প্রমাণ তো ছিল না, স্যার, নিজের পক্ষে সাফাই গাইল কিশোর। একটা নকল দলিল রেখে দেয়া ছাড়া আর কিছুই করেনি তখনও। আমি সেটা সন্দেহ করেছি বটে, প্রমাণ করতে পারতাম না। ওকে ওভাবে ফাঁদে না ফেললে রত্নগুলো মারত, মিসেস কারমলকে বিয়ে করে তার সম্পত্তিরও বারোটা বাজাত।
প্রমাণ করার দরকার ছিল না, চীফ বললেন। তোমার সন্দেহের কথা আমাকে বললেই হুঁশিয়ার হতে পারতাম। যাকগে, ভালয় ভালয় সব মিটে গেছে…
আরি, সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠল নরি। পাথরগুলো পানিতে…
না, পড়েনি, হাসল মুসা। হাত উঁচু করে বটুয়া দেখাল। খুলে উপুড় করে ধরল ডেকের ওপর। ঝরঝর করে ঝরে পড়ল লাল, হলুদ, নীল আর সবুজ রঙের কতগুলো পাথর, ছোটখাট একটা স্তূপ হয়ে গেল। জাহাজের ম্লান আলোয় ঝলমল করে উঠল, ছড়াতে লাগল ঠাণ্ডা রঙিন দ্যুতি।
২২
কয়েক দিন পর। কেসের রিপোর্ট নিয়ে চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে হাজির হল তিন গোয়েন্দা। খাড়া-পিঠ ডেস্ক-চেয়ারে বসে সামনে পেছনে দোল খেতে খেতে মন দিয়ে ছেলেদের কথা শুনলেন তিনি।