লেডি ফ্রম ব্রিস্টল খোঁজ, কিশোর বলল।
খুঁজতে শুরু করল ওরা। বাক্স উল্টে, মাছের টিন ঝাড়া দিয়ে, জঞ্জাল সরিয়ে, যত রকমে খোঁজা সম্ভব কিছুই বাদ দিল না। কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না। এমনকি আলগা কয়েকটা তক্তা সরিয়ে তার তলায়ও উঁকি দিল কিশোর।
নাহে, নিরাশ হয়ে মাথা নাড়ল মুসা, ব্রিস্টলের সঙ্গে রাইম মেলাতে পারছি না। কিন্তু এখানেই থাকার কথা, জোর দিয়ে বলল কিশোর। আমি শিওর, ঠিক পথেই এগোচ্ছি। গ্যারেট একজন পুলিশম্যান, কারমলকে চিনত। গ্যারেটই এই বিলাবঙের খোঁজ দিয়েছে আমাদের। ভুল হতে পারে না।
তীরে দাঁড়িয়ে কিছু দেখার কথা বলেনি তো কারমল? রবিন প্রশ্ন তুলল।
রেলিঙের ছাতে দাঁড়িয়েই চারপাশে তাকাল ওরা। খাঁড়ির দুতীরেই বন। দূরে উঠে গেছে পর্বতের ঢাল। শুকনো, সিমেন্টে তৈরি একটা নালা ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে। ব্রিস্টলের সঙ্গে ছন্দে মেলে, এরকম কিছু চোখে পড়ল না।
আচ্ছা, হুইসল না তো? বলে বোটের সামনের হুইলহাউসের ছাতে বসানো হোট একটা এয়ার-হর্ন দেখাল কিশোর।
হুইসল অবশ্য বলা যায়, ধীরে ধীরে বলল মুসা। তরে আসলে ওটা হর্ন। তাছাড়া ব্রিস্টল আর হুইসলের মধ্যে ঠিক ছন্দে মিলছে না। কোনদিকে নির্দেশ করছে ওটা, কিশোর?
ওপরে, রবিন বলল। আকাশের দিকে।
ঠিকই বলেছ, মুসা, একমত হল কিশোর। আসলে আমরা যা খুঁজছি সেটা ব্রিস্টলের সঙ্গে পুরোপুরি মিলতে হবে। আর এমন কিছুকে নির্দেশ করবে, যা থেকে বেরিয়ে আসবে রাইডস ফ্রম আ ফ্রেন্ড-এর সমাধানের সুর। হয়ত ভুল করেছি আমরা, ভূল জায়গায়…
সবাই শুনতে পেল শব্দটা। নিচে কোনখান থেকে এসেছে, ভারি একটা তক্তা মাটিতে পড়েছে বোধহয়।
রেলিঙের ধারে ছুটে গেল ছেলেরা। তীরে দাঁড়িয়ে আছে শুঁটকি টেরি। ওদের দেখে দাঁত বের করে হাসল।
আবার দেখা হয়ে গেল, একেবারে ঠিক সময়ে, বলে খিকখিক করে উঠল সে। সব শুনেছি, সিঁড়িটা কোথায় তা-ও জানি। ধাঁধার সমাধান এবার করেই ফেলব। হাসি। এই সুযোগে কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আস তোমরা।
কিশোর! চিৎকার করে বলল রবিন। হাউসবোটটা খুলে দিয়েছে।
মাটিতে পড়ে আছে তক্তা, যেটা বেয়ে উঠেছে ওরা। যে দড়ি দিয়ে বোটটা বেঁধে রাখা হয়েছিল, ওটা খোলা, পানিতে পড়েছে। দুমদাম করে সিঁড়ি বেয়ে মেইন ডেকে এল ছেলেরা। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই তীর থেকে দশ বারো ফুট সরে চলে এসেছে বোট, গা ভাসিয়ে দিয়েছে স্রোতে।
মুঠো পাকিয়ে দেখাল মুসা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শুঁটকি, ধরতে পারলে…
যাও, বেড়িয়ে এস খোকাবাবুরা, চেঁচিয়ে বলল টেরিয়ার। ঘন্টাদুয়েকের মধ্যে তীরে উঠে আসতে পারবে। খুব সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে তাকে। ঘুরে দৌড় দিল কাঁচা রাস্তার দিকে।
দাঁড়াও, ধরে নিই আগে! শাসিয়ে বলল মুসা। ঘাড় মটকে না দিয়েছি তো আমার নাম মুসা আমান নয়…।
সব্বেনাশ! আঁতকে উঠল রবিন। বাঁধ!
মুসা আর কিশোরও ফিরে তাকাল। ভেসে যাচ্ছে বোট, গতি বাড়ছে দ্রুত। বাড়ছে পানির গর্জন। বাঁধের ওপর দিয়ে গিয়ে জলপ্রপাতের মত নিচে আছড়ে পড়ছে বিশাল এই জলরাশি।
৭
ভেসে চলেছে হাউসবোট।
ঝাঁপ দিয়ে পড়, চিৎকার করে বলল কিশোর। সাঁতরে উঠব।
নাআ! সময়মত নেতৃত্ব নিয়ে নিয়েছে মুসা। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। দুজনেই।
জমে গেল যেন কিশোর আর রবিন।
স্রোত খুব বেশি, মুসা বলল। টেনে নিয়েই যাবে, বুঝতে পারছি। জরুরী কণ্ঠে নির্দেশ দিল, জলদি গিয়ে ওপরে ওঠ।
মুসাকে অনুসরণ করে ওপরের ডেকে উঠে এল দুজনে। ভয়ঙ্কর স্রোত। প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে আসছে বাঁধটা।
বাক্স-টাক্স যা,আছে, সব জলদি ফেল পেছন দিকে, আবার বলল মুসা।
ফেলতে ফেলতে হাঁপিয়ে গেল ছেলেরা। সবে ফেলা শেষ করেছে, এই সময় আওয়াজ হল বোটের তলায়, ঘষা লেগেছে কোন কিছুর সঙ্গে। থেমে গেছে বোট। কিশোর বলল, আমরা…আমরা বাঁধের ওপর চলে এসেছি!
সামনে শুধুই শূন্যতা। অনেক নিচ থেকে কুয়াশা উঠছে, যেখানে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে পানি। ঢোক গিলল রবিন, চেহারা ফ্যাকাসে। বাঁধের ওপর প্রায় ৰূলে থেকে দুলছে বোটটা, সেদিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল কিশোর।
জোরে কেঁপে উঠল একবার বোট, ঝটকা দিয়ে আগে বাড়ল, তারপর আবার থেমে গেল। দুই ধার দিয়ে বয়ে গিয়ে ঝরে পড়ছে পানি।
গুড। বাঁধের ওপর আটকা পড়েছি আমরা, শান্তকণ্ঠে বলল মুসা।
চোখ মেলল কিশোর। পা বাড়াতে গেল।
না না, নড়ো না! তাড়াতাড়ি বাধা দিল মুসা।
থেমে গেল আবার গোয়েন্দাপ্রধান।
পেছনটা আটকেছে, মুসা বলল। জিনিসপত্র ফেলে ভারি করে ফেলেছি। আমাদেরও ভার রয়েছে। নাহলে আটকাত না। নিঃশ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে ছেলেরা। চারপাশে তাকাল। বাঁধের কিনারে আটকেছে বোট, তীর দুদিকেই দশ ফুট দূরে। ঠিক মাঝখানে রয়েছে ওরা।
কি করা এখন? রবিনের প্রশ্ন।
মাথা ঠাণ্ডা রেখেছে মুসা, ভেবে দেখল কি করা যায়। সাঁতার কেটে তীরে পৌঁছতে পারব না। লাফিয়েও পেরোতে পারব না এতদূর। মাথার ওপরে এমন কোন ডালও নেই যে ধরে বেয়ে বেয়ে চলে যাব। তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে গেলে বোটটা যাবে পড়ে।
কি করা যায়, বল তো মুসা? গলা কাঁপছে কিশোরের।
নিচে দড়ি দেখতে পাচ্ছি, মুসা বলল। ওটার মাথায় ফাঁস বানিয়ে ব্যাসোর মত তীরে ছুঁড়ে মারা গেলে, কোন ভাঙা গাছের গুড়িতে আটকানো যাবে। তারপর ওই দড়ি ধরে ঝুলে ঝুলে পেরিয়ে যেতে পারব। রবিন, তোমার ওজন সব চেয়ে কম। যাও, দড়িটা নিয়ে এস।