মাথা ঝাঁকিয়ে দড়ির জন্যে রওনা হল রবিন। দুলে উঠল বোট, ঘ্যাঁস্স্ করে আওয়াজ হল নিচে, ঝটকা দিয়ে আগে বাড়ল খানিকটা।
ওদিক দিয়ে নয়! হুঁশিয়ার করল মুসা। পেছন দিয়ে যাও, রেলিঙের ওপর দিয়ে বেয়ে নামো। আমরা আরও পেছনে সরে ভার চাপাচ্ছি।
আরেকবার মাথা ঝাঁকিয়ে রেলিঙে উঠে পড়ল রবিন। রেলিঙ ধরে ঝুলে পড়ল। তারপর আলগোছে ছেড়ে দিল হাত। খুব আস্তেই পড়ল নিচের ডেকে। দড়ির বাণ্ডিল তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল ওপরে।
দড়ি খুলে একমাথায় একটা ফাঁস বানিয়ে ফেলল মুসা। শরীর যথাসম্ভব কম নেড়ে, কম ঝাঁকিয়ে ফাঁসটা ছুঁড়ে মারল একটা গাছ সই করে। গাছের তিন ফুট দূরে পড়ল ফাঁসটা।
টেনে এনে আবার চেষ্টা করল সে। ভাঙা গাছের গোড়ায় পড়ল ফাঁসটা। ভীষণ দুলে উঠল বোট। টাল সামলাতে না পেরে পড়েই যাচ্ছিল কিশোর, কোনমতে রেলিঙ ধরে সামলাল। পানি যেদিক থেকে আসছে সেদিকে চোখ পড়তেই রক্ত সরে গেল মুখ থেকে। তোতলাতে শুরু করল, মু-মুসা, গাছ। এসে বাড়ি মারলে গেছি…।
ভেসে আসা বিশাল গুড়িটার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল মুসা, আস্তে মাথা ঝাঁকিয়ে খুলে ফেলতে লাগল বাণ্ডিলের বাকি দড়ি। তারপর সাবধানে নিশানা করে ছুঁড়ে মারল আবার ফাঁস। এইবার কাজ হল, ভাঙা গাছের কাণ্ড গলে আটকে গেল ফাঁস। দড়িটা টান টান করে এদিকের মাথা শক্ত করে বেঁধে ফেলল রেলিঙে। বলল, রবিন, তুমি আগে যাও।
সরে গিয়ে ওপরে হাত তুলে দড়িটা ধরল রবিন। ঝুলে ঝুলে এগোল। খুব তাড়াতাড়িই তীরের মাটিতে গিয়ে দাঁড়াল সে। তাড়াতাড়ি ফাঁসটা টেনে নামিয়ে দিল গাছের গোড়ার দিকে। যাতে আরও শক্ত হয়ে আটকে থাকে।
কিশোর, এবার তুমি যাও,মুসা বলল।
দ্বিধা করল কিশোর। দেখল, ছুটে আসছে গাছের গুঁড়িটা। একবার ঢোক গিলে, দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল। ভাবছে, সময়মত পেরোতে পারবে তো? পারল। কিছুক্ষণ পরেই রবিনের পাশে এসে দাঁড়াল সে।
দুজনের ভার সরে যাওয়ায় অনেক হালকা হয়ে গেল বোটের পেছনটা। আটকা পড়া কুটোর মত দুলতে শুরু করল, এপাশ ওপাশ নড়ছে গলুই। গাছের গুঁড়িটাও প্রায় এসে গেছে। দেরি করল না আর মুসা। দড়ি ধরে ঝুলে পড়ে সড়সড় করে নেমে চলে এল অনেকখানি। তার পা-ও মাটি ছুঁল, গুড়িটাও এসে ধাক্কা মারল বোটটাকে।
ছেলেদের ভার সরে যাওয়ায় এমনিতেই সরি সরি করছিল বোট, ধাক্কা খেয়ে আর আটকে থাকতে পারল না। সড়াৎ করে পেরিয়ে গেল বাধের বাকি অংশ, হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে গেল দড়ি।
পাথরে বাড়ি খেয়ে বোট ভাঙার মড়মড় শব্দ কানে এল ছেলেদের, কাঁটা দিল গায়ে।
হউফ, করে মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ল রবিন।
এতক্ষণে রাগ দেখা দিল মুসার মুখে। শুঁটকি! মুঠো শক্ত হয়ে গেল তার। দাঁড়া, আগে ধরে নিই…।
শুঁটকি, ঘোর ভাঙল যেন কিশোরের, আমাদের আগে চলে গেছে। সে বলেছে, সিঁড়িটা কোথায় জানে। এস।
উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আবার গোয়েন্দাপ্রধানের চোখের তারা। বিপদ কেটে গেছে, তার মগজও চালু হয়ে গেছে পুরোদমে।
আশেপাশেই কোথাও আছে সিঁড়িটা, বলল সে। আলাদা আলাদা হয়ে খুঁজব আমরা। ওয়াকিটকিতে যোগাযোগ রাখব। কারও চোখে কোন সিঁড়ি পড়লেই অন্যকে জানাব।
ওয়াইনেক ক্রিকের ধার ধরে খুঁজতে শুরু করল ওরা। অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে খুঁজল, কিছুই চোখে পড়ল না।
ভুল হয়েছে কোথাও, ওয়াকিটকিতে বলল কিশোর। কি জানি! জবাব দিল মুসা।
কিশোর, রবিন বলল, প্রথম ধাঁধাটার সঠিক সমাধান হয়েছে তো? তুমি কি শিওর, বিলাবং মানে জলাশয়?
নিশ্চয়…, থেমে গেল কিশোর। দ্বিধায় পড়েছে। ডিকশনারিতে অবশ্য দেখিনি। অন্য কোন মানে থাকতেও পারে। কাছাকাছি টেলিফোন কোথায় বল তো?
ডেপুটির অফিসে, জবাব দিল মুসা। যাব নাকি? সাইকেলের কাছাকাছি রয়েছি আমি।
যাও। লাইব্রেরিয়ানকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর, কি কি মানে হয়। কুইক।
মুসা গেছে অনেকক্ষণ হয়েছে। পশ্চিম দিগন্তে নেমে যাচ্ছে সূর্য। অন্ধকার হয়ে যাবে শিগগিরই, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে কিশোর। ভাবছে, মুসাকে খুঁজতে যাবে কিনা,
এই সময় হঠাৎ ওয়াকিটকিতে শোনা গেল তার কণ্ঠ।
কিশোর? রবিন? আছ ওখানে?
আছি, সেকেণ্ড, জবাব দিল কিশোর। কি জানলে?
অনেক মানেই হয় বিলাবঙের। মূল জলধারা থেকে বেরোনো উপ-জলধারা, যেটা আর কোন জলধারার সঙ্গে মিশতে পারে না, কোথাও গিয়ে বুজে কিংবা মরে যায়, তাকে বলে বিলাবং।
নেই ওরকম, রবিন বলল। এখানে দেখিনি।
তাহলে আরেক রকমের কথা বলি। শুধু বর্ষাকালে পানি বহন করে এরকম জলধারাকেও বিলাবং বলে।
হ্যাঁ, হয়েছে, এইটাই! বলে উঠল কিশোর। সিমেন্টে তৈরি ওই নালাটা, পর্বতের ঢাল বেয়ে যেটা নেমে এসেছে বাঁধে। বৃষ্টি হলেই শুধু পানি বহন করে ওটা, এমনিতে থাকে শুকনো। মুসা, ওখানে মিলিত হব আমরা।
কয়েক মিনিট পর নালাটার মুখের কাছে এসে দাঁড়াল রবিন আর কিশোর। ওয়াইনেজ ক্রিক এখানে সব চেয়ে চওড়া। সিমেন্টে তৈরি নালাটা আঁকা হয়ে উঠে গেছে ঢাল বেয়ে, অদৃশ্য হয়ে গেছে ঝোপঝাড়ের আড়ালে। নালার দুপাড় ধরে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করল দুজনে।
কিছুই নেই, মাথা নাড়ল রবিন। সিঁড়ির চিহ্নও দেখছি না।
থাকতেই হবে। আমি এখন শিওর, বুড়ো কারমলের বিলাং এটাই। এস।
কমে আসছে দিনের আলো। আবার আগের জায়গায় নেমে আসতে শুরু করল দুজনে। খানিকটা নেমেছে, হঠাৎ ওয়াইনেজ ক্রিকের অন্য পাড় থেকে শোনা গেল মুসার চিৎকার। এই, পেয়েছি, কোথায় তোমরা?