কাজেই জাল দলিলটা এল, নরি আর তার মায়ের নামে। নরি পাবে শুধু অর্ধেক, পুরোটা নয়। তার মা পাবে বাকি অর্ধেক। উড তাকে বিয়ে করলে সহজেই স্ত্রীর সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক হয়ে যাবে, কারণ ক্যালিফোর্নিয়ার আইনে স্ত্রীর সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক হয় স্বামী।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালেন পরিচালক।
ছেলের জিনিস মা চুরি করবে না, বলে গেল কিশোর, এটা শিওর। কাজেই সন্দেহ করার মত আর একজনই রইল, রস উড। আন্দাজ করলাম, সারাটা বিকেল জাহাজে পাথরগুলো খুঁজেছে সে। তার পেছনে কেউ লাগবে এ-ভয় ছিল না। হিউগ আর বিগকে বলে দিয়েছিল আমাদের আটকাতে। নরি হোক ছোঁক করছিল বলে তাকে নিজের হাতে বন্দি করে ভরে রেখেছিল ভ্যানে, আমরা যে তাকে ছেড়ে দিয়েছি, জানত না। নকল পাথরগুলো পেল, তবে আমার মতই সে-ও কারমলের চিঠি বিশ্বাস করেনি। বুঝতে পেরেছে, মিথ্যে কথা বলছে কারমল। জাল দলিলটা তখনই রেখে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল যে, যদি রহগুলো না-ও পায়, এলসার সম্পত্তির ভাগীদার সে হবেই। তারপরে অবশ্যই হিউগকে বলত আমাদের ছেড়ে দিতে, এবং আমাদের মাধ্যমে রহগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করত। কিন্তু আমাদেরকে ছাড়া পেয়ে যেতে দেখে অন্য বুদ্ধি এল তার মাথায়।
আমি যখন শিওর হয়ে গেলাম, তাকে ধরার জন্যে ফাঁদ পাতলাম। সেই কেবিনেই রয়ে গেলাম অন্যেরা বেরিয়ে যাওয়ার পরেও। ব্যাপারটা উডের চোখ এড়াল না। বাইরে বেরিয়ে আড়ি পাতল সে। আমিও তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সব কথা বললাম। তারপর কায়দা করে তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেলাম ম্যাকবেথ রুমে, একেবারে আমার ফাঁদের মধ্যে।
ফাঁদটা অবশ্য তোমাদেরকেও বিপদে ফেলে দিয়েছিল, পরিচালক বললেন। মরেছিলে আরেকটু হলেই। যাক, ভালয় ভালয় সব শেষ হয়েছে।
হ্যাঁ, স্যার, হাসল কিশোর।
হিসেব করে অনেক কিছু বের করেছ, ঠিক, তবে কিছু কিছু ব্যাপারে আন্দাজেও ঢিল ছুঁড়েছ, তাই না? এই যেমন, মাইক এজটারকে বোট খুলে দেয়ার কথাটা বলা।
না, জোর দিয়ে বলল কিশোর, সেটাও অনুমান নয়। বুঝলাম, লাইফবোট যে খুলে দিয়েছে সে চায় না আমরা জাহাজে উঠি। তারমানে সে জানে না বাইশ নাম্বার কেবিনের পাথরগুলো নকল। উড জানে, শুঁটকি বলি, ওই অকাজ করার মত একমাত্র বাকি থাকে এজটাররাই।
এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। চোখে বিস্ময়, চাপা দেয়ার কোন চেষ্টা করলেন না। ধীরে ধীরে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল ঠোঁটে। বললেন, হ্যাঁ, এবার বল আসামীদের কথা। কার কি শাস্তি হয়েছে? উড তো জেলে যাবেই, তার কথা বাদ। বাকিদের?
