে।
ঠিক সাড়ে এগারোটার সময় একজন লোক এল। সে এসেছে মাদাম অলিভিয়ের কাছ থেকে। মাদাম একটি চিঠি পাঠিয়েছে। পত্রপাঠ আমরা যেন তার সঙ্গে দেখা করি।
আমরা মাদামের বাড়িতে গেলাম।
পোয়ারো মাদামকে বলল, কী ব্যাপার?
মাদাম বললেন, ব্যাপার গুরুতর। শুনলাম, কাল আমার সঙ্গে দেখা করবার পর আবার আপনারা আমার সেক্রেটারি ভেরোনুর সঙ্গে দেখা করেন। তারপর ইনেজ আপনাদের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। আর সে ফিরে আসেনি।
–আর কিছু বলার আছে? পোয়ারো বলল।
–আমার ল্যাবরেটরিতে ঢুকে জরুরী কিছু কাগজপত্র চুরি করেছে। আমার বড় সিন্দুকটা তারা ভাঙতে পারেনি। নইলে আরো মূল্যবান জিনিষ চুরি করতে পারত।
পোয়ারো বলল, মাদাম, আপনার সেক্রেটারি ইনেজ একটি পাকা চোর। তার আসল নাম কাউন্টেস রসাকোফ। বিজ্ঞানী হ্যালিডে যে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন, তার জন্যে কাউন্টেসই দায়ী। সে কতদিন এখানে চাকরি করছে?
–মাস পাঁচেক।
–আমার মনে হয়, ইনেজ খুব সম্ভব চোরেদের গোপনে জানিয়ে দিয়েছিল। আপনার ল্যাবে কাগজপত্রগুলোর ব্যাপারে। কিন্তু, মাদাম আরো কী দামী জিনিষ তারা চুরি করতে পারেনি! গহনা?
-না মঁসিয়ে। রেডিয়াম। হ্যাঁ, রেডিয়াম। সামান্য কিছু রেডিয়াম আমার নিজেরই আছে। এরপর আরো কিছু রেডিয়াম গবেষণার কাজে দরকার পড়ায় আমি ধার করেছি। পৃথিবীতে আবিষ্কৃত রেডিয়ামের মধ্যে আমার কাছে সংগৃহীত রেডিয়ামের মূল্য হবে কয়েক কোটি ফ্রাঁ। এই মূল্যবান ধাতু আমার সিন্দুকে আছে। বাইরে থেকে সিন্দুক বলে মনে হলেও, ওটার আসলে অনেক মিলিয়ে মিলিয়ে তালা খুলতে হয়। ওটি দারুণ মজবুত।
-এই রেডিয়াম আর কতদিন আপনার কাছে থাকবে?
-আর মাত্র দুদিন। তারপর আমার এক্সপেরিমেন্টের কাজ শেষ হয়ে গেলে ফেরৎ দিয়ে দেব।
-ইনেজ কি এসব কথা জানে?
–জানে।
–উত্তম। সুতরাং আজকালের মধ্যেই আর একবার হামলা হবে। আপনার সঙ্গে আমার রেডিয়ামের ব্যাপারে কথা হয়েছে এটা যেন কেউ জানতে না পারে। আর আমি আপনার রেডিয়াম রক্ষা করব, কথা দিচ্ছি। আপনি শুধু ল্যাবের থেকে যে দরজাটা দিয়ে বাগানে যাওয়া যায় তার চাবিটা আমাকে দিন। আমি রাত্রে আপনার বাড়িতে ফিরে আসব আর পাহারা দেব।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার অভয়বাণী শুনে স্বস্তি পেলাম।
.
রাত এগারোটায় আবার প্যাসি অঞ্চলে আমরা ফিরে এলাম। কেউ আমাদের অনুসরণ করেনি এটা নিশ্চিন্ত হয়ে দেয়াল টপকে আমরা মাদাম অলিভিয়ের বাগানের মধ্যে গেলাম। সামনেই ল্যাবরেটরি। রাত কাটাতে হবে।
হঠাৎই জনা দশেক লোক হয়তো এরাই চোর এসে আমাদের মুখে কাপড় গুঁজে, হাত পা। বেঁধে ল্যাবরেটরিতে টেনে নিয়ে গেল। চোরেদের মধ্যে একজন গিয়ে বড় সিন্দুক খুলে ফেলল। দেখলাম সিন্দুকের মধ্যে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে। এই সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে দিলো আমাদের। আমরা একটা কুঠুরি ঘরে পৌঁছলাম। দেখলাম, আমাদের সামনে একজন মহিলা এসে দাঁড়ালেন। মুখে মুখোশ আঁটা। চতুরঙ্গের তিননম্বর কর্তা একজন ফরাসী মহিলা–ইনিই কি সেই মহিলা? নাকি ইনি ভেরোনু? কিন্তু ভেরোনু তো এত ঢ্যাঙা নয়।
মহিলা আমাদের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আমাদের মুখের বাঁধন খুলে দিলেন। হাত পা বাঁধাই রইল।
হঠাৎ একটানে তাঁর মুখোশটা খুলে ফেললেন তিনি। সবিস্ময়ে দেখলাম, তিনি স্বয়ং মাদাম অলিভিয়ার!
চোখের দৃষ্টিতে আগুন জ্বলছে।
তিনি বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। সবাই বলে যে, আপনি একজন মস্ত গোয়েন্দা। এখন আপনি একজন নারীর কাছে পরাজিত। আপনাকে লোক পাঠিয়ে সতর্ক করলাম, আপনি শুনলেন না। যাই হোক। এবার মৃত্যুর আগে ইষ্টনাম জপুন আর আপনার শেষ ইচ্ছে বলুন, নেহাত অসম্ভব না হলে আপনার মনস্কামনা আমি মিটিয়ে দেব।
-মাদাম, পোয়ারো বলল, আমার মৃত্যুর আগে যদি অনুমতি করেন তাহলে শেষবারের মতো একটা সিগারেট খাব।
–অর্থাৎ আপনার হাত-দুটোকে খুলে দিতে হবে, না, মঁসিয়ে। অত বোকা আমি নই।
মাদাম পোয়ারোর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে প্রায় মুখে গুঁজে দিল, জিজ্ঞেস করল, দেশলাই আছে তো?
পোয়ারোর গলায় একটা ঠাট্টার সুর বাজল যেন, নড়বেন না। মাদাম। যদি আর এক পাও যদি নড়েন আমার সিগারেটের ব্লোপাইপ থেকে তক্ষুনি বিষাক্ত উঁচ ছুটে যাবে আপনার শরীরে। তাহলে আপনার মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই মরতে চান না মাদাম। সুতরাং আমি বলি কি, আমার বন্ধু হেস্টিংসের বাঁধনটা আপনি খুলে দিন। রাগে অপমানে কাঁপতে কাঁপতে আমার বাঁধন মাদাম খুলে দিলেন। তক্ষুনি পোয়ারের আদেশে আমি মাদামকে বেশ শক্ত করে বাঁধলাম। তারপর পোয়ারোর বাঁধন খুলে দিলাম।
মাদামকে সেই কুঠুরির মধ্যে ফেলে রেখে আমরা বাইরে বেরিয়ে পা টিপে টিপে বাগানটা পার হয়ে রাস্তায় এলাম। আমি পোয়ারোকে বললাম, এরকুল, এখন কি আমাদের পুলিশে খবর দেওয়া কর্তব্য?
মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, পাগল, ভুলে যেও না, মাদাম একজন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী। আসলে তিনি যে একটা জঘন্য চক্রান্তে লিপ্ত, একথা পুলিশ বিশ্বাস তো করবেই না, উল্টে আমাদের পাগলা-গারদে পাঠিয়ে দিতে পারে।
.
০৮.
প্যারিসে আর সময় নষ্ট না করে আমরা লন্ডনে ফিরলাম। অনেক চিঠির মধ্যে মিঃ রাইল্যান্ডের লেখা একটা চিঠি পড়ে পোয়ারো বলল, জানো হেস্টিংস, রাইল্যান্ড লিখেছেন যে, তার কথামতো আমি আর্জেন্টিনায় না গিয়ে কথার খেলাপ করেছি। তোমার মেয়ারলিংয়ের কথা মনে আছে তো? মরার আগে সে বলেছিল। চতুরঙ্গের দু-নম্বর কর্তার প্রতীক হচ্ছে ডলার। আমার অনুমান এই আবে রাইল্যান্ডই হচ্ছেন সেই কর্তা; তা না হলে আমাকে চতুরঙ্গের রহস্য উদঘাটনের সময়ে আর্জেন্টিনায় সরিয়ে দিতে চাইবেন কেন? এবার আমার সন্দেহটা কতখানি সত্য সেটা জানবার জন্যে তার ওপর নজর রাখতে হবে। ভদ্রলোক এখন ইংল্যান্ডেই আছেন। সুতরাং কাজটা বিশেষ, কঠিন হবে না আশা করি।
দিনকয়েক পরে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন বের হলো যে, আবে রাইল্যান্ড একজন সেক্রেটারি চান। পোয়ারো আমাকে হোম সেক্রেটারির সুপারিশ সমেত একটা দরখাস্ত পাঠাতে বলল। করলাম যথাসময়ে উত্তরও এলো, তাতে লেখা ছিল : স্যাভয় হোটেলে মিঃ রাইল্যান্ডের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হবে। চেহারাটা আর্টিস্ট ডাকিয়ে যথাসম্ভব পালটিয়ে আমি স্যাভয় হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ডাক পড়ল আমার। একটা মস্ত টেবিলের সামনে তিনি বসে আছেন। রোগা, ঢ্যাঙা, নাকটা বাঁকানো। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ মুখে কালো চুরুট। টেবিলে থেকে মুখ তুলে তিনি বললেন, হোম সেক্রেটারি আপনার চাকরির জন্যে আমাকে অনুরোধ জানিয়েছেন। আপনার কাজটা হল মাঝে মাঝে আমি হয়তো পার্টি দেব।
সে-সব পার্টিতে কাকে; কোথায় বসাতে হবে, তা আপনার জানা চাই। এ ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা আছে তো মিঃ নেভিল?
বলতে ভুলে গেছি চেহারার সঙ্গে আমি নামটাও পালটে নিয়েছি। আমার নাম এখন আর্থার নেভিল। হোম-সেক্রেটারীর সুপারিশেও ঐ ছদ্মনামটা উল্লেখ ছিল।
আমি উত্তর দিলাম, এ কাজ আমি আগেও করেছি। অসুবিধা হবে না। আমাকে কি লন্ডনে থাকতে হবে?
-না। বেশির ভাগ সময় আমি লোমশায়ারে থাকি। সেখানকার ডিউকের বাড়িটা আমি ভাড়া নিয়েছি। প্রচুর জায়গা, সুতরাং পার্টির আয়োজন করতে আপনার কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। চাকুরীটা সুখের চাকরী।
বাড়িটার নাম হ্যাটন চেস। সেখানে গিয়ে জানলাম রাইল্যান্ডের একজন মার্কিনী সেক্রেটারী এবং একটি মেয়ে স্টেনো আছে। মার্কিনী সেক্রেটারীর নাম মিঃ অ্যাপলবি। আমার সঙ্গে মেয়ে স্টেনো মিস্ মার্টিনের বেশ ভাব জমে গেল। বয়স তেইশ হবে। স্পষ্ট করে কোনো কথা না বললেও ওর কথায় আমি বুঝেছিলাম মিঃ রাইল্যান্ডকে ও বিশেষ পছন্দ করে না। হপ্তা তিনেক হ্যাটন চেস্ এ থাকার পর আমার মনে হল, এই রাইল্যান্ডের সঙ্গে চতুরঙ্গের কোনো সম্পর্ক নেই। এরমধ্যে রাইল্যান্ডকে আমি জানাইনি যে, পোয়ারোকে আমি চিনি।
একদিন আমি আর মিস মার্টিন ঘুরে বেড়াচ্ছি। মিস মার্টিন কথায় কথায় বলল, একটা কথা বলবো?
আমি বললাম, বলুন,
ভাবছি এ চাকরিটা আমি ছেড়ে দেব।
–সেকি! কেন?
–মিঃ রাইল্যান্ড আমাকে অতি ইতর ভাষায় গালমন্দ করেছে, তার নীলকাগজে লেখা একটা চিঠি আমি ভুলবশতঃ পড়ে ফেলেছিলাম বলে। নীল কাগজে লেখা এমন কিছু চিঠি তার কাছে আসে, যেগুলি আমার পড়বার হুকুম নেই।
–চিঠিগুলোর কোনো বিশেষতঃ আছে?
–আছে। নীলকাগজে লেখা চিঠিগুলোর এককোণে লেখা থাকে : ৪।
চিঠিতে কি লেখা ছিল আপনার খেয়াল আছে?
–ছোট্ট চিঠি। তার প্রতিটি কথাই আমার মনে আছে।
–কী লেখা ছিল তাতে?
-লেখা ছিল, সম্পত্তিটা দেখাই এখন জরুরী কাজ। সম্পত্তির সঙ্গে খনি চান তো সেই সতেরো হাজার পাউন্ড পড়বে। এগারো পার্সেন্ট কমিশন কেন? চার পার্সেন্টই যথেষ্ট। ব্যাস, এটুকুই লেখা ছিল। দেখুন তো, নিতান্ত ব্যবসায়িক একটা চিঠি পড়ে ফেলেছি বলে মিঃ রাইল্যান্ড যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করলেন।
–আচ্ছা, মিস মার্টিন চিঠির তলায় কারও স্বাক্ষর ছিল?
–ছিল আর্থার লেভারশ্যাম নামে এক ভদ্রলোকের। এরপর মিস মার্টিনের সঙ্গে দু-একটা কথা বলে আমি তার কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। ফিরে এসে নোটবুক খুলে চিঠিখানার ভাষাটা টুকলাম। আর বারবার চোখ বুলিয়ে তার রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
খুব বেশি সময় লাগল-না। চতুরঙ্গের চারটে সংখ্যাটিকে চাবিকাঠি হিসেবে ধরে নিতেই রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। দেখলাম, চিঠির ভাষার মধ্যে তিনটে করে শব্দ বাদ দিয়ে চতুর্থ শব্দটিকে যদি গ্রহণ করি তাহলে চিঠিটা এইরকম দাঁড়ায় :
জরুরী খনি সতেরো চার।
শেষের ঐ চার শব্দটা নিশ্চয়ই চতুরঙ্গের প্রতীক। বাকী থাকছে তাহলে চারটি শব্দ : জরুরী খনি সতেরো এগারো। এর মানেটা কি? আমি জানতাম লোমনশায়ারের আমাদের বাড়িটার কাছে একটা খনি আছে। সতেরো তারিখ এগারোটার সময় সেখানে উপস্থিত থাকার জন্যে কি চতুরঙ্গ কিছু জরুরী নির্দেশ দিচ্ছে? এগারোটা মানে নিশ্চয়ই রাত এগারোটা, দুপুর এগারোটা নয়। আজ ষোলই অক্টোবর। কাল সতেরো। এরকুলকে এক্ষুনি একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানিয়ে দিই, সে যেন নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে এসে চতুরঙ্গের রাঘব-বোয়ালদের ধরে ফেলে। পাঠিয়েও দিলাম।
পরদিন সতেরোই অক্টোবর সারাদিনটা আমার চাপা উত্তেজনার মধ্যে কাটল। স্টেশনে গিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করে খনির দিকে নিয়ে যাবো ভাবলাম। কিন্তু রাইল্যান্ড কিছু জরুরী কাজ দিল। সেগুলি সারতে আমার দশটা বেজে গেল। সাড়ে দশটা বাজতেই তিনি আমাকে ছুটি দিলেন।
ঘরে গিয়ে একটা কালো ওভারকোট চাপিয়ে পা চালিয়ে আমি খনির ধারে একটা ঝোঁপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে বসে রইলুম। তখন দশটা পঞ্চাশ বাজে। মিনিট পাঁচেক বাদেই দেখলাম রাইল্যান্ড চারিদিকে একবার তাকিয়ে খনিতে নেমে গেলেন।
এক-পা এক-পা করে আমিও এগোলাম। নিচের থেকে কিছু কথাবার্তা কানে আসতে বুঝলাম চতুরঙ্গের অন্যান্য সদস্যরা হাজির হয়েছেন। আমি পা টিপে টিপে নিচে নামতে লাগলাম। আমার পকেটে একটা রিভলবার ছিল। চতুরঙ্গের সদস্যদের সামনে ওটা উঁচিয়ে বলব…
-হ্যান্ডস আপ! চমকে উঠে দেখি রাইল্যান্ড। বললেন আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। আমরা। রাইল্যান্ডের রিভলবার আমার দিকে তাক করা।
আমাকে বেশ ভালো করে হাত পা বাঁধা হলো। মুখের মধ্যে রুমাল গুঁজে দিয়ে শুইয়ে রাখা হল।
রাইল্যান্ড বললেন, ওহে নেভিল, পোয়ারোর চর, তোমার আসল নাম হেস্টিংস তা আমি জানি। পোয়ারো তোমার কাছ থেকে খবর পেয়ে নিশ্চয়ই এখানে আসবে। চমৎকার। দুজনেই খতম হবে কেমন। খনির মধ্যে ধস নামবার ব্যবস্থা করব আমরা। তারপর জ্যান্ত কবর।
হে ঈশ্বর! পোয়ারো যেন কোনো কারণে এখানে এসে না পৌঁছায়–আমি ভাবতে লাগলাম।
বৃথাই প্রার্থনা। একটু বাদেই পোয়ারোর চেনা পদশব্দ আমার কানে এল।
অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাইল্যাণ্ড। পোয়ারো আসতেই রিভলবার উঁচিয়ে বললেন। হ্যাণ্ডস আপ।
পোয়ারো হাত তুলে দাঁড়ালো। বলল, ব্যাপার কী?
-ব্যাপার কিছুই নয়। আপনাদের দুজনকে আজ হত্যা করব। আপনারা নিজেরাই আমাদের জালে পা দিয়েছেন।
পোয়ারো হেসে বলল, জাল তো আমি ফেলেছি।
তার মানে?
-মানেটা খুবই সোজা। অন্তত ঘণ্টা খানেক আগে আমরা অর্থাৎ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের জনা দশেক বাছাই করা লোক। জায়গাটাকে ঘিরে রেখেছে তারা। কী, মানেটা বোধগম্য হল?
মিঃ রাইল্যাণ্ডের চোয়াল স্কুলে পড়ল। পোয়ারো শিস্ দিতেই জনা দশেক প্রহরী রাইল্যান্ড আর তার চাকরের রিভলবার কেড়ে নিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করল।
.
খনি থেকে বেরিয়ে পোয়ারো বলল, নাঃ এইভাবে শত্রুর কবলে তোমাকে পাঠিয়ে আমি খুব অন্যায় করেছিলুম। সবটাই আমার জানা ব্যাপার। আমি জানতাম তোমার মারফতেই ওরা আমাকে ধরবার চেষ্টা করবে। ঐ মিস মার্টিন চতুরঙ্গেরই চর। চিঠিটা ভুয়ো। টেলিগ্রাম পেয়েই বুঝেছিলাম এটা একটা ফাঁদ। সঙ্গে সঙ্গে ইন্সপেক্টর জ্যাপকে সব জানিয়ে পাল্টা ফাঁদের ব্যবস্থা করলাম।
খেল কিন্তু খতম হলো না। পরদিন সকালে লন্ডনে ফিরে পোয়ারোর ঘরে বসে আছি। এমন সময় জ্যাপ এসে জানাল, মিঃ রাইল্যাণ্ড যাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি সে আসলে রাইল্যাণ্ডের বেয়ারা জেমস। রাইল্যাণ্ডের খাস চাকর জর্জের সঙ্গে জেমস নাকি বাজি ধরেছিল যে সে রাইল্যান্ডের ছদ্মবেশ ধারণ করে সবাইকে বোকা বানাবে। নেহাত একটা খেলা ছাড়া কিছু নয়। তাদের গ্রেপ্তার করার পর হ্যাটন চেজ-এ গিয়ে দেখি মিঃ রাইল্যান্ড ঘুমচ্ছেন। তিনি আমাদের যাচ্ছেতাই রকমের গালমন্দ করলেন, জানি না তিনি আবার পুলিশের নামে মানহানির মামলা করবেন কিনা।
জ্যাপ ঝড়ের বেগে চলে গেল।
পোয়ারো মৃদু হেসে বলল, রাইল্যান্ড অতি চালাক লোক। গোটা ব্যাপারটাকে ছেলেমানুষী বলে চালিয়ে দিতে তার অসুবিধা হবে না।
-কিন্তু জেমসের পক্ষে এত নিপুণ ছদ্মবেশ ধরা কি করে সম্ভব হলো?
–সম্ভব হল, তার কারণ, জেমসই হয়তো চতুরঙ্গের চার নম্বর কর্তা অর্থাৎ ছদ্মবেশ ধারণে ওস্তাদ সেই জল্লাদ।
.
০৯.
পোয়ারো বল, মুষড়ে পড়ার কিছু নেই হেস্টিংস। চতুরঙ্গের এখন সুদিন যাচ্ছে, কিন্তু শেষ হাসিটা আমরাই হাসব, মনে রেখো।
সে যাক, ইতিমধ্যে খবরের কাগজে সুঁই-রহস্য” বলে একটা মৃত্যু রহস্য নিয়ে খুব হৈ চৈ পড়ে গেল। এই কেসটার জন্যে জ্যাপ আমাদের সাহায্য চাইছিল। রাইল্যান্ডের চাকরি ছাড়ার প্রায় মাস খানেক বাদে আমরা উস্টারের দিকে রওনা হলাম, এই শহরই হচ্ছে জুই রহস্যের ঘটনাস্থল।
পোয়ারো বলল, হেস্টিংস। জুই রহস্য তুমি বেশ গুছিয়ে বলো তো আমায়।
বললাম, বেশ; এই রহস্যের কেন্দ্র চরিত্র হচ্ছেন মিঃ পেন্টার। ইংরেজ বয়স পঞ্চান্ন, ধনী, শিক্ষিত মানুষ, ইংল্যান্ডের হ্যাণ্ডফোর্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্যে একটা বাড়ি কিনেছিলেন। আত্মীয় বলতে একটিমাত্র ভাইপো জেরাণ্ডাকে তিনি খুঁজে বার করে তাকে অনুরোধ করেন তার সঙ্গে বসবাস করার জন্যে। এ প্রায় মাস সাতেক আগের কথা। তারপর এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। ভাইপো ছাড়া তার বাড়িতে ছিল সাতটা চাকর, তার মধ্যে একটি ভৃত্য ছিল চীনে, নাম আ-লিং।
গত মঙ্গলবার রাত্তিরের খাবার খেয়ে মিঃ পেন্টার অসুস্থ বোধ করলে ডাক্তার ডাকা হয়। ডাক্তার এসে তাকে পরীক্ষা করার সময় কেউ ঘরে ছিল না বা পেন্টারের সঙ্গে কি কথা হয় তা কেউ শোনেননি। তবে বিদায় নেওয়ার সময় ডাক্তার বলেন, পেন্টারের হার্ট খুব দুর্বল, তাকে একটা ইনজেকশান দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার চাকর বাকরদের গুটিকয় প্রশ্ন করেন, কার বাড়ি কোথায়, কে কতদিন যাবৎ কাজ করছে। এই প্রশ্নে পরিচারিকারা বিস্মিত হয়ে পড়ে। যাই হোক পরদিন সকালে পেন্টারের পড়বার ঘর থেকে একটা চিমসে গন্ধ পাওয়া গেলে ঝি দরজা ঠেলে দেখে ভিতর থেকে বন্ধ। তখন সে চীনে ভৃত্যটাকে এবং জেরাণ্ডাকে ডেকে আনে। তারা দরজা ভেঙে ঢুকে দেখে মিঃ পেন্টার গ্যাস উনুনের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে আছেন। মুখখানা পুড়ে গিয়ে চেনার অযোগ্য হয়ে গেছে।
–সবাই ভেবেছিল যে হঠাৎ হয়তো মাথা ঘুরে তিনি গ্যাসের উনুনে পড়ে গিয়েছেন। এমনটা ভাবার কারণ, তিনি ছিলেন অসুস্থ এবং তাকে কুয়েন্টিনের মতে কড়া ইঞ্জেকশান দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু তারপরই একটা অদ্ভুত জিনিষ চোখে পড়ল, একটা খবরের কাগজে কাঁপা কাঁপা হাতে বড় বড় অক্ষরে কে যেন লিখে রেখেছে; জুই। মিঃ পেন্টারের ডান হাতের তর্জনী কালি মাখা এবং উল্টানো দোয়াত দেখে কোনো সন্দেহ রইল না যে, কথাটা মিঃ পেন্টারই লিখেছেন।
–কিন্তু তিনি জুই কথাটার দ্বারা কি বোঝাতে চেয়েছেন। এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। পেন্টারের বাড়িতে লতানে জুইয়ের ঝাড় ছিল।
–জানা গেল ডাঃ কুয়েন্টিন এ পরিবারে নতুন ডাক্তার। তার আগে ডাঃ বেলিথোই মিঃ পেন্টারের নিয়মিত চিৎকার করতেন। মাসখানেক তিনি ছুটিতে বাইরে যাওয়ায়, ঠিক হয় ডাঃ বেলিথোর অনুপস্থিতিতে ডাঃ কুয়েন্টিন চিকিৎসা করবেন। ডাঃ কুয়েন্টিনের সাক্ষী থেকে জানা গেল : মিঃ পেণ্টার ঘটনার দিন তাকে একটা অদ্ভুত কথা বলল। আসলে সেদিন এমন একটা তরকারি তাকে পরিবেশন করা হয়, যার গন্ধটাই কেমন সন্দেহজনক। আ লিঙয়ের অগোচরে সেই তরকারী কিছু অংশ তুলে রেখেছিলেন, তারপর ডাঃ কুয়েন্টিনকে সে তরকারীটা পরীক্ষা করে দেখতে বলেন। পেন্টারের ধারণা হয়েছিল তাকে বিষ মিশিয়ে হত্যার চেষ্টা চলছে।
-সাক্ষ্যে কুয়েন্টিন আরো জানান, যদিও সেদিন মিঃ পেন্টার অসুস্থ বোধ করছিলেন না তবুও সাবধানতার জন্যে তাকে তিনি একটা স্ট্রিকানন ইজেকশান দেন। ল্যাবরেটরিতে তরকারী পরীক্ষা করে দেখা যায়; তাকে গুড়ো আফিং মেশানো রয়েছে। সবটা বলে আমি চুপ করলাম।
পোয়ারো বলল, এসো, ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখা যাক। তরকারীটা রান্না করেছিল আ-লিং। কিন্তু সে আফিং মিশিয়ে পেন্টারকে মারতে চাইবে কেন? এদিকে জেরাল্ডকেও সন্দেহ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায় না, কারণ, তাড়াতাড়ি জ্যাঠার সম্পত্তি পাবার লোভে সে তাকে মারতে চেয়েছিল। আরো দেখা যাচ্ছে, জ্যাঠার সঙ্গে একসাথে খেলে তাকেও ঐ তরকারী পরিবেশন করা হবে, তখন না খেলে সন্দেহজনক দেখাবে। তাই সেদিন জেরাল্ড বাইরে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে ডিনার সেরেছিল।
আমি বললাম, খাওয়া সেরে অনেক রাতে জেরাল্ডা বাড়ি ফিরে দেখে জ্যাঠার ঘরে আলো জ্বলছে সে বুঝল, প্ল্যান ভেস্তে গেছে, বুড়ো মরেনি। তাই সে বুড়োকে গ্যাস উনুনে ঠেসে ধরল।
-কিন্তু হেস্টিংস, পোয়ারো বলল, ব্যাপার অদ্ভুত লাগছে না? বুড়ো নিশ্চয়ই বাঁচবার জন্যে একটু ধস্তাধস্তি বা চীৎকার করবে। কিন্তু পেন্টারের ঘরে ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছিল না। চীৎকারও কেউ শোনেনি। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষনীয় মিঃ পেন্টার দীর্ঘদিন চীনে ছিলেন, অতএব এখানেও লি চ্যাং ইয়েনের হাত থাকলে, আমি অবাক হবে না। কিন্তু, না চলো, আমাদের গন্তব্যস্থল এসে গেছে। নামা যাক।
.
১০.
প্ল্যাটফরমে জ্যাপ দাঁড়িয়েছিল। আমরা তার সঙ্গে ক্রন্ট ল্যাগুস অর্থাৎ মিঃ পেন্টারের বাড়ি গেলাম।
সুন্দর সাদা, ছোট বাড়ি। জুই লতা উঠে গেছে। পোয়ারো বলল, কী মনে হয় জ্যাপ, দুর্ঘটনা না খুন?
-তরকারীতে আফিং মিশিয়ে কেউ তাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল যেহেতু, সেহেতু আগুনে পুড়ে মারা যাবার ঘটনাকে নেহাত দুর্ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
-বাঃ, বেশ বুদ্ধিমানের মতো কথা বলছো জ্যাপ। যে ঘরে পেণ্টার মারা গিয়েছিল সেই ঘরে গেলাম আমরা।
পোয়ারো প্রশ্ন করল, জানালায় ছিটকিনি লাগানো ছিল না?
ঘাড় চুলকে জ্যাপ বলল, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ডাক্তার পরীক্ষা করে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে যায়। পরদিন ঝি দরজা ঠেলে দেখল ভিতর থেকে খিল দেওয়া। আ-লিং বলছে, জানলায় ছিটকিনি লাগানো ছিল না। ডাঃ কুয়েন্টিন বলেছেন, জানালাটা ভেজান ছিল বটে কিন্তু খুব সম্ভব তাতে ছিটকিনি লাগানো ছিল না। ঝি বলছে, সকলে দরজা ভেঙে ঢোকার পর জানালাটা খুলে দেওয়া হয়, ছিটকানি আঁটা ছিল কিনা তার মনে নেই।
–আমার প্রশ্ন, এটাকে যদি খুন বলে ধরে নেওয়া যায়, তবে কার লাভ হবে? পোয়ারো বলল জ্যাপকে।
-শুনেছি জেরাণ্ডা ছোকরা খুব উজ্জ্বল ছিল। বিস্তর ধার দেনা করেছে হয়তো, পাওনাদারদের তাগাদায় অস্থির হয়ে, ধার শোধ করবার জন্যে সে হয়তো জ্যাঠাকে খুন করেছে।
পোয়ারো গম্ভীর হয়ে বলল, দ্যাখো জ্যাপ, চালাকি করো না। জেরাল্ডা-এর মেটিভ সম্পর্কে তুমি নিশ্চিত নও। খালি হয়তো এর ওপর নির্ভর করে কাউকে সন্দেহ করা যায় না।
এরপর সন্দেহ জাগে আ-লিঙের ওপর; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মূল্যবান কিছু কি খোয়া গেছে?
–না। টাকাকড়ি। গয়নাগাটি সব ঠিক আছে; কিন্তু একটা পাণ্ডুলিপি পাওয়া যাচ্ছে না।
মিঃ পেণ্টার বইখানাকে প্রকাশ করার জন্যে পাবলিশারের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গ হয়েছিলেন।
–পাণ্ডুলিপির কথাটা তুমি কার কাছে শুনলে?
–ভাইপো জেরাল্ডার কাছে।
–বইয়ের বিষয়টা কি ছিল?
–চীনের বিষয়ে। নাম দিয়েছিলেন চীনের চক্রান্ত”।
–আ-লিংকে ডেকে পাঠাও।
আ-লিং এল। পরণে চীনা জোব্বা।
তাকে প্রশ্ন করে জানা গেল, মালিকের হত্যাকারী কে? সে বলতে পারে না। সেদিন রাত্রের খাবার সেই রান্না করেছিল।
কিন্তু আফিং সে মেশায়নি। আর সে জুই-কথাটার অর্থ জানে না। চতুরঙ্গের নাম শুনে তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, কোনোদিন চতুরঙ্গের নাম শোনেনি বলে সে পোয়ারোকে জানাল। তারপর চলে গেল।
সে চলে যাবার পর পোয়ারো বলল, মনে হচ্ছে এ চতুরঙ্গেরই কাজ। হয়তো পেন্টার চতুরঙ্গের পয়লা নম্বর কর্তা লি-চ্যাং ইয়েনের সম্পর্কে কোনোও গোপন তথ্যের উল্লেখ করেছিলেন, তারা চায়নি সেটা প্রকাশ হোক।
কথা বলতে বলতে ঘরে এসে ঢুকল জেরাল্ড। তাকে বসতে বলে জিজ্ঞেস করা হল, সে রাত্রে আপনি কোথায় খেয়েছিলেন?
–এক প্রতিবেশীর বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল।
–প্রতিবেশী ভদ্রলোকের নাম?
–মিঃ উইচার্লি।
বাড়ি ফিরেছিলেন কখন?
–রাত এগারোটা নাগাদ। ডুপ্লিকেট চাবি ছিল।
বাড়িতে ঢুকবার পরে কি, এমন কিছু আপনার চোখে পড়েছিল যা সন্দেহ জনক?
বাড়িতে ঢুকে দেখলাম, চাকর বাকররা সব আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জ্যাঠার ঘরেও আলো জ্বলছিল না। চুপচাপ নিজের ঘরে যাবার সময় দেখলাম, বারান্দায় উপর থেকে একটা মানুষের ছায়া সরে গেল। মনে হল, আ-লিং তবে আমি নিশ্চিত নই। ভুলও হতে পারে।
পোয়ারো বলল, শুনেছি দীর্ঘকাল জ্যাঠার সঙ্গে আপনার কোনো যোগাযোগ ছিল না। এর আগে আপনার জ্যাঠার সঙ্গে আপনার শেষ কবে দেখা হয়েছিল?
তখন আমার বয়স হবে দশ? তারপরে আমার বাবার সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
–এতদিন বাদে আপনাকে খুঁজে বার করতে জ্যাঠার অসুবিধা হয়নি?
–আমার খোঁজ চেয়ে জ্যাটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। ভাগ্য ভালো বিজ্ঞাপনটা আমার চোখে পড়ে। আমি দেখা করি।
–আপনি এখন যেতে পারেন, আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।
এরপর আমরা গেলাম ডাঃ কুয়েন্টিনের চেম্বারে। তার থেকে নতুন কিছু জানা গেল না। তার সন্দেহ আং-লিং-এর ওপর।
এরপর পোয়ারো একটা বইয়ের দোকানে ঢুকে একটা বই কিনলো। তারপর হোটেলে ফিরে ঘুম। পরদিন সকালে ঘুমচোখ খুলে দেখি পোয়ারো ঐ বইখানা উল্টেপাল্টে দেখছে।
আমার ঘুম ভেঙেছে দেখে পোয়ারো বলল, রহস্যের কিনারা করবার জন্যে যে তথ্যটা জরুরী, মিঃ পেন্টার আমাদের সেটা জানিয়েই গেছেন।
-মানে?
–লোকটা মরবার আগে হঠাৎ ফুলের নাম লিখতে গেল কেন? জুই শুধু ফুলের নাম নয় বিষেরও নাম। ইয়েলো জ্যাসমিন (সোনাজুই) অতি মারাত্মক বিষ। এই বইটা থেকে জানতে পারলাম। এতে লেখা আছে, ঐ বিষ কারোর শরীরে ঢুকিয়ে দিলে তার মৃত্যু অবধারিত। বিষপ্রয়োগে হত্যা করে, তারপরে তাকে আগুনে ঠেসে ধরা হয়। মৃত্যুর আসল কারণটাকে চাপা দেবার জন্যে এই প্রয়াস। পুলিশ যদি শোনে আফিং মেশানো তরকারী তিনি খাননি, তাহলে দ্বিতীয়বার বিষ প্রয়োগের চেষ্টা হেসে উড়িয়ে দেবে।
-তরকারীতে তাহলে আফিং ছিল না, আমি বললাম।
–না। ডাঃ কুয়েন্টিন পরীক্ষা করার আগে তরকারীতে আফিং মিশিয়ে নিয়েছিলেন। সেদিন রাত্তিরে মিঃ পেন্টারকে ডাক্তার যে ইঞ্জেকশান দিয়েছিলেন আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাতে আসলে ছিল ইয়োলো জ্যাসমিন। পেণ্টার মারা যাবার পর কেউ ঘরে ঢুকে আসল কারণটা চাপা দেবার জন্যে তার মৃতদেহটা আগুনে চেপে ধরে। মুমূর্ষ পেন্টারের লেখাটা অপরাধীরা কেউ জানতে পারেনি। জানলে নিশ্চয়ই সরিয়ে ফেলত।
–কে মিঃ পেন্টারকে আগুনে ঠেসে ধরেছিল? আ-লিং?
–না। চতুরঙ্গের নাম সে জানত। জেরার সময় তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যাবার কারণ, সে চতুরঙ্গের নাম শুনে ভয় পেয়েছিল।
–তাহলে জেরাল্ডা কি মিঃ পেন্টারের ভাইপো নয়?
–ঠিক সে চতুরঙ্গের সেই ছদ্মবেশী চার নম্বর কর্তাটি। সে ভাইপো সেজে ঢুকেছিল।
–জেরাল্ডাই কি তাহলে জল্লাদ?
-না, ডাঃ কুয়েণ্টিন সেই জল্লাদ। সেও আসল ডাক্তার নয়, চতুরঙ্গের লোক। আমি জ্যাপকে বলেছি ওদের দুজনকে নজরে রাখতে।
বলতে না বলতে জ্যাপ এসে ঢুকে বলল, জেরাল্ডা পালিয়েছে, ডাঃ কুয়েন্টিনেরও খবর পাওয়া যাচ্ছে না। যাই হোক, আমরা ওদের গ্রেপ্তার করবই।
বিষণ্ণ হেসে পোয়ারো বলল, অসম্ভব।
২. সোহো অঞ্চলে
১১.
মাসখানেক পরের কথা।
সোহো অঞ্চলের একটা রেস্তোরাঁয় আমি আর পোয়ারো খাচ্ছি। জ্যাপ সেখানে খেতে এসে পোয়ারোকে জিজ্ঞেস করল, দাবা খেলায় আপনাকে আগ্রহ আছে? পোয়ারো হা বলাতে জ্যাপ জানাল রাশিয়ার বিখ্যাত দাবা খেলোয়াড় ডঃ সাবারোনফ আর আমেরিকার খেলোয়াড় গিলমোর উইলসনের মধ্যে গতকাল একটা ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু উইলসন খেলার শুরুতেই হার্টফেল করে মারা যান। কিন্তু আমাদের সন্দেহ তার এই মৃত্যু মোটেই স্বাভাবিক নয়, তাকে বিষ খাইয়ে মারা হয়েছে।
ব্যাপারটা একটু খুলে বল জ্যাপ। পোয়ারো বলল।
-বলছি। রুশ বিপ্লব শুরুর পর ডঃ সাবাহরানকে বলশেভিকদের শত্রু বলে ঘোষণা করা হয়। এমন কি তখন গুজব রটে গিয়েছিল যে, ডঃ সাবারোনফকে তারা হত্যা করেছে। আসলে তিনি মারা যাননি। সাইবেরিয়ায় আত্মগোপন করেছিলেন। সেইসময় রোগে, শোকে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। নানান দেশ ঘুরতে ঘুরতে শেষে ইংল্যান্ডে এসে আশ্রয় নেন। তার ফ্ল্যাট তার ভাগ্নী সোলিয়া আর ভৃত্য আইভান থেকে। সাবারোনফের ধারণা বলশেভিকরা সুযোগ পেলে এখনও তাকে হত্যা করবে। সেজন্যে তিনি কোথাও বের হন না বা কারো সঙ্গে দেখা করেন না। ম্যাচ খেলার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন কয়েকবার। কিন্তু উইলসন তার ফলে ঢাক পিটিয়ে রটাতে থাকল যে সুযোগ পেলে সে তাকে গো-হারান হারিয়ে দেবে। অগত্যা তিনি রাজী হলেন সম্মান বাঁচাতে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সাবারোনফের শত্রুরা সেদিন তার পানীয়ে বিষ মিশিয়েছিল, কিন্তু কোনো বিশেষ ভুলে সেটা খেয়েছিল উইলসন।
–সাবানেফ মারা গেলে কে লাভবান হতো?
–তার ভাগ্নী।
–খেলাটা কোথায় হয়েছিল?
–তার ফ্ল্যাটে। খেলার সময় জনা সাত-আট লোক সেখানে ছিল।
–মৃতদেহ পরীক্ষা হবে কখন?
–আজই রাত্রে। চলুন না মর্গ থেকে একবার ঘুরে আসি।
–চলো।
উইলসনের মৃতদেহকে একটা টেবিলে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। তন্ন-তন্ন করে পরীক্ষা করে পোয়ারো মৃতদেহের বাঁ হাতে একটা পোড়ার দাগ দেখতে পেল। একজন কনস্টেবল মৃত উইলসনের পকেট থেকে পাওয়া একটা রুমাল, একতোড়া চাবি, মানিব্যাগ, একতাড়া নোট, কিছু খুচরো পয়সা আর একটা দাবার খুঁটি সেটা হাতির দাঁতে তৈরি–এগুলো নিয়ে এল। জ্যাপ জানালো খুঁটিটা উইলসনের হাতে মুঠোর মধ্যে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা ছিল। অনেক কষ্টে সেটা হাত থেকে ছড়ানো হয়েছে।
পোয়ারো জ্যাপের কাছ থেকে খুঁটিটা চেয়ে নিল আর বলল, খুঁটিটা ফের দেবার অছিলায় ডঃ সাবারোনফের সঙ্গে আমি একবার দেখা করতে চাই। আচ্ছা জ্যাপ, উইলসনের সম্পর্কে সবকিছু বললেও তুমি এটা আমাকে জানাওনি যে সে বাঁ হাতে সব কাজ করত অর্থাৎ ন্যাটা ছিল।
–মঁসিয়ে পোয়ারো, হা সে ন্যাটাই ছিল বটে। পোয়ারো হেসে বলল, চলি, কাল সকালে আমি ডঃ সাবাহরানফের সঙ্গে দেখা করতে যাবো।
.
ডঃ সাবারোনফের ওয়েস্টমিনস্টার অঞ্চলের বাড়িতে গিয়ে বেল টিপতে তার রুশ ভৃত্য আমাদের দরজা খুলে দিল। আমাদের পরিচয় জানিয়ে জ্যাপ একখানা চিঠি লিখে দিয়েছিল সেটা দেখাতে আইভান আমাদের ড্রইংরুমে বসালো।
পোয়ারো তৎক্ষণাৎ সামনের টেবিলের পায়ার কাছে মেঝের ওপর উবু হয়ে বসে কার্পেটখানাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, অত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো?
-দেখছি, এত দামী কার্পেটটাকে এইভাবে ফুটো করল কে?
ইতিমধ্যে সুন্দরী, অল্পবয়সী, নীলচুলের একটা মেয়ে ঘরে ঢুকল এবং নিজের পরিচয় দিল সাবারোনফের ভাইঝি সোনিয়া বলে।
পোয়ারো বলল, আমার নাম এরকুল পোয়ারো। গিলমোর উইলসনের মৃত্যু সম্পর্কে সামান্য কিছু খবর জানতে এসেছি।
–ও, তিনি তো হার্টফেল করে মারা গেছেন।
–পুলিশ সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ নয়।
–সেকি! আইভান তাহলে ঠিক কথাই বলেছে। তার ধারণা আমার মামাকে কেউ বিষ খাইয়ে মারতে চেয়েছিল কিন্তু মামা সেটা খাননি, খেয়েছে মিঃ উইলসন।
-আচ্ছা, আপনার মামার কোনো শত্রু আছে?
–কী জানি! মামা আমাকে বিশ্বাস করে কখনও কিছু বলেন না। অনেক বছর পর আমাদের আবার যোগাযোগ ঘটলো তো। তবে সবসময় তিনি কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকেন। আড়াল থেকে সেদিন তার মুখে একটা গুপ্ত সমিতির নাম শুনলাম। আচ্ছা মঁসিয়ে, আপনি চতুরঙ্গ বলে কোনোও সমিতির কথা জানেন।
পোয়ারো আর আমি চমকে উঠলাম। পোয়ারো বলল, এ নাম আপনি কোথায় শুনেছেন?
আড়াল থেকে। পরে এ-বিষয়ে মামাকে প্রশ্ন করাতে তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে আমার ধারণা ঐ গুপ্তসমিতিই হয়ত বিষ খাইয়ে মামাকে মারতে চেয়েছিল।
–আচ্ছা মাদাম, সেদিন কোনো টেবিলে খেলা হয়েছিল আর কে কোনোদিকে বসেছিলেন আমি জানতে চাই।
ঘরের কোণা থেকে একটা ছোট্ট টেবিল বার করে এনে সনিয়া বলল, এই টেবিলটা মামাকে এক ভদ্রলোক উপহার দিয়েছিলেন। ঘরের মাঝখানে ওটা পাতা হয়েছিল।
দাবার খুঁটিগুলো ভালো করে পরীক্ষা করল পোয়ারো। বলল, চমৎকার সেট।
এবার আমরা গেলাম ডঃ সাবারোনফের সঙ্গে দেখা করতে। দীর্ঘদেহী শীর্ণকান্তি পুরুষ, চোখদুটি উজ্জ্বল, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সোনিয়া ঘর ছেড়ে চলে গেল। অভিবাদন বিনিময়ের পরে পোয়ারো বলল, ডঃ সাবারোনফ, আপনার এই বিপুল সম্পত্তি আপনি মারা যাবার পর কে পাবে?
-আমার ভাগ্নী সোনিয়া। আমি সম্প্রতি উইল করেছি, তাতে আমি আমার সমস্ত সম্পত্তিই আমার মৃত্যুর পর সোনিয়া পাবে বলে লিখেছি। তা হঠাৎ এ প্রশ্ন?
তার কারণ, দীর্ঘকাল বাদে আপনি আপনার ভাগ্নীকে দেখছেন। কিন্তু যাকে আপনি ভাগ্নী বলে দেখছেন, সে যে আপনার ভাগ্নী তার প্রমাণ কি? যাগে এসব কথা। আপনাকে একটু সতর্ক করে দিলাম আর কি? এবার সেদিনকার খেলার একটু বর্ণনা দিন।
–খেলা তো হয়নি বললেই হয়। প্রথম চাল দিয়েই তিনি মুখ থুবড়ে পড়ে যান।
–কি চাল দিয়েছিলেন তিনি?
রাই লোপেজ–চাল। অনেকেই আজকাল এই চাল দিয়ে খেলা শুরু করেন।
–উইলসন কি সেদিন খেলা শুরুর আগে এখানে কিছু খেয়েছিলেন?
–এক পাত্র হুইস্কি খেয়েছিলেন। আর কিছু না।
–ধন্যবাদ। পোয়ারো বলল।
আমরা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলাম। আইভানকে দেখতে পেয়ে পোয়ারো জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, তোমাদের এই ফ্ল্যাটের ঠিক নিচেরটায় কে থাকেন?
–এই কয়েকদিন আগে নতুন এক ভাড়াটে এসেছেন। তার আগে অনেকদিন ওটা খালি পড়েছিল।
আমরা সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। বাড়িতে পৌঁছে টেবিলে একটা চিঠি পড়ে আছে দেখে পোয়ারো সেটা খুলল। জ্যাপের চিঠি। চিঠিতে লেখা ছিল যে, উইলসনের মৃতদেহ পরীক্ষা করে কোনো বিষের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। চিঠিটা পড়ে পোয়ারো বলল, আমি জানতাম উইলসনকে বিষ খাইয়ে মারা হয়নি। পকেট থেকে একটা দাবার খুঁটি বার করে পোয়ারো বলল, এই খুঁটিটা দেখে জেনেছিলাম। এটা আমি ডঃ সাবারোনফের বাড়ি থেকে হাতিয়ে এনেছি। আর উইলসনের মুঠোর খুঁটিটা আমার বাঁ পকেটে রয়েছে।
-কেন?
–দেখতে চাই এ দুটোর ওজন এক কিনা।
আমি পোয়ারোকে পাশের ঘর থেকে দাঁড়িপাল্লা এনে দিলাম। পোয়ারো দুটো খুঁটি দুটো পাল্লায় বসিয়ে দেখল দুটোর ওজন সমান নয়। উইলসনের মুঠোর হুঁটিটার পাল্লাটা ঝুলে পড়েছে। অর্থাৎ ঐ খুঁটি ভারী। এবং নিশ্চয়ই ওর মধ্যে কিছু কারচুপি করা আছে।
আলোর কাছে খুঁটিটা তুলে নিয়ে দেখল পোয়ারো। তারপর উল্টে ধরে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে বলল, দেখো, হেস্টিংস, এই খুঁটির মধ্যে দিয়ে একটা লোহার তার চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এরপরই কথার মধ্যে হঠাৎ পোয়ারো ফোন তুলে জ্যাপকে নির্দেশ দিল, ডঃ সাবারোনফের বাড়িতে যারা পাহারা দিচ্ছে, তাদের জানিয়ে দাও, আইভানের ওপর যেন কড়া নজর রাখে, সে যেন পালাতে না পারে। রিসিভার নামিয়ে এবার সে আমাকে বলল, এখনও তুমি কিছু বুঝতে পারনি হেস্টিংস। আরে উইলসন মোটেই বিষ খেয়ে মারা যায়নি, সে মারা গেছে ইলেকট্রিক শক খেয়ে। ডাঃ সাবারোনফের ঘরের মেঝেয় যে কার্পেটটা পাতা আছে, তার একজায়গায় আমি একটু ফুটো লক্ষ্য করেছিলাম। এবং সেই ফুটোটার তলাকার মেঝেটায় ছিল ফুটো।
–মেঝেতে আবার কারা ফুটো করল।
–হত্যাকারীরা। নিচের ফ্ল্যাটটা তারাই ভাড়া নিয়েছিল। তারা সেই ফ্ল্যাটের সিলিং ফুটো করে উপর তলার ঘরের অর্থাৎ ডঃ সাবাহরানফের ঘরের মঝের ওপরে তারা একটা বৈদ্যুতিক তার চালিয়ে দিয়েছিল। ঘরের মেঝে থেকে কার্পেটের ছ্যাদার মধ্যে দিয়ে টেবিলের তলা কুঁড়ে সেই তারের ডগাটা দাবার ছকের একটা নির্দিষ্ট জায়গা এসে পৌঁছে। আর সেটা রাইলোপেজ চাল দিয়ে খেলা শুরু করলে একটা নির্দিষ্ট খুঁটিকে যেখানে পৌঁছতে হয় সেখানে।
আমি সমস্ত ব্যাপারটা এবার বুঝলাম। উইলসন সেই খুঁটিটাকে যখন দাবার ছকের নির্দিষ্ট জায়গায় এগিয়ে দিয়েছে, ঠিক তক্ষুনি সেই ঘুটির মধ্যেকার লোহার তারটা সেখানকার বৈদ্যুতিক তারের সংস্পর্শে এসেছে, আর উইলসনও সেই মুহূর্তে কারেন্ট খেয়ে মারা যায়। বললাম, আমার তো মনে হয় এই চক্রান্তের সঙ্গে সাবারোনফের বাড়ির লোকেদের কিছু। যোগসাজশ আছে।
–তা তো আছেই। আমার মনে হয়, আইভানই চতুরঙ্গের সেই জল্লাদ।
–আর সোনিয়া?
এরপরই কথাত যারা পাহারা দিচ্ছে, তার নামিয়ে এবার সে আমাথায়নি, সে মারা
-সোনিয়া সেই জল্লাদেরই চর। ভাগ্নীর পরিচয়ে সে সাবারোনফের বাড়িতে ঢুকেছিল। আইভান আর সে মিলে ডঃ সাবারোনফকে শক খাইয়ে মারতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের প্ল্যানটা ভেস্তে গেল। কারণ সাধারণত সাবারোনফ সাদা ঘুটি নিয়ে খেলতেন। কিন্তু উইলসনের সঙ্গে খেলার দিন, তিনি উইলসনকে সাদা ঘুটি নিতে দেন। তাছাড়া নিজের আসনটা ছেড়ে প্রথম চালটা উইলসনকে দিতে বলেন। ফলে উল্টো ঘটনা ঘটল।
ফোনের ক্রিং আওয়াজে আমার চমক ভাঙ্গলো।
জ্যাপের গলা, বলল, মঁসিয়ে পোয়ারোকে জানাও আইভান সরে পড়েছে। ট্যাক্সি নিয়ে একটা পোড়ো বাড়িতে ঢুকেছে, পুলিশ এখন বাড়াটাকে ঘিরে রেখেছে।
ফোন নামিয়ে পোয়ারোকে সব জানালাম। বললাম, চার নম্বর তাহলে ধরা পড়ল।
-তাই কি? অর্থাৎ আইভানই যদি চার নম্বর হতো, তাহলে এত সহজে তাকে ঘেরাও করা অন্তত জ্যাপের পক্ষে সম্ভব হতো না। হেস্টিংস আমার একটা ভুল হয়ে গেল। গর্ব করতাম আমার কখনও ভুল হয় না। কিন্তু…
–কিন্তু কি?
দীর্ঘদিন বাদে মামা ভাগ্নীর দেখা হল, আমি ধরেই নিলাম ভাগ্নীটি জাল। এক্ষেত্রে মামাটি জাল। প্রথমে আমি সোনিয়াকে সন্দেহ করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, ডঃ সাবারোনফই হয়ত জাল। যাকগে, আর দেরি করা আমাদের ঠিক হবে না। সহজে ধরা দেওয়া আইভান আসলে নিতান্ত গোবেচারা মানুষ। আসল কালপিট ডঃ সাবারোনফই। চলো, তার ফ্ল্যাটে একবার হানা দেওয়া যাক।
বারবার বেল বাজিয়েও কারোর সাড়া না পেয়ে, দারোয়ানের কাছে সব চাবি ছিল; সেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি সোনিয়া হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। গোঁ-গোঁ করছে। মুখে কাপড় গোঁজা, নাকের উপর ক্লোরোফর্মের প্যাড। তাড়াতাড়ি বাঁধন খুলে ডাক্তার ডাকলাম। রিপোর্ট শুনলাম, ভয়ের কিছু নেই। খানিক বাদেই সুস্থ হয়ে উঠবে।
–ব্যাপার কি পোয়ারো? ডঃ সাবারোন কোথায়? তিনি যে অসুস্থ।
–মোটেই তিনি অসুস্থ নন। সত্যিকারের সাবারোনফ অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। আসল সাবাহরানফের সম্পত্তি হাতাবার জন্যেই এ লোকটা নকল পরিচয়ে লণ্ডনে এসে হাজির হয়েছিল। সম্পত্তিটা হাতিয়ে নিয়েছে। নকল সাবাহরানফকে মারার কোনো চক্রান্ত হয়নি। চক্রান্ত হয়েছিল উইলসনকে মারার। উদ্দেশ্য একটাই, নকল সাবাহরানফের ছদ্মপরিচয়টাকে গোপন রাখা। ভুলে যেও না আসল সাবারোনফ ছিলেন বিশ্বখ্যাত দাবা খেলোয়াড়। এদিকে নকল সাবারোনফ দাবার কিছুই জানেনা। এবং সেটা ফাঁস হবার আগেই সে উইলসনকে খতম করতে চেয়েছে। তাই সে করছেও।
বললাম, এরকুল, এরা যতখানি ধূর্ত, ঠিক ততখানিই নৃশংস।
.
১২.
শীতের সময় লন্ডন যেমন নোংরা তেমনি স্যাঁতস্যাঁতে।
পোয়ারো বলল, হেস্টিংস, ভাবছি যে, তুমি মাত্র মাস দুয়েকের জন্যে ইংল্যাণ্ডে এসেছিলে কিন্তু মাসের পর মাস কাটছে, তবু তুমি আর্জেন্টিনায় ফেরার নাম করছ না।
-ফিরবো কি করে? সিণ্ডেরেলা মোটেই স্বার্থপর মেয়ে নয়। সে ঠিক বুঝবে, তোমাকে একা ফেলে আমার পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যাকগে ও কথা বাদ দাও, এখন বলো চতুরঙ্গকে আমরা ঠিক কবে নাগাদ জালে আটকাতে পারবো?
–অধৈর্য হয়ো না হেস্টিংস, তাদের সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি, তার মূল্যও নেহাত কম নয়, আমরা দু নম্বর তিন নম্বর কর্তার খোঁজ পেয়েছি। চার নম্বরের কর্মকৌশলও আন্দাজ করেছি। আমি কি ভাবছি জানেনা, চতুরঙ্গ আমাদের ওপর আঘাত হানছে না কেন? তা যাই করুক, তুমি তাক থেকে আমার পাঁচখানা বই একসঙ্গে নামিয়েছো কেন? সব বইগুলো একসঙ্গে পড়ছো?
একটা কথা বলা দরকার, পোয়ারো ভীষণ ফিটফাট মানুষ। শৃঙ্খলার অভাব সে আদৌ বরদাস্ত করে না। এরপর পোয়ারো বলল, আমি একটু বেরোচ্ছি। ফিরে এসে যেন দেখতে পাই সব জায়গামতো সাজানো আছে। পোয়ারো বেরিয়ে গেল।
এরপর লেডি পিয়ারসন আমাকে একটা টেলিগ্রাম দিয়ে গেল।
টেলিগ্রামটা দক্ষিণ আমেরিকায় আমার কাজকর্ম যে দেখাশোনা করে সেই ব্রনসেন পাঠিয়েছে। সে জানাচ্ছে :
গতকাল থেকে মিসেস হেস্টিংস নিখোঁজ। অপেক্ষা করছি যে, চতুরঙ্গ নামে কোনো গুপ্ত সমিতি তাকে চুরি করেছে। পুলিশে খবর দিয়েছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মিসেস হেস্টিংসের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ব্রনসেন।
সিণ্ডেরেলা নিখোঁজ। আমি পাথরের মতো বসে রইলাম। কি করব। পোয়ারোকে এক্ষুনি এ-কথা জানানো দরকার। সে নিশ্চয় কোনোও পথ বার করতে পারবে।
দরজায় আবার টোকা পড়ল। মিসেস পিয়ারসন এবার একটা চিঠি দিয়ে গেলেন। আর তিনি জানালেন, পত্রবাহক একজন চীনেম্যান উত্তরের জন্যে নিচে অপেক্ষা করবে। ছোট্ট চিঠি। তাতে লেখা?
আপনি যদি আপনার স্ত্রীকে আবার জীবিত অবস্থায় দেখাতে চান, তাহলে পত্রবাহকের সঙ্গে চলে আসুন। আপনার বন্ধু পোয়ারোকে এ-কথা জানাবেন না। যদি জানান, তাহলে আপনার স্ত্রীকে তার ফল ভুগতে হবে।
চিঠির নিচে লেখা রয়েছে : ৪।
.
এ চিঠি পাবার পর আমি কী করতে পারতাম? ভাববার মতো মানসিক অবস্থাই আমার নেই।
মুহূর্তে মনস্থির করে নিলাম। পত্রবাহকের সঙ্গে আমি যাব। যা ঘটে ঘটুক।
কিন্তু পোয়ারোকে আমি যদি তা চিঠিতে লিখে দিয়ে যাই, তাহলে চতুরঙ্গের চররা নিশ্চয়ই জানতে পারবে। তার ফল ভুগতে হবে আমার সিণ্ডারেলাকে। আমি বরং এই টেলিগ্রামটাই টেবিলে রেখে দিয়ে যাই। পোয়ারো সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
আমি নিচে নেমে চীনেম্যান পত্রবাহককে দেখতে পেলাম। সে আমার জিজ্ঞেস করল, আপনিই ক্যাপ্টেন হেস্টিংস?
–হ্যাঁ।
–চিঠিটা আপনি পড়েছেন?
–হ্যাঁ।
চিঠিটা ফেরৎ দিন আমাকে।
আমি জানতাম চিঠিটা ওরা ফেরৎ চাইবে। সঙ্গেই এনেছিলাম। ফেরৎ দিলাম।
দাঁত বের করে লোকটা হেসে বলল, আর্জেন্টিনা থেকে আপনার নামে যে টেলিগ্রামটা এসেছে, সেটাও দিন।
আমি হতবাক। ব্রনসেন টেলিগ্রাম করেছে, তাই কি এদের নজর এড়ায় না।
আমি কিছুই করার নেই ভেবে টেলিগ্রামটা এনে তার হাতে দেব বলে ওপরে গেলাম। কিন্তু এখন পোয়ারোর জন্যে কিছু একটা সঙ্কেত রেখে যেতে হবে। হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তাক থেকে চারখানা বই নামিয়ে নিয়ে বিছানায় ফেলে রাখি। পোয়ারো সংকেতটা নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারবে। তাই করলাম।
টেলিগ্রাম নিয়ে নিচে এসে চীনেম্যানটার হাতে দিলাম। সে বলল, আসুন।
আমি তার সঙ্গে যত পথ ঘুরলাম তার হিসেব নেই। কখনও বাসে, কখনও ট্রেনে, কখনও হেঁটে, ঘিঞ্জি নোংরা সব পাড়া ঘুরে আমি এমন একটা অঞ্চলে পৌঁছালাম যেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা চীনে।
এঁদো একটা গলির মধ্যে জরাজীর্ণ একটা বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়তে একটা চীনে দরজা খুলে দিল। সেই লোকটার হাতে সে আমাকে সঁপে দিতে দ্বিতীয় চীনাটা আমাকে বাড়ীর মধ্যে নিয়ে গেল। সিঁড়ি, উঠোন পেরিয়ে আমরা একটা হলঘরে গিয়ে হাজির হলাম। ঘরে বিরাট বিরাট বস্তা সাজানো আর তার থেকে কড়া একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম।
আমার সঙ্গী দেয়ালের ধার থেকে একটা বস্তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। দেখলাম দেয়ালে একটা ফোকর রয়েছে। সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে আমরা একটা বিরাট ঘরে পৌঁছলাম। আমার সঙ্গী সেই ঘরের দেয়ালে পরপর চারবার টোকা দিতেই যেন একটা ভোজবাজি ঘটে গেল। দরজা খুলে গেল। একটা ঘরে ঢুকলাম। মনে হয় আরব্য রজনীতে বর্ণিত কোনো মায়াকক্ষে আমি হাজির হয়েছি। দরজায় রেশমের পর্দা ঝুলছে।
পর্দার আড়াল থেকে পরিষ্কার ইংরাজীতে কে যেন জিজ্ঞেস করল, ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে নিয়ে এসেছ?
সঙ্গী বলল, হ্যাঁ।
পর্দা সরে গেল। দেখলাম একটা দীর্ঘদেহী মানুষ বসে আছে। সে চীনদেশের মানুষ।
–আসুন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আমার অনুরোধ রাখার জন্যে ধন্যবাদ।
–কে আপনি? আপনিই কি বিল চ্যাংয় ইয়েন?
-না, আমি তার নগণ্য এক নফর মাত্র। আমার মতো অসংখ্য নফর দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে।
বুকের মধ্যে ধক করে উঠল, বললাম, আমার স্ত্রী কোথায়?
–যেখানেই থাকুন তিনি নিরাপদে আছেন। এখনও তার কোনো বিপদ ঘটেনি। তবে যেকোনো মুহূর্তে তাকে আমরা হত্যা করতে পারি।
-কেন তাকে আটকে রেখেছেন? টাকার জন্যে? কত টাকা চান আপনারা?
–আমাদের প্রয়োজনীয় টাকা মেটানো আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না।
তবে কেন তাকে আটকে রেখেছেন?
-তাঁকে না আটকালে কি আপনাকে আমরা হাতের মুঠোয় পেতাম। আর আপনাকে না পেলে সেই বেলজিয়াম গোয়েন্দাটাকে আমার পাবো কিভাবে?
-মানে?
-মানে সোজাই। আপনাকে মঁসিয়ে পোয়ারোকে একটা চিঠি লিখতে হবে। তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখানে আনতে হবে।
অসম্ভব। অমন চিঠি আমি মেরে ফেললেও লিখতে পারবো না।
দরজার দিকে তাকিয়ে একটা হাততালি দিল লোকটা। দুজন চীনেম্যান এলো। লোকটা তাদের উদ্দেশ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কীসব বলতেই তারা আমার হাত-পা বেঁধে ঠেলতে ঠেলতে ঘরের এককোণে নিয়ে গেল। হঠাৎ দেখলাম, আমার সামনের মেঝের উপরে খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।
দীর্ঘদেহী মানুষটি আমাকে বলল, ক্যাপ্টেন, ঐ ফাঁকের নিচ দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে। এখনও বলুন চিঠি লিখতে রাজী আছেন কিনা?
–যদি না লিখি?
–হাত পা বাঁধা অবস্থায়ঐ নদীর মধ্যে আপনাকে ফেলে দেওয়া হবে।
–তাহলে তাই করুন। আমি বরং ডুবে মরি, কিন্তু তাই বলে আমার বন্ধুকে আমি ডোবাতে পারবো না।
.
১৩.
মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আমি কখনও দেখিনি। এখুনি আমাকে ফেলে দেওয়া হবে।
আশ্চর্য, নদীগর্ভে আমাকে ফেলে দেওয়া হল না। কিন্তু আমাকে না মেরে আমার স্ত্রীকে তিলে তিলে মারবার ভয় দেখানো হল আমাকে। ভয়াবহ উপায়ে অমানুষিক শাস্তি দেওয়া হবে তাকে।
আমি আঁতকে চেঁচিয়ে উঠলাম, না, না, তার কোনো দোষ নেই। তাকে আপনারা নির্যাতন করবেন না।
–তাহলে ঐ কলমটা তুলে নিয়ে আপনার বন্ধু মঁসিয়ে পোয়ারোর কাছে একটা চিঠি লিখুন। তাহলে আপনার স্ত্রীকে আমরা মুক্তি দেব।
আমি যা বলছি, শুধু তাই লিখুন।
আমি কাগজে কলম ছোঁয়ালাম। লিখলাম ঃ
প্রিয় পোয়ারো,
চতুরঙ্গের গুপ্তঘাঁটির সন্ধান আমি পেয়েছি। আজ বিকেলে চতুরঙ্গের চর একজন চীনেম্যান আমাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেছিল। একটা ভুয়ো-খবর দিয়ে সে আমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখানে নিয়ে আসে। তখন তার চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়ি, এবং খানিক বাদে আমিই তার অলক্ষ্যে তাকে অনুসরণ করতে থাকি। এখানে তাদের গুপ্তঘাঁটি একটা পোড়ো বাড়িতে সে ঢুকেছে। আমি দূর থেকে বাড়ীটায় নজর রাখছি। বাড়ীটার মধ্যে ঢোকা আমার একার কাজ নয়। তাই একটা ছেলেকে নিয়ে তোমার কাছে চিঠি পাঠালাম। পত্রপাঠ তুমি চলে এসো। একটা কথা, তোমার গোঁফ দেখলে লোকে চিনে ফেলবে, তাই মাফলারে মুখটাকে ভালোভাবে ঢেকে আসবে। আমি তোমার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করে রইলাম। তুমি এলে আমরা দুজনে মিলে চতুরঙ্গের ঘাঁটিতে হানা দেব। ভালোবাসা সহ,
ইতি–
হেস্টিংস
ডিক্টেশন অনুযায়ী চিঠিখানা লিখতে লিখতে লজ্জায়,অপমানে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। আমি নিজের হাতে বন্ধুকে শত্রুর হাতে তুলে দিচ্ছি; যে বন্ধু এ চিঠি পেয়েই ছুটে আসবে। অথচ এছাড়া আমি আর কী-ই বা করতে পারি? পোয়ারোর চাইতে আমার স্ত্রীর নিরাপত্তার প্রশ্নই এখন আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
আমি ঢ্যাঙা লোকটাকে বললাম, এবার আমার স্ত্রীকে ছেড়ে দেবেন তো?
–দাঁড়ান। আগে পোয়ারোকে আমরা গ্রেপ্তার করি, তারপর তাকে ছাড়া হবে।
–তোমরা শঠ, প্রতারক। কুকুরের চাইতেও ঘৃণ্য জীব।
এতটুকু উত্তেজিত হল না লোকটা। বলল, চটবেন না ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। বলে আমাকে ঘরের মধ্যে ফেলে রেখে লোকটা চলে গেল।
ঘণ্টা কয়েক বাদে সেই ঢ্যাঙা লোকটা ঘরে ঢুকে বলল, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আপনার বন্ধু আমাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন। তিনি এই দিকেই এগিয়ে আসছেন। যেহেতু তিনি আপনাকে দেখলে এ বাড়ীতে ঢুকতে রাজী হন, তাই আপনাকে দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। যদি কোনো চালাকি করার চেষ্টা করেন তো তার ফল ভয়াবহ হবে। আমি সদরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেই ঢ্যাঙা লোকটা আর জনাকয় সঙ্গী আমার পিছনে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। দেখলাম পোয়ারো আসছে একটা অল্পবয়সী ছেলের সঙ্গে। পোয়ারোর মুখটা দেখলাম মাফলার দিয়ে ঢাকা, ভীষণ খারাপ লাগছিল আমার। রাস্তা পার হয়ে সে ব্যাকুল মুখে আমারদিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, যাক, তোমার কোনো বিপদ হয়নি তো? উঃ কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম, বলো, এখন কি করতে হবে?
আমি আর পারলাম না। চেঁচিয়ে উঠলাম বিকৃত গলায়, পালাও এরকুল, পালাও। এটা একটা চক্রান্ত। এরা তোমাকে…
দরজার পেছন থেকে ছুটে বেরিয়ে লাফ দিয়ে দাঁড়াল চতুরঙ্গের এক অনুচর।
পোয়ারো এক পা পিছিয়ে গেল। তারপরেই এক প্রচণ্ড শব্দ শুনলাম আর রাশি রাশি ধোঁয়া। আমার দম আটকে এল। দু-চোখে অন্ধকার নেমে এল। আর কিছু মনে নেই আমার।
জ্ঞান হবার পরে প্রথমে যার মুখ দেখলাম, সে পোয়ারো। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে সে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল।
তারপর আমাকে সে বলল, বিছানার উপরে এলোমেলোভাবে চারখানা বই তুমি ছড়িয়ে গিয়েছিলে। সেই সংকেতের অর্থ বুঝে আমার এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তুমি চতুরঙ্গের পাল্লায় পড়েছ। এটাও বুঝলাম, আমাকে ধরার জন্যে তোমাকে টোপ হিসেবে তারা ব্যবহার করতে চায়। আমি সঙ্কেতটা জ্যাপকে জানিয়ে আমার ফ্ল্যাটের ওপর নজর রাখতে বললাম। তখুনি স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের জনাকয় ছদ্মবেশী লোক নজর রাখতে থাকে।
খানিক বাদেই একটা ছেলে আমার কাছে তোমার চিঠিটা নিয়ে এল। আমি তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। অলক্ষ্যে অনুসরণ করতে লাগল সেই ছদ্মবেশী গোয়েন্দারা। আমি জানতাম আমার ওপর হামলা হবে। তাই আমি আমার কয়েক বছর আগে যোগাড় করা গ্যাসবোমাটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। চতুরঙ্গের লোকেরা আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তেই আমি বোমাটা ফাটালাম। আর সকলে অজ্ঞান হয়ে গেল সেই বিষাক্ত ধোঁয়া নাকে যেতে।
–কিন্তু ধোঁয়া তো তোমার নাকেও গিয়েছিল, তুমি কেন অজ্ঞান হওনি?
–ঐ যে চিঠিতে আমার গোঁফ নিয়ে ঠাট্টা করা হয়েছিল, মাফলার দিয়ে আমি যেন মুখটাকে ঢেকে রাখি। তাই মাফলার লাগিয়েছিলাম। আর তার আড়ালে ছিল ধোঁয়া নিরোধক ছোট্ট যন্ত্র রেসপিরেটর। তাই আমি অজ্ঞান হইনি।
একথা শুনে আমি হাসতে গেলাম। কিন্তু তখুনি আমার মনে পড়ল সিণ্ডারেলার কথা। বললাম, এরকুল আমার স্ত্রীর কী হবে?
তার মানে? তোমার স্ত্রীর আবার কি হবে? পোয়ারো হতভম্বের মতো প্রশ্ন করল।
–সেতো এখন চতুরঙ্গের হাতে বন্দিনী। ব্রনসেন আমাকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েছে সে চতুরঙ্গের হাতে বন্দিনী। চতুঙ্গের লোকেরাও আমাকে শাসিয়েছিল যে, তোমায় যদি আমি চিঠি না লিখি তাহলে তিলে তিলে ওকে হত্যা করবে।
সব শুনে পোয়ারো বলল, ছি ছি, স্রেফ বাজে কথা। তোমার স্ত্রীকে মোটেই ওরা আটক করতে পারেনি। অনেকদিন আগেই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে, চতুরঙ্গের লোকেরা হয়তো তোমার স্ত্রীকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের বন্দী করবে। তাই আগে থাকতেই আমি দক্ষিণ আমেরিকায় চিঠি লিখে তাকে এমন জায়গায় সরিয়ে দিয়েছি যাতে ওরা তার নাগাল না পায়। এখন মনে হচ্ছে, তোমাকে আগেই ওসব কথা আমার বলা উচিত ছিল। থাক, এখন নিশ্চিন্ত হলো তো?
–এরকুল, বিশ্বাস করো, আমি যদি জানতাম ওরা আমার স্ত্রীর সম্পর্কে মিথে ভয় দেখাচ্ছে, তাহলে কিছুতেই তোমাকে ঐ চিঠি লিখতে রাজী হতাম না।
-জানি। আমি জানি যে তুমি কাপুরুষ নও।
.
১৪.
গ্যাস বোমা ফাটতেই ঐ ঢ্যাঙা লোকটা সরে পড়েছিল। পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করল তারা নেহাতই চুনোপুঁটি। জ্ঞান ফিরলে তারা জানাল, চতুরঙ্গের কোনোদিন নামই শোনেনি। তারা ঐ বাড়িতে চাকরের কাজ করত মাত্র, মালিকের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তারা কিছু জানে না। বাড়ীটায় তল্লাসী চালিয়ে জনপ্রাণীর দেখা মেলেনি।
-এরকুল আমরা শুধু হেরেই যাচ্ছি।
দৃঢ় গলায় পোয়ারো বলল, না, তা বলতে পারি না। চতুরঙ্গের চার নম্বর কর্তাকে নিয়েই একটু মুশকিল বেঁধেছে। চার নম্বরকে সনাক্ত করা কঠিন বটে কিন্তু তার সম্পর্কে যে আমরা কিছুই জানিনে, এমন বলাও ঠিক নয়।
-কী জানো তার সম্পর্কে?
-জানি যে, সে মাঝারী দৈর্ঘ্যের মানুষ। এ যাবৎ যে কয়জনের ভূমিকায় তাকে দেখা গেছে, তাদের কারুর দৈর্ঘ্য খুব বেশি নয়। দ্বিতীয়ত, তার নাকটা চ্যাপ্টা। চ্যাপ্টা নাকের লোকেদের পক্ষে নাক খাড়া করা সহজ ব্যাপার কিন্তু খাড়া নাকের লোকের পক্ষে নাকটাকে চ্যাপ্টা করা সহজ নয়। তৃতীয়ত, তার বয়স মোটামুটি ৩০/৩৫ এর মধ্যে। চতুর্থত, তার সমস্ত দাঁত কিংবা অধিকাংশ দাঁতই নকল। কেননা রক্ষীর ভূমিকায় তার দাঁতগুলো ছিল ভাঙাচোরা। ডাঃ কুয়েন্টিনের ভূমিকায় দেখেছি তার সামনের দাঁত ছিল উঁচু। ডঃ সাবারোনফের ভূমিকায় দেখেছি সামনের দাঁত উঁচু ছিল না। দাঁত যদি আসল হতো এভাবে পাল্টানো যেত?
–ছদ্মবেশ ধারণে দেখছি লোকটা ওস্তাদ।
–সেজন্যেই আমার মনে হয় লোকটা এককালে পাকা অভিনেতা ছিল। তা না হলে বিভিন্ন ভূমিকায় তার চালচলন এত সহজ হতো না।
–তাহলে এখন আমাদের করণীয় কি?
করণীয় আর কিছুই নয়। এমন একজনকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের, যে বছর ৩/৪ আগেও স্টেজে অভিনয় করেছে, বয়স মোটামুটি ৩০/৩৫। সত্যি বলতে কি, ইতিমধ্যেই আমি এমন চারজন মানুষের খোঁজ পেয়েছি।
সেই চারজনের বর্ণনা শোন, পোয়ারো বলে যেতে লাগল। প্রথম জন আনোট নাটরেল। তেইশ বছর বয়সে রঙ্গমঞ্চে যোগ দিয়ে বিভিন্ন ভূমিকায় সে অভিনয় করেছে। চার বছর আগে ইংল্যাণ্ড পরিত্যাগ করেছে। উচ্চতা ৫৮”। নাক সোজা, চোখ বাদামী।
দ্বিতীয়জন–জন মরে। গরিব ঘরের ছেলে। বছর তিনেক যাবৎ নিখোঁজ। বাল্যবয়স থেকে অভিনয় করছে। উচ্চতা ৫৮”।
তৃতীয় জন-অস্টেন লী। অক্সফোর্ডের ছাত্র। ছাত্রজীবনেই অভিনয়ে যোগ দেয়। যুদ্ধে যোগ দিয়ে কৃতিত্ব দেখায়। বছর তিনেক আগে মোটর অ্যাক্সিডেন্টে আহত হয়। তারপর আর অভিনয় করেনি। ঠিকানা জানা নেই। বয়স ৩৫। উচ্চতা ৫৭”। চোখ নীল।
চতুর্থ জন-ক্লড ডরেল। বংশপরিচয় কেউ জানে না। ভ্রাম্যমাণ থিয়েটারের সঙ্গে অনেক দেশে গিয়েছে। ১৯১৯ সালে চীনে গিয়েছিল। ফিরতি পথে আমেরিকায় নামে। নিউইয়র্কে কিছুদিন অভিনয় করে। তারপর হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয়ে যায়। বয়স ৩৩। চোখের রং কটা। উচ্চতা ৫৮”।
–এই চারজনের মধ্যে তোমার কাকে সন্দেহ হয়? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
–চারজনকেই, তবে ক্লড ডরেলকেই সন্দেহ হয় সবচেয়ে বেশি।
–তা এই সন্দেহজনক চারজন লোকের খোঁজ পাওয়া যাবে কী করে?
–কাগজে আলাদা আলাদাভাবে এই চারজনের নামে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। তাতে এদের আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধব, অবিলম্বে মিঃ ম্যাকনীলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ম্যাকনীল আমার অ্যাটর্নী।
টেলিফোনটা বেজে উঠল।
পোয়ারো বলল, হ্যালো, আমি পোয়ারো…মিঃ ম্যাকনীল? তাই নাকি? …আচ্ছা ওকে বসিয়ে রাখুন, আমি এখুনি যাচ্ছি।
ফোন নামিয়ে পোয়ারো বলল, ক্লড ডরেলের এক বান্ধবী মিঃ ম্যাকনীলের সঙ্গে দেখা করেছে। চল সেখানে যাই।
ট্যাক্সি ধরে সোজা ম্যাকনীলের অফিসে। একটি রোগা মেয়ে চেয়ারে বসেছিল। পোশাকে বোঝা যাচ্ছে অবস্থা খুব ভালো নয়। বয়স বোঝার উপায় নেই।
–আসুন, মঁসিয়ে পোয়ারো। মিস ফ্লসি মনরোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি মিঃ ক্লড ডরেলের বান্ধবী। মিঃ ম্যাকনীল বললেন।
পোয়ারো হেসে তাকে বলল, তাই নাকি?
–হ্যাঁ, ক্লডি আমার বন্ধু ছিল। আপনাদের বিজ্ঞাপন পড়ে মনে হল, হয়তো ক্লডির কোনোও বড়লোক আত্মীয় মরবার সময় তাকে কিছু সম্পত্তি দিয়ে গেছে, তাই আপনারা ওর খোঁজ করছেন। তাই ওকে খুঁজে বার করার সুবিধার জন্যে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।
পোয়ারো বলল, মাদমোয়াজেল, চলুন কোনোও রেস্তোরাঁয় বসি গিয়ে। মিস মনরো আপত্তি করলেন না। আমরা বেরিয়ে একটা শৌখিন রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলাম।
লাজুক হেসে মনরো বলল, ক্লডি ছিল আমার বন্ধু। আমাকে ভালোবাসত। তারপর বিয়ে করবে বলে আশায় আশায় রেখে একদিন সে নিখোঁজ হল।
–আচ্ছা, তার কোনো মুদ্রাদোষ আছে?
–আছে। এক চুমুক শ্যাম্পেন খেয়ে মনরো বলল, খাবার টেবিলে একটুকরো রুটি হাতে নিয়ে, সে রেকাবির গায়ে সেই টুকরোটাকে ঘষতে থাকে। এটা তার অনেকদিনের মুদ্রাদোষ। এই নিয়ে আমি অনেক ঠাট্টাও করেছি।
পোয়ারোর চোখদুটো চকচক করে উঠলো, আচ্ছা মিস মনরো, তার লেখা কোনো চিঠি আপনার কাছে আছে?
-না, চিঠি নেই, তবে ওর একটা ফটো আমার কাছে আছে।
উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠল পোয়ারো, কোথায় তার ফটো?
–আমার বাসায় আছে। আজ বিকেলে আপনার ফ্ল্যাটে আমি ফটো নিয়ে দেখা করব আপনার সঙ্গে।
নিশ্চয়ই।
–মিস মনরো বিদায় নিলেন।
ফ্ল্যাটে ফিরে এসেই জ্যাপকে ফোন করে পোয়ারো বলল, মিস ফ্লসি মনরো নামে এক মহিলার সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে। আজ বিকেলে তিনি আমার কাছে আসবেন। হয়তো তাকে মারবার চেষ্টা হতে পারে। তুমি দুজন গোয়েন্দা পাঠাবার ব্যবস্থা করো। কেউ যেন মনরোর কাছে ঘেঁষতে না পারে।
ফোন নামিয়ে রাখল পোয়ারো। কিন্তু তার মিনিট কয়েক বাদেই আবার ফোন বেজে উঠল। আমি ধরলাম। সেন্ট জেমস হাসপাতাল থেকে বলা হোল, একটু আগে এক ভদ্রমহিলা মোটর চাপা পড়েছেন। নাম মিস মনরো। তার অবস্থা সঙ্কটনজক এবং তিনি বারবার আপনার নাম বলছেন। গাইড থেকে আপনার নম্বর খুঁজে ফোন করছি। এখুনি হাসপাতালে যেন আসেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
আমরা এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে পৌঁছাতেই একজন নার্সের মুখ থেকে শুনলাম, একটু আগে তিনি মারা গেছেন।
পোয়ারো নার্সের দিকে চেয়ে বলল, ওঁর ব্যাগে আপনারা কি একটা চাবি পেয়েছেন? কারণ তিনি ফ্ল্যাটে একলা থাকতেন। বেরোবার সময় নিশ্চয় চাবি নিয়ে বেরিয়েছেন।
-না, টুকিটাকি জিনিষ ছাড়া কোনো চাবি আমরা পাইনি।
পোয়ারো আমাকে বলল, চলো হেস্টিংস, চারনম্বর মিস মনরোর বাসা থেকে সরে পড়বার আগেই আমার সেখানে পৌঁছোনো দরকার।
আমরা ট্যাক্সি ধরলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার পোয়ারো?
পোয়ারো বলল, মিস মনরো মোটর চাপা পড়েছেন। সেটা আকস্মিক নয়, চার নম্বর তাকে গাড়ী চাপা দিয়েছে কারণ সে জানতে পেরেছে মনরোর কাছ থেকে আমরা তার সম্বন্ধে খবরাখবর পাচ্ছি। এবং দুর্ঘটনার পর রাস্তার ভিড়ের মধ্যে চারনম্বরের কোনো অনুচর চাবিটা তার ব্যাগ থেকে হাতিয়েছে। চাবি দিয়ে তার মনরোর বাসায় ঢুকে সমস্ত তথ্য সরিয়ে ফেলবে। এই তো আমরা এসে গেছি।
তাড়াতাড়ি মনরোর ফ্ল্যাটে এলাম। দরজা খোলাই ছিল, বুঝলাম কেউ ঢুকেছিল। মেঝের ওপর স্তূপীকৃত কাগজপত্র, আলমারির পাল্লা খোলা, টেবিলের ড্রয়ার হাঁ করা দেখেই বোঝা গেল তল্লাশীর কাজটা ভালোভাবেই সারা হয়েছে। মেঝের ওপর একটা ফটোফ্রেম পড়ে ছিল, ফটো উধাও। এ সবই চতুরঙ্গের চারনম্বরের কাজ বুঝতে একটুও অসুবিধা হলনা।
.
১৫.
মিস মনরোর মৃত্যুর পরে পোয়ারোর চরিত্রে রাতারাতি একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। বাড়ি থেকে বেরোয় না, কথা বলে কম। কিন্তু আমার মনে হতো, সে চুপচাপ বসে নেই, তলেতলে সে পাল্টা আঘাতের আয়োজন করছে। অদ্ভুত চেহারার এক একজন মানুষ মাঝে মাঝেই তার কাছে আসে। চাপা গলায় তাদের কথা হয়, তারপর নিঃশব্দে বিদায় নেয়। দিন কয়েক আগে একজন রাশিয়ানকে সে একটা মোটা অঙ্কের চেক দিয়েছে।
একদিন মার্চের শেষের দিকে পোয়ারো আমাকে ডেকে বলল, চল, আমাদের স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী মঁসিয়ে দেজার্দু এখন লণ্ডনে। স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনার সময়ে তিনিও উপস্থিত থাকবেন।
মিঃ সিডনি ক্রোথারের বাড়িতে গোপন বৈঠকে মোট পাঁচজন উপস্থিত ছিলেন। আমি এবং পোয়ারো ছাড়া মিঃ ক্রোথার, মঁসিয়ে দেজার্দু, মিঃ ইনগ্লেস।
মাঁসিয়ে দেজাদুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ক্রোথার বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো চতুরঙ্গের ব্যাপারটা এবার বুঝিয়ে বলুন।
পোয়ারো অল্প কথায় বলল, চতুরঙ্গ একটা গুপ্ত সংগঠন। পৃথিবীর সর্বত্র এরা রাষ্ট্রিয় কাঠামোকে ধ্বংস করতে চায়। মোট চারজন এই সংগঠন চালায়। সেজন্যেই এই সংগঠনের নাম চতুরঙ্গ। প্রথমজন একজন চীনা লি চ্যাং ইয়েন, দ্বিতীয়জন মার্কিন কোটিপতি আবে রাইল্যাণ্ড। তৃতীয়জন এক ফরাসী মহিলা; চতুর্থজন এক ইংরেজ তার নাম ক্লড ডরেল।
মঁসিয়ে দেজার্দু হাসছিলেন। পোয়ারোর কথার একবর্ণও তার বিশ্বাস হয়নি। তিনি বললেন, আবে রাইল্যাণ্ড একজন বিখ্যাত মানুষ। তাঁর সম্পর্কে আপনি এসব কি বলছেন? পোয়ারো বলল, ঠিকই বলছি, মঁসিয়ে। আমার প্রত্যেকটি কথার প্রমাণ দিতে পারি।
মিঃ ক্রোথার বললেন, স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডকেও মঁসিয়ে পোয়ারো তথ্যপ্রমাণ দেখিয়েছিলেন।
দেজার্দু বলেছিলেন, মিঃ রাইল্যাণ্ডের কথা না হয় বুঝলাম, কিন্তু ফরাসী মহিলাটি কে?
-মাদাম অলিভিয়ের, পোয়ারো বলল।
–অসম্ভব! মাদাম কুরির পরে তাঁর মত বিজ্ঞানী কোনো দেশে জন্মায়নি। তাঁর নামে এ কি অন্যায় কথা বলছেন? মিঃ ক্রোথার আপনিও কি এইসব আজগুবী কথা বিশ্বাস করেন?
না করে উপায় নেই, মঁসিয়ে। তাঁর সম্পর্কে যে সব প্রমাণ মঁসিয়ে পোয়ারো যোগাড় করেছেন তারপরে বিশ্বাস না করে পারা যায় না।
গুম হয়ে বসে রইলেন দেজার্দু। অনেকক্ষণ বাদে বললেন, মাদাম অলিভিয়েরের বিরুদ্ধে যে প্রমাণই আপনারা দিন না কেন, ব্যাপারটা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু এবার বলুন লি চ্যাং ইয়েন আবার কে? এমন নাম তো শুনিনি।
মিঃ ইনগ্লেস এবারে মুখ খুললেন, খুব কম লোকই তার নাম শুনেছে। চীনে দীর্ঘকাল কাটানোর ফলে আমি তাকে চিনি। আড়াল থেকে কাজ হাসিল করে। পৃথিবী জুড়ে আধিপত্য বিস্তারের লালসায় বোধহয় এমন কাজ নেই সে করতে পারে না।
মিঃ ক্রোথার এবার পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি আর কিছু বলবেন মঁসিয়ে?
-হ্যাঁ, আমার আর একটা কথা বলার আছে। চতুরঙ্গের চক্রান্ত ছিঁড়ে ফেলবার জন্যে এতদিন ধরে আমি যে আয়োজন করেছি, তাদের আক্রমণে আমার মৃত্যু হলে তা যাতে ব্যর্থ না হয় তাই চতুরঙ্গ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আমি একটা খাতায় লিখে রেখেছি, আর সেই খাতাখানাকে আমি একটা ব্যাঙ্কের ভল্টে রেখে দিয়েছি। মিঃ ক্রোথার এই নিন তার চাবি। যদি তারা আমাকে হত্যা করে আপনি খাতাখানাকে বার করে নেবেন, চতুরঙ্গের বিরুদ্ধে কিভাবে এগোতে হবে তার নির্দেশ ওতে পেয়ে যাবেন। আর আমার কিছুই করার নেই।
আমরা সবার কাছে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে এলাম। মিঃ ইনগ্লেসও আমাদের সঙ্গে বেরোলেন। তিনি বললেন, খুব শিগগির আবার চীনে যাচ্ছি। লি চ্যাং ইয়েনকে খুঁজে বার কর জোনাথান হোয়েলিকে হত্যা করার অপরাধে শাস্তি দেবার জন্যে। বলে ইনগ্লেস একটা বাসে উঠে পড়ল।
হাঁটতে হাঁটতে পোয়ারো বলল, জানো হেস্টিংস, এক একসময় মনে হয় বেলজিয়াম থেকে আমার যমজ ভাইকে নিয়ে আসি।
পোয়ারোর যে ভাই আছে আমি জানতাম না। বললাম, তার নাম কি?
–আকিল পোয়ারো। তার যেমন বুদ্ধি তেমনি সাহস। তার পরামর্শ নিয়ে আমি বিস্তর রহস্যের সমাধান করেছি। হুবহু আমার মতো দেখতে, তার গোঁফ নেই।
বাড়ী ফিরতে দেখলাম এক নার্স ভদ্রমহিলা পোয়ারোর জন্যে অপেক্ষা করছে। পরিচয় বিনিময়ের পর সে বলল, আমার নাম ম্যাবেল পামার। লার্ক ইনস্টিটিউশন থেকে আমাকে, এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক মিঃ টেম্পলটনের বাড়ী হার্টফোর্ডশায়ারে পাঠানো হয় তাঁকে সেবার। করার জন্যে। এক ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। ছেলেটি হাবা গোছের, প্রথমপক্ষের। সৎ মায়ের সঙ্গে তার বনিবনা নেই। মিঃ টেম্পলটনের প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর তিনি এক অল্পবয়সী মহিলাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। যাই হোক, মিঃ টেম্পলটন গ্যাসট্রিক আলসারের রুগী। মাঝে মাঝেই পেটে ভীষণ ব্যথা হয় বমি করেন। ডাক্তারের তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। তিনি তাকে একই ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে একদিন একটা ব্যাপার ঘটল। আমি দেখলাম সন্ধ্যার অন্ধকারে বাড়ির বাগানের নির্জন জায়গায় মিসেস টেম্পলটন আর ডাক্তার ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছেন। এরপর থেকে আমার মনে হয় ডাক্তার হয়ত ইচ্ছে করেই মিঃ টেম্পলটনকে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। আমার ধারণা, খাবারের সঙ্গে নিয়মিতভাবে অল্পমাত্রায় সেঁকোবিষ মেশানো হচ্ছে। যাতে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে তিনি এগিয়ে যান। একদিন শুনলাম মিঃ টেম্পলটন বললেন, এই চারজনেই আমাকে মেরে ফেলবে।
–চারজন বলতে কাদের বুঝিয়েছিলেন?
–ছেলে, স্ত্রী, স্ত্রীর এক বন্ধু, আর ডাক্তার।
–চক্রান্তকে ব্যর্থ করার জন্যে আপনি কিছু চেষ্টা করেছেন?
-হ্যাঁ, গতকাল রাতের স্যুপ খাবার পরেই মিঃ টেম্পলটনের পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। আমি সেই স্যুপের কিছু অংশ শিশিতে করে এনেছি। আপনি কি এটা পরীক্ষা করে দেখবেন?
পোয়ারো শিশিটাকে তার কেমিস্ট বন্ধুর কাছে পাঠালো। ঘন্টাখানেক পরে রিপোর্ট এল স্যুপের মধ্যে বিষ আছে। শুনে ভদ্রমহিলা চমকে উঠে বললেন, আমি বাবা পুলিশ-টুলিশের ঝামেলায় যেতে পারব না। তার চেয়ে বরং আপনি একবার ওখানে চলুন। যা ভালো বুঝবেন করবেন।
আমরা মিনিট কয়েকের মধ্যেই হার্টফোর্ডশায়ারে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে নিলাম। ইতিমধ্যে আমি লার্ক ইনস্টিটিউশনে ফোন করে জেনে নিলাম মিস পামার সত্যিই নার্স কিনা। তারা জানালো, হ্যাঁ, তিনি নার্স, তাঁকে হার্টফোর্ডশায়ারে পাঠানো হয়েছে।
পোয়ারো বলল, ওখানে গিয়ে আমরা আমাদের উদ্দেশ্য ভাড়ালেও পরিচয় গোপন করবো না। বলব যে, একটা চুরির ব্যাপারে, মিঃ টেম্পলটনের বাড়ির একজন ভৃত্য হয়ত জড়িত আছে, সেই সম্পর্কে খোঁজ নিতেই আমাদের এখানে আসা।
বলা বাহুল্য, আমরা ওখানে মিস পামারের সঙ্গে গেলাম না। আলাদাভাবে গেলাম। কলিংবেল টিপতে মিসেস টেম্পলটন দরজা খুলে দিলেন।
–আমার নাম এরকুল পোয়ারো, একটা তদন্তের ভার নিয়ে, আমি আর আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন হেস্টিংস মিঃ টেম্পলটনের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
একটু দাঁড়ান আপনারা, আমি আসছি, বলে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। আর এলেন না। এলেন ডাক্তার ট্রিভস। বললেন, আমি এ বাড়ির ডাক্তার। মিঃ টেম্পলটন ডাইনিং হলে খাচ্ছেন, আপনারা সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
ডাইনিং হলে গিয়ে মিঃ টেম্পলটনের ছেলের সঙ্গেও আলাপ হল। বয়স ৩০/৩২ সে বাপের সঙ্গে খেতে বসেছে।
পোয়ারো মিঃ টেম্পলটনের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। আমি শুনতে লাগলুম। ছেলে পাশে। হঠাৎ সে আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, সবাই আমাকে হাবা মনে করে। আমি সব জানি। বাবা মরে গেলে মা ঐ ডাক্তারকে বিয়ে করবে। তাই ওরা বাবাকে মারতে চায়।
বলেই সে মুখ ফিরিয়ে নিতান্ত নিরীহভাবে রেকাবির ওপরে একটুকরো রুটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল।
পোয়ারোর দৃষ্টি আমাদের দিকে। হঠাৎ সে পেটে হাত চেপে গোঙাতে লাগল। ডাক্তার এল। পোয়ারো গোঙাতে গোঙাতে বলল, পেটে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। মাঝে মাঝেই এরকম হয়। একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
ডাক্তার তখন আমাদের অন্য ঘরে পৌঁছে দিল। সে বেরিয়ে যেতেই পোয়ারো বিদ্যুৎবেগে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। বলল, পালাও, হেস্টিংস, পালাও।
তার মানে?
–ডিনার-টেবিলের ঐ ছেলেটাই ক্লড ডরেল। রুটির টুকরো নিয়ে সে রেকাবিতে ঘষছিল, সেটাই তার মুদ্রাদোষ। আমার বিশ্বাস, এ বাড়ির প্রত্যেকেই চতুরঙ্গের চর। এক্ষুনি আমাদের পালাতে হবে। চলো, ঐ জানলা দিয়ে বেরিয়ে, পাঁচিল টপকে পালাই।
তাই করলাম আমরা। দৌড়, দৌড়। স্টেশনে পৌঁছলাম। তারপর বাড়ি পৌঁছে ঘরে ঢুকতে যাবো। পোয়ারো আমাকে বাধা দিল। বলল, দাঁড়াও হেস্টিংস, কে জানে কোনো ফাঁদ পাতা আছে। পা টিপে টিপে আমরা আলো জ্বালালাম। না, কেউ নেই।
অনেকক্ষণ সিগারেট খাওয়ার জন্যে আমার প্রাণ আকুলি-বিকুলি করছিল। প্যাকেট বের করলাম। দেখলাম, বিছানার ওপর একটা দেশলাই পড়ে রয়েছে। দেশলাই তুলে নিয়ে বললাম, দ্যাখো পোয়ারো, তুমি নিজেও কিছু কম অগোছালো নও। দেশলাইটা বিছানায় ফেলে রেখেছ।
-বাজে কথা, পোয়ারো বলল। ততক্ষণে আমি কাঠি বার করেছি। পোয়ারো ঝাঁপিয়ে, দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমি তখন কাঠিটাকে বারুদের গায়ে ঘষে দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে একটা চোখ ধাঁধালো আলোর সঙ্গে বিস্ফোরণ। তারপরে আর কিছু মনে নেই আমার।
.
জ্ঞান হবার পর দেখি ডক্টর রিজওয়ে আমার মুখের কাছে ঝুঁকে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, পোয়ারো? পোয়ারো কেমন আছে?
ডক্টর রিজওয়ে ভগ্ন, বিকৃত গলায় জানালেন, দৈবক্রমে আপনি বেঁচে গেলেও, মঁসিয়ে পোয়ারো রক্ষা পাননি। তার আত্মা শান্তি লাভ করুক।
.
১৬.
মনে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে আমি সেদিন শিশুর মতো কেঁদেছিলাম। আর রোগশয্যাতে শুয়েই আমি কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম, পোয়ারোর মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি নেবই।
ডাক্তার রিজওয়ে আমাকে কোনো উৎসাহ না দিয়েই বললেন, আপনার বরং দক্ষিণ আমেরিকাতে ফিরে যাওয়াই ভালো।
স্বরাষ্ট্রসচিব মিঃ ক্রোথারও ঐ একই উপদেশ দিলেন। আরও বললেন, পোয়ারোর মৃত্যুর পরে ভল্ট থেকে তিনি খাতাখানাকে এনেছিলেন। তাঁর নির্দেশিত পথেই তারা এগোচ্ছেন।
কেউ আমার সাহায্য নিলেন না। আমি একাই আমার কাজে এগিয়ে যাবো।
চতুরঙ্গের বিরুদ্ধে এগোনোর একটা ছক করে ফেললাম। প্রথমে ক্লড ডরেলকে খুঁজে বার করতে হবে। বিভিন্ন কাগজে বিজ্ঞাপন দিলাম। ক্লড ডরেল সম্পর্কে কেউ জানলে আমার সঙ্গে যেন যোগাযোগ করেন।
মার্চ-এপ্রিল-মে গেল। কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আমার চোখে পড়ল যে, মিঃ ইনগ্লেস মার্সাই থেকে এস. এস. সাংহাই জাহাজে উঠে চীনে যাচ্ছিলেন। মাঝপথে একদিন রাত্রে তিনি হঠাৎ ডেক থেকে সমুদ্রে পড়ে যান। দুর্ঘটনাকালে সমুদ্র ছিল শান্ত। জাহাজ দুলছিল। তবু তিনি রেলিং টপকে কিভাবে পড়লেন তা জানা যায়নি।
এই স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম এটা চতুরঙ্গেরই কাজ।
একদিন রেস্তোরাঁয় খাচ্ছি। আমার সামনের ভদ্রলোক, আমার নুনের দরকার পড়াতে আমার প্লেটে চার জায়গায় নুন ঢেলে বললেন, মরতে আপনি ভয় পান না, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস?
আপনার এখন দক্ষিণ আমেরিকাতেই ফিরে যাওয়া উচিত। বলে তিনি দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলেন।
এর দশদিন পর। রাত নটা নাগাদ হাইড পার্কের পাশে হাঁটছি। হঠাৎ একটা গাড়ী আমার গা ঘেঁষে ব্রেক কষল। এক মহিলা মুখ বাড়িয়ে বললেন, ভয় পাবেন না ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, এদেশ ছেড়ে চলে যান।
মহিলাকে চিনতে পারলাম। কাউন্টেস রসাকোফ।
আমি বললাম, কেন? আমি থাকলে আপনার প্রভুদের অসুবিধা হচ্ছে?
-পাগল। চতুরঙ্গ ইচ্ছে করলেই আপনাকে পিষে মারতে পারে। কিন্তু তাদের আমিই বাধা দিয়েছি। মঁসিয়ে পোয়ারো আমার প্রতিপক্ষ হলেও, আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম। আপনি তার বন্ধু। তাই বলছি, আপনি ফিরে যান দক্ষিণ আমেরিকায়।
গাড়ীটা ছুটে বেরিয়ে গেল। গাড়ীর নম্বর প্লেটটা ঝুটো বলেই আমি নম্বর টুকলাম না।
ফ্ল্যাটে ফিরে এসে ভাবলাম, তাহলে কি পোয়ারোর মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিয়েই আমাকে ফিরে যেতে হবে?
টেলিফোনটা বেজে উঠল।
-হ্যালো, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বলছি।
অন্যপ্রান্ত থেকে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো :
সেন্ট গাইলস হাসপাতাল থেকে বলছি। খানিক আগে এক চীনাকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থা এখন সঙ্কটজনক। লোকটার পকেট থেকে একটা চিরকুট পাওয়া গেছে, তাতে আপনার নাম, ঠিকানা লেখা ছিল। আপনি এখানে আসবেন?
–যাচ্ছি।
আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম অ্যাকসিডেন্ট-ওয়ার্ডে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। পাশে ডাক্তার, নার্স।
ডাক্তার বললেন, বাঁচবার কোনো সম্ভাবনা নেই। আপনি একে চেনেন নাকি?
–না। কখনও একে দেখিনি।
-আশ্চর্য। পকেটে আপনার নাম-ঠিকানা কোত্থেকে এলো? ওর পকেটে অন্যান্য কাগজপত্তরও কিছু পাওয়া গেছে, তার থেকে জানা গেছে মিঃ ইনগ্লেস নামে এক ভদ্রলোকের কাছে ও চাকরী করত।
তখন আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমি হেস্টিংস…হেস্টিংস…আমাকে কিছু বলবে?
-লাগো…কারোজা…দুটি কথা বলে তার ঠোঁট থেমে গেল। মারা গেল।
লার্গো…কারোজা…এই শব্দ দুটির অর্থ কি হতে পারে?
ফ্ল্যাটে ফিরে এসে সলিসিটরের চিঠি পেলাম।
প্রিয় মহাশয়,
আমাদের পরলোকগত মক্কেল মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো তাহার জীবদ্দশায় আমাদের যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তদানুসারে তাহার একখানি পত্র এইসঙ্গে আপনার কাছে পাঠাইতেছি। মৃত্যুর সপ্তাহকাল পূর্বে এই পত্রখানি আমাদের কাছে জমা দিয়া তিনি এইরূপ নির্দেশ দেন যে, তাহার মৃত্যু ঘটিলে যেন পত্রখানি আপনার কাছে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। আপনার বিশ্বস্ত….
এরই সঙ্গে ছিল আমাকে লেখা পোয়ারোর একখানা চিঠিঃ
প্রিয় হেস্টিংস, এই চিঠি যখন তোমার হাতে পৌঁছবে, তখন আমি মৃত। আমার জন্যে দুঃখ না করে যদি আমার নির্দেশ পালন করো, তাহলেই আমার আত্মা শান্তি পাবে। আমার নির্দেশ এই চিঠি পেয়েই তুমি দক্ষিণ আমেরিকায় ফিরে যাবে। আমি জানি তুমি আমার নির্দেশ অমান্য করবে না। আমি আমার জীবদ্দশায় যে প্ল্যান ছকেছি, তুমি ইংল্যান্ডে থাকলে সেই কাজ করা শক্ত হবে। তুমি বুদ্ধিমান। সুতরাং আশা করি এর চেয়ে বেশি কিছু তোমাকে বলার দরকার নেই। পরলোক থেকে আমি শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
ইতি
এরকুল
বারবার পড়লাম চিঠিখানা। পোয়ারোর প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে আসছিল। তার কোনো কাজেই খুঁত নেই। মৃত্যুর আগে আমার কথা ভেবে নিজের হাতে সে জানিয়ে গেছে, আমি যেন ফিরে যাই। তার নির্দেশ অমান্য করতে আমি পারব না।
অ্যানিসোনিয়া জাহাজে উঠে আমি দক্ষিণ আমেরিকার দিকে রওনা হলাম। জাহাজ ছাড়ার আগে একজন স্টুয়ার্ড এসে আমার হাতে একটা চিরকূট দিল।
তাতে লেখা : ইংল্যাণ্ড থেকে বিদায় নিয়ে আপনি সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন ৪।
শান্ত সমুদ্র, কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মাঝরাত্রিতে জাহাজেরই এক অফিসারের ধাক্কায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উত্তেজিত গলায় তিনি বলছেন, নৌ-বিভাগ থেকে বিশেষ নির্দেশ পাঠানো হয়েছে আমাদের। জাহাজ থেকে এইখানেই আপনাকে আমরা নামিয়ে দেব।
–এই মাঝসমুদ্রে?
–সমুদ্রে নয়, এই ডেস্ট্রয়ারে। নৌবিভাগের আদেশ আমরা অমান্য করতে পারি না।
আমাকে একটা ডেস্ট্রয়ারে নিয়ে যাওয়া হল। খানিকক্ষণের মধ্যেই আমাকে বেলজিয়ামের উপকূলে নামিয়ে দেওয়া হল। সেখানে একজন মোটরগাড়ীর ড্রাইভারকে, ডেস্ট্রয়ার ক্যাপ্টেন বলে দিল, আমাকে যেন এখানকার স্পা-শহরের কাছাকাছি একটা বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝছিলাম না। গাড়ী ছুটছে। বিদ্যুৎচমকের মতই হঠাৎ আমার মনে পড়ল, এরকুলের ভাই আকিলের কথা। এরা কি আমার আকিল পোয়ারোর কাছে নিয়ে যাচ্ছে? কিন্তু কেন? ছোট্ট একটা বাড়ীর সামনে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হল। মাঝবয়সী
একজন ভৃত্য এসে আমাকে জানাল, বাড়ীর মালিক আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
আমি সেই ভৃত্যের সঙ্গে গেলাম। একটা ঘরের পর্দা সরিয়ে আমি ভিতরে ঢুকলাম। অসম্ভব…সম্পূর্ণ অসম্ভব। ও, কে! আমার দিকে দুই হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসছে?
-”পোয়ারো!”
-হ্যাঁ, হেস্টিংস, আমি পোয়ারো, ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, আমি মারা যাইনি। এরকুলকে মারা অত সহজ নাকি?
–কিন্তু আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। এরকুল হাসল, বলল, শত্রুর চোখে ধুলো দিতেই এই মিথ্যে রটনা। ডাঃ রিজওয়ে আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। সেদিন আমি আহত হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু আমার পরামর্শানুযায়ী ডাঃ রিজওয়ে রটিয়ে দেন আমি মারা গেছি। ফাঁকা একটা কফিনকে কবর দেওয়া হয়। তোমাকে কিছু না জানানোও আমার প্ল্যানের অঙ্গ। কিছু মনে কোর না ভাই। তোমার শোকার্ত অবস্থা দেখে চতুরঙ্গের লোকেদের আর কোনো সন্দেহই রইল না। নৌ-বিভাগের সঙ্গে ব্যবস্থা করে আমি তোমাকে গোপনে আনিয়েছি। এইবারে শুরু হবে আমাদের আসল আক্রমণাত্মক খেলা। এইবারে আমরা চূড়ান্ত আঘাত হানবো।
.
১৭.
বেলজিয়ামের ঐ নিভৃত অঞ্চল থেকেও পোয়ারো তার সমস্ত যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ রেখেছিল।
বুঝতেই পারছিলাম জালটা এবার বেশ ভালোভাবেই বিস্তৃত করা হচ্ছে। রোজই ফ্রান্স, ইটালি, ইংল্যাণ্ড, চীন দেশ থেকে একটা না একটা প্যাকেট তার কাছে এসে পৌঁছায়। নিচুগলায় কি সব কথাবার্তা হয়। পোয়ারো কাউকে কাউকে টাকা বা অন্যকিছু দেয়। আবার তারা নিঃশব্দে বিদায় নেয়।
কথায় কথায় পোয়ারো একদিন বলল, বুঝলে হেস্টিংস, চারজনে যেই এক জায়গায় এসে যাবে, অমনি আমি তাদের আঘাত হানব। ধৈর্য হারিয়ে বিপদের দিকে ছুটে গেলে লাভ নেই, মিঃ ইনগ্লেসই তার জীবন দিয়ে সে কথা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
ইনগ্লেস প্রসঙ্গে ঐ চীনা ভৃত্যের কথা আমার মনে পড়ল। আমি এরকুলকে সমস্ত জানিয়ে বললাম, মরবার আগে দুটো শব্দ সে উচ্চারণ করেছিল, লাগো…কারোজা। পোয়ারো আমার কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনল।
দিন কয়েক পরের কথা। আমাদের বাড়ীতে এলেন ক্যাপ্টেন হার্ভে। পোয়ারো আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলো।
ক্যাপ্টেন বলল, মঁসিয়ে পোয়ারো, চীনে একটা গুরুতর হাঙ্গামা বাঁধায় চীনের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সপ্তাহ খানেক আগে আবে রাইল্যাণ্ড ইংল্যাণ্ডে এসেছিলো। গতকাল তিনি ইংল্যাণ্ড ছেড়েছেন।
–ছেড়ে ইতালির দিকে গেছেন, পোয়ারো বলল।
–হ্যাঁ।
–আর মাদাম অলিভিয়ের?
তিনিও ফ্রান্স ছেড়েছেন গতকাল
–তিনিও ইতালীর দিকে গেছেন তাই না?
–হ্যাঁ। ব্যাপারটা আপনি আঁচ করলেন কি করে?
–আঁচ করতে পারতুম না; যদি না আমার বন্ধু হেস্টিংস আমাকে সাহায্য করত। এরকুলের কথা আমি ভাবতে লাগলাম, আমি আবার তাকে কী সাহায্য করলাম।
পোয়ারো বলল, সবাই তাহলে স্বাস্থ্যনিবাসের দিকে যাচ্ছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ, সেখানে নজরও রাখা হয়েছে। ইতালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড সরকার এ ব্যাপারে একযোগে কাজ করছেন। আপনাকে সাহায্য করতে তারা সর্বতোভাবে রাজী।
–ভাবনা তো মঁসিয়ে দেজার্দুকে নিয়ে, তাহলে তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন?
–না করে উপায় কী! আপনি যেসব প্রমাণ দিয়েছেন, তা খণ্ডন করা সম্ভব নয়।
-তাহলে সময় নষ্ট না করে আমরা আজই ইতালির পথে রওনা দেব। হেস্টিংস, তুমি বরং বিপদের মধ্যে না গিয়ে এখানেই থাকো।
-অসম্ভব, যত বিপদই আসুক আমি তোমার পাশেই থাকতে চাই, আমি বললাম।
ট্রেন ছাড়ার পর এরকুলকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, এরকুল আমি তোমাকে কিভাবে সাহায্য করলাম ঠিক বুঝলাম নাতো।
-লাগো কারোজা–এই কথাটা তুমি সেদিন জুগিয়ে আমাকে সাহায্য করেছ। ওটা লাগো কারোজা নয়, লাগো-ডি-কারোজা, তুমি শুনতে ভুল করেছিলে। ওটা একটা ইউরোপের সুন্দর স্বাস্থ্যনিবাস। যতদূর মনে হয় ওটাই চতুরঙ্গের সদর দপ্তর। সেখানে পাহাড়ের মধ্যে তাদের গোপন ল্যাবরেটারী, সুড়ঙ্গ, ঘরবাড়ী, অস্ত্রাগার সব আছে। এই গোপন ঘাঁটি থেকে এক-একটা বেতার নির্দেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক-একটা বিপর্যয় ঘটবে। শাসন-ব্যবস্থা, যানবাহন-ব্যবস্থা, যোগাযোগ সব নষ্ট হবে। দুর্ভিক্ষ মহামারী, রক্তস্রোত ঘটবে।
-আর?
–আর চতুরঙ্গের সাঙ্গোপাঙ্গোরা প্রতিষ্ঠা করবে এক ভয়ঙ্কর স্বৈরতন্ত্র।
.
লাগো-ডি-কারোজায় পৌঁছালাম আমরা। চারিদিকে পাহাড়, সবুজঘেরা সুন্দর জায়গা।
ক্যাপ্টেন হার্ভে পোয়ারোকে আঙুল নির্দেশ করে দেখাল, বলল, ঐখানে, ঐ যে ঘোরালো পথটা রয়েছে। ভীষণ জটিল পথ, পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে।
সেদিন রাত্রে ডাইনিং হলে আমরা খেতে বসেছি। হঠাৎ পোয়ারো বলল, সামনের লোকটাকে একবার দে, দোহারা চেহারা, তলপোয়ারো মুখ নিচু কত
দেখলাম, মাঝবয়সী, দোহারা চেহারা, চোখে চশমা পরা একজন লোক বসে আছে। আমাদের দিকে তার চোখ পড়তেই চমকে উঠল। পোয়ারো মুখ নিচু করে বলল, চার নম্বর। রুটির টুকরো নিয়ে খেলা করার মুদ্রাদোষের কথা মনে আছে তো হেস্টিংস। আমি ভেবেছিলাম, শত্রু যখন আমার সম্পর্কে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ দেখা দেব। যাতে ওরা আমাকে মারবার জন্যে উঠে পড়ে লাগে। কিন্তু এবার ওদের পাল্টা আঘাতের জন্য তৈরি থাকতে হবে।
–কিন্তু সত্যিই কি ও আঘাত হানবে নাকি?
নিশ্চয়ই। পৃথিবীতে একমাত্র আমাকেই ও ভয় করত। আমার মৃত্যু সংবাদে ওরা বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছিল। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে ওরা সকলে এখানে এসে জমায়েত হয়েছে। ওদের প্ল্যান যাতে ভেস্তে না যায়, তারজন্যে আমার উপর এবার চূড়ান্ত আঘাত হানতে হবে।
লোকটা উঠে দাঁড়াল, বেরিয়ে গেল। পোয়ারো বলল, তাড়াহুড়োর দরকার নেই। কফিটা শেষ কর। আমি একবার ঘর থেকে ঘুরে আসি। এসে লবিতে গিয়ে বসবো।
আমরা লবিতে বসলাম। খানিক বাদে সেই লোকটা আমাদের সামনে এসে বসল আর পোয়ারোর সঙ্গে গল্প জমিয়ে বসল। পোয়ারো পকেট থেকে সিগারেট মুখে ধরতেই লোকটা লাইটার বার করে বলল, আসুন। বলেই সে তার লাইটার জ্বালল। তারপরেই হোটেলের সমস্ত আলো হঠাৎ নিভে গেল। কে যেন আমার মুখে একটা রুমাল চেপে ধরল। তীব্র ঝাঝালো গন্ধে আমি জ্ঞান হারালাম।
.
১৮.
বড়জোর মিনিট খানেক বাদেই জ্ঞান ফিরে আসতে অনুভব করলাম, আমার হাত-পা বাঁধা, মুখে কাপড় ঠাসা। অন্ধকার। অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে বুঝলাম আমাকে আর আমার সামনে একজনকে চ্যাংদোলা করে বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পোয়ারোর সিগারেডে বিষাক্ত সূচ ছিল। কিন্তু সেই সূঁচ নিক্ষেপ করার আগেই হোটেলের মেন সুইচের কাছেই কোনো লোক সুইচটা অফ করে দেয়। আমার মনে পড়ল, ডাইনিং হল থেকে চারনম্বর একবার বেরিয়েছিল। তখনই সে এই ব্যবস্থা করে গেছে। ক্ষোভে, অপমানে আমার চোখ ফেটে জল আসছিল।
জঙ্গলে পাহাড়িয়া রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের বয়ে নিয়ে ওপরদিকে উঠছিল তারা। একটার পর একটা বাঁক পার হচ্ছিল তারা। সামনে একটা বড় পাথর। সেই পাথরের কাছে গিয়ে, মনে হল, একজন যেন বোতাম টিপল। পাথরটা তৎক্ষণাৎ সরে গিয়ে একটা সুড়ঙ্গ পথ দেখা গেল। বাহকরা সেই সুড়ঙ্গপথে আমাদের বয়ে নিয়ে নামতে লাগল।
হঠাৎ অন্ধকার চিরে ইলেকট্রিকের আলোয় আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, এটাই তাহলে চতুরঙ্গের সদর ঘাঁটি।
বাহকরা আমাদের নামাল। চারনম্বর লোকটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলল, আসুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমাদের গুপ্তঘাঁটিতে আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাই।
এবার বাহকরা আমাদের নিয়ে মস্ত একটা ঘরে নিয়ে গেল। পিছনে চারটে চেয়ার। সামনে বড় টেবিল। প্রথম চেয়ারটা শূন্য, দ্বিতীয়, তৃতীয় চেয়ারে বসে আছেন যথাক্রমে রাইল্যাণ্ড, মাদাম অলিভিয়ের আর চতুর্থ চেয়ারে গিয়ে বসল চার-নম্বর।
চতুরঙ্গকে এত কাছ থেকে কখনও দেখিনি। ভয়ে আমার বুক কাঁপছিল।
গম্ভীর গলায় রাইল্যাণ্ড বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আজ আপনাকে এখানে দেখতে পাবো বলে সত্যিই আশা করিনি। আপনি যে মারা গেছিলেন, এখন দেখছি তা সত্যি নয়। এবারে আর আপনার রক্ষে নেই।
পোয়ারো বলল, ধন্যবাদ।
বিস্মিত হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকালাম। এত গলা ভাঙা আওয়াজ কেন? ঠান্ডা লেগেছে? শুধু কণ্ঠস্বরই নয়, বাচনভঙ্গিও তার পাল্টে গেছে।
আমার ভাবনায় ছেদ টেনে ওদিককার পর্দা সরিয়ে এসে দাঁড়ালেন, কাউন্টেস রসাকোফ। পোয়ারোর দিকে চোখ পড়তেই সে ফোঁস করে উঠল, একী, আমি কি ভূত দেখছি। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি মারা যাননি?
-না, মাদাম, পোয়ারো এত সহজে মরে না।
পোয়ারোর কণ্ঠস্বর কাউন্টেসের সন্দেহকে আরো গাঢ় করল। তার চোখ দুটো জ্বলে উঠল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমারও অবচেতন মনে জেগে ওঠা সন্দেহটা হঠাৎ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।
আমার মনে হল, এ পোয়ারো হতে পারে না। এরা তাহলে এরকুলের যমজ ভাই আকিলকে ধরে এনেছে। কিন্তু আকিল কিভাবে এল? তাহলে কি ডাইনিং হল থেকে পোয়ারো যখন একবার ঘরে গিয়েছিল, তারপর তার ভাই আকিলকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো?
হয়তো তাই হবে। হঠাৎই কাউন্টেস রসাকোফ চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কাকে ধরে এনেছেন আপনারা? ইনি তো এরকুল পোয়ারো নন। বলেই তিনি পোয়ারোর মুখ থেকে মাফলারটা সরিয়ে গোঁফটায় টান মারলেন। গোঁফটা খসে পড়ল।
–দেখুন, এ লোকটা এরকুল নয়, রসাকোফ বললেন, তখনই আমার মুখ ফস্কে বেরিয়ে এল, আমি জানি ইনি আকিল পোয়ারো। এরকুলের যমজ ভাই।
অসম্ভব, রাইল্যান্ড চেঁচিয়ে উঠলেন।
শান্ত গলায় আকিল পোয়ারো বললেন, না মঁসিয়ে, এরকুল যা চেয়েছিলো ঠিক তাই হয়েছে। তার বুদ্ধির সঙ্গে আপনারা পেরে ওঠেননি। সে আপনাদের প্রতিটা চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই স্বাস্থ্যনিবাসে গত একমাসে যত লোক এসেছে তারা সবাই পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা। এখানে যে হোটেল আছে, তার প্রতিটি কর্মচারীই ইতালিয়ান, ফরাসী আর নয়তো ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচর বিভাগের লোক। এরকুলের নির্দেশ তারা এই পাহাড়টাকে ঘিরে রেখেছে।
মাদাম এবার মুখ খুললেন, বললেন, আমরা পাহাড়ের কোনো গোলকধাঁধায় লুকিয়ে আছি, তা তারা জানবে কি করে? আমাদের যা বিস্তর রসদ আছে, তাতে আমরা বছরের পর বছর এখানে কাটিয়ে দিতে পারব।
–সেটাও পারবেন না মাদাম। এরকুলের ঘর থেকে বেরোবার সময় আমি জুতোর তলায় বেশ খানিকটা তাৰ্পিন তেল মাখিয়ে এনেছিলাম। হোটেল থেকে শুরু করে এই গুপ্ত ঘাঁটি পর্যন্ত সারা পথে উগ্র তেলের গন্ধে পুলিশ কুকুরের পৌঁছতে দেরি হবে না।
মাদামের চোখ ঝলসে উঠল। চাপা গলায় বললেন, ডিনামাইট দিয়ে এই পাহাড়টাকে উড়িয়ে দেব আমরা। নিজেরা মরব, তার সঙ্গে তোমাদেরও মারব।
এরপর দূর থেকে একটা কোলাহল ভেসে এল। একটা লোক দৌড়ে ঘরে ঢুকে রাইল্যাণ্ডকে কি যেন বলল। রাইল্যাণ্ড, অলিভিয়ের বেরিয়ে গেলেন। চারনম্বর রসাঁকোফের হাতে একটা পিস্তল দিয়ে বলল, পুলিশের লোক জমায়েত হচ্ছে। আমাদের ঘাঁটিটা উড়িয়ে দিতে হবে। আপনি পাহারায় থাকুন। আমি ল্যাবরেটরীতে যাচ্ছি। চারনম্বর চলে গেল।
কী মনে করে কাউন্টেস আকিলের মুখখানাকে বেশ ভালো করে দেখে হেসে উঠে বললেন, মঁসিয়ে আকিল পোয়ারো, আপনার বুদ্ধির সত্যিই তুলনা হয় না।
আকিল বুদ্ধির প্রসঙ্গটাকে এড়িয়ে গিয়ে বললেন, মাদাম সময় বিশেষ নেই। আসল কথাটা সেরে নেওয়া যাক, বলুন আপনার দাম কত?
দাম? আমার আবার দাম কি?
-মাদাম এখন ছলনার সময় নয়। কী দাম পেলে আপনি এই গুপ্তঘাঁটি থেকে আমাদের বাইরে নিয়ে যাবেন?
টাকা দিয়ে আমাকে কিনতে চান? না মঁসিয়ে আমার টাকার দরকার নেই।
আপনার যেকোন ইচ্ছা পূরণ করার জন্যে আমি প্রস্তুত। বলুন মাদাম বলুন, তাড়াতাড়ি।
কী চাই আমি? হাসি থামিয়ে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে কাউন্টেস বললেন, যাই চাই তা কি আপনি দিতে পারবেন?
-পারব মাদাম, বলুন।
-আপনি কি আমার শত্রুদের শাস্তি দিতে পারবেন? আপনি কি আমার বিগত যৌবনকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন? আপনি কি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন? হো হো করে আবার হেসে উঠলেন রসাকোফ।
আকিল কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললেন, আপনার তিনটি ইচ্ছার একটি আমি পূর্ণ করব বলুন কোনো ইচ্ছা আপনি পূর্ণ করতে চান?
–আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন?
–দেব। আপনি যদি আমাদের এখান থেকে বের করে নিয়ে যান, তাহলে আপনার ছেলেকে আমি ফিরিয়ে এনে দেব।
-মঁসিয়ে আমার ছেলে বেঁচে নেই, সে মৃত, মরা ছেলেকে বাঁচাতে পারবেন?
–ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, আপনার ছেলেকে আমি বাঁচিয়ে তুলব।
কাউন্টেস পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
আকিল তাঁর ব্যাগ থেকে একটা ফটো বের করে নিয়ে রসাকোফকে বললেন, মাদাম, ফটোটা একবার দেখুন। আমার ব্যাগটা বের করুন।
কাউন্টেস মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকিলের কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ব্যাগ বের করে আনলেন। তার ভেতর থেকে সত্যি সত্যিই একটা ফটো বার করে দেখলেন।
ফটোটা দেখার পর চেঁচিয়ে বলে উঠলেন রসাকোফ, কোথায়…কোথায় পেলেন এই ফটো?
–পরে বলব, আগে বাইরে নিয়ে চলুন।
কাউন্টেস দ্রুত হাতে আমাদের বাঁধন খুলে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললেন। সুড়ঙ্গপথ এখন পুলিশের ভয়ে অন্ধকার। কতক্ষণ হেঁটেছি তা মনে নেই। ঠিক এমনই সময় আমাদের চোখে পড়ল পুলিশের টর্চের আলো। তারা সুড়ঙ্গের প্রবেশ পথটা খুঁজে পেয়েছে। তারা আমাদের শত্রু ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
— আকিল বললেন, আমরা বন্ধু। বেরিয়ে পড়ুন। এখন ডিনামাইট দিয়ে ওরা ঘাঁটিটাকে উড়িয়ে দেবে! চলুন…শিগগির…।
বলতে না বলতেই প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণে পায়ে নিচের মাটিটা দুলে উঠল। আমি মূৰ্ছিত হয়ে পড়লাম।
জ্ঞান হবার পর দেখি হোটেলের ঘরে শুয়ে আছি। পাশে এরকুল।
এরকুল বলল, এক মিনিটের জন্যে আমরা বেঁচে গেছি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কিন্তু আকিল পোয়ারো? তিনি কোথায়?
হো-হো করে হেসে উঠল এরকুল। বলল, কল্পনায় তার জন্ম হয়েছিল, কল্পনাতেই আবার মিলিয়ে গেছে।
–তার মানে?
-মানে আর কিছুই নয়। অমন ভাই আমার কখনও ছিল না। আসলে কাল আমি ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে আমার ঘরে গিয়ে গোঁফ কামিয়ে ফেলে একজোড়া নকল গোফ লাগাই। ঔষুধ লাগিয়ে চোখের রঙও পাল্টে ফেলি এবং আর কিছু ছোটখাটো রদবদল ঘটিয়ে মুখের নীচে মাফলার জড়িয়ে আমি লবিতে গিয়ে বসি। কাউন্টেসের চোখে পড়েছিল পরিবর্তনগুলো। তার ওপর ইচ্ছে করে ধরাগলায় কথা বলছিলুম। ঘাঁটিতে রসাকোফ যখন বলেন এ এরকুল নয়, তখন তুমিও বলে উঠলে যে, আমি আকিল পোয়ারো। আসলে তুমিও জানতে না আকিল বলে সত্যিই কেউ নেই। তাতে আমার সুবিধাই হলো। তুমি এমন জোর দিয়ে কথাটা বললে যে তাদের মনে কোনো সন্দেহই জাগল না।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমি বললাম, কিন্তু কাউন্টেস তো তোমাকে বহুদিন ধরে জানেন, তিনিও তো তোমার চালাকিটা ধরতে পারেননি।
মৃদু হেসে পোয়ারো বলল, প্রথমে পারেনি কিন্তু একটু বাদেই পেরেছিল। আবে রাইল্যাণ্ড, মাদাম অলিভিয়ের, চারনম্বর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে সে আমার আপাদ-মস্তক দেখে কী বলেছিলেন তোমার মনে আছে?
–আছে।
–তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, মঁসিয়ে আকিল পোয়ারো, আপনার বুদ্ধির সত্যিই কোনো তুলনা হয় না।
–তা না হয় হলো, কিন্তু মৃত ছেলেকে বাঁচিয়ে তোলা–এসব উদ্ভট কথার অর্থ কি?
-ঐ তো মজা, পোয়ারো বলল, কাউন্টেসের ছেলে মোটেই মারা যায়নি। ছেলেটা আমার এক বন্ধুর কাছেই থাকে। আর দু-একদিনের মধ্যেই তিনি তাকে ফিরে পাবেন।
–অর্থাৎ?
বছর কয়েক আগে কাউন্টেস রাশিয়ায় ছিলেন, সেইসময় ছেলেটি হারিয়ে যায়। রটে গিয়েছিল যে, কাউন্টেসের শত্রুরা তার ছেলেটিকে হত্যা করেছে। কাউন্টেসও সেটা বিশ্বাস করেছিল।
–এতদিন বাদে তুমি কি করে তার সন্ধান পেলে?
–সহজে পাইনি, পোয়ারো বলল, তার জন্যে অনেক কষ্টে আমার শত্রুদের অতীত ইতিহাস খুঁজে বার করতে হয়েছে। এরজন্যে আমি তোক লাগিয়েছিলুম। কাউন্টেসের ছেলেটিকে আসলে তারই এক শত্রু আঁটকে রেখেছে। প্রচুর টাকা খরচ করে, এক রাশিয়ানকে মোটা অঙ্কের চেক দিয়ে তাকে আমি উদ্ধার করার ব্যবস্থা করেছিলুম। তারপর ছেলেটাকে উদ্ধার করে এনে বেলজিয়ামে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে রাখবার ব্যবস্থা করি। তার একটা ফটো আমি তুলে রেখেছিলাম। জানতাম কখনও না কখনও কাউন্টেসের কাছে আমাকে সাহায্য নিতে হবে, তাই ফটোটা সবসময় সঙ্গে রাখতুম।
–তোমার তুলনা হয় না এরকুল, আমি বিভোরের মত বলে উঠলাম। একটু লজ্জিত হলো পোয়ারো।
বলল, না না, আমি কি আর এমন করেছি। এখন আমার কাউন্টেসের ওপর কোনো বিদ্বেষ নেই, আমার যুদ্ধ চতুরঙ্গের সঙ্গে। কাউন্টেস সেদিন ঐ বিস্ফোরণে পড়লে আমি সত্যিই দুঃখ পেতাম।
-কিন্তু পোয়ারো চতুরঙ্গের কি হলো বলো তো?
–বিস্ফোরণে সবাই মারা গেছে।
–আর লি-চ্যাং-ইয়েন? সে তো ঐ গুপ্তঘাঁটির মধ্যে ছিল না। তার কি হলো?
পোয়ারো রহস্যের হাসি হাসল।
সে বলল, রক্ষা সেও পায়নি। সে ছিল চীনদেশে। এই একটু আগে রেডিওতে শুনলাম, সেইখানে সে আত্মহত্যা করেছে। চতুরঙ্গের চক্রান্তের ব্যর্থতার খবরে ভেঙে পড়ে আত্মহত্যা করেছে।
একটুক্ষণ চুপ করে রইল পোয়ারো। বলল, কি যে করবো এখন তাই ভাবছি।
-সেকি? তোমার আবার কাজের অভাব হয় নাকি? –না না, দীর্ঘশ্বাস ফলে পোয়ারো বলল, এরকুল পোয়ারোর কখনও কাজের অভাব হয় না। কিন্তু চতুরঙ্গের কেসটাই ছিল আমার জীবনের সবচাইতে বড় রহস্যভেদ। এর পরে অন্য আর সব রহস্যই বড় ফিকে লাগবে।