হিউগ আর বিগ উধাও, রবিন জানাল। পুলিশ খুঁজছে ওদের। ইচ্ছে করলে মাইক আর জেনিকে জরিমানা করতে পারতেন বিচারক, জেলও দিতে পারতেন। কিন্তু রত্ন না পেয়ে মানসিক শান্তি অনেক হয়েছে ওদের। সেকথা বিবেচনা করে ওদেরকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিজ্ঞ বিচারক, তবে আমেরিকায় থাকতে পারবে না ওরা। সেই দিনই দেশের জাহাজের টিকেট কেটেছেভাইবোন।
হ্যাঁ, রত্ন না পাওয়ার ব্যথা কোনদিন ভুলতে পারবে না ওরা, এটাই বড় শাস্তি, পরিচালক বললেন। টেরিয়ারের কি খবর?
বাথরুমে আটকে থেকেই আকেল হয়ে গেছে ওর। আর বাড়াবাড়ি করছে। না। ঝিম মেরে গেছে একেবারে।
দেখ কতদিন ভাল থাকে। যাকগে, চমৎকার কাজ দেখিয়েছ তোমরা। আমার কগ্রাচুলেশন রইল।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। তবে কাজ মোটেও ভাল দেখাইনি। গর্দভের মত কাজ করেছি, কিশোর বলল।
মানে? ভুরু কোঁচকালেন পরিচালক।
প্রথম পাঁচটা ধাঁধার একটারও সমাধান করার দরকার ছিল না। ছয় নাম্বারটা থেকে শুরু করলেই বের করে ফেলা যেত পাথরগুলো।
কি করে? সোজা হয়ে বসলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার।
কইনের আগে পশ শব্দটা ব্যবহার করেছে কারমল। আমি জানতাম, এর মানে ফিটফাট। ধরে নিয়েছিলাম জাহাজের সব চেয়ে ভাল কেবিন, মানে ফার্স্ট ক্লাসের কথা বলছে। কাজেই ওটা নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি, দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর। তারপর সেদিন ক্যাপ্টেনের কাছে শুনলাম, শব্দটার অন্য মানেও আছে। শব্দটা ইংরেজ নাবিকদের আবিষ্কার, জাহাজে করে যারা ভারতবর্ষে যেত আর আসত। ওদিকে যাওয়ার সময় সব চেয়ে আরাম হত জাহাজের পোর্ট সাইড অর্থাৎ বা দিকের কেবিনগুলোয়, রোদ বাতাস কোনটাই তেমন বিরক্ত করত না। আবার ইংল্যাণ্ডে ফেরার পথে ভাল হত স্টারবোর্ড সাইড অর্থাৎ ডানপাশের গুলো। স্টীমশিপের যাত্রীদের মাঝে একটা কথা প্রচলিত ছিল তখনঃ যদি আরামে যেতে চাও, যাওয়ার সময় বামে, আর ফেরার সময় ডানে উঠবে। সংক্ষেপে ইংরেজিতে বলত—পোর্ট আউট, স্টারবোর্ড হোম। পরে আরও সংক্ষেপ করে ফেলা হল, চারটে শব্দের শুধু প্রথম চারটে অক্ষর এক করে, মানে পি.ও. এস, এইচ. দিয়ে হয়ে গেল পশ।
কিশোর থামতে রবিন বলল, যেহেতু কুইন জাহাজটা লণ্ডন-অস্ট্রেলিয়া যাবার পথে ইনডিয়া হয়ে যেত, পশের আরাম ওটাতেও ছিল। কারমল জানত সেটা। খুব শর্টকাট একটা সূত্র দিয়েছিলঃ পশ কুইন।
এবং গর্দভের মত আমি সেটা মিস করেছি, মুখ কালো করে বলল কিশোর।
তুমি একা নও। সবাই-ই করেছে, পরিচালক বললেন।
সান্ত্বনা দিচ্ছেন, স্যার।
মোটেই না। সবগুলো ধাঁধার সমাধান করতে গিয়ে অনেক বিপদ আর বাধার মুখোমুখি তোমরা হয়েছ, মেধা আর অসামান্য সাহসের জোরে সেগুলো প্রতিহত করেছ, তোমাদের দক্ষতা তাতে আরও বেশি প্রমাণিত হয়েছে। শুধু চমৎকার আর বলব না, বলব প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছ তোমরা, মাই বয়েজ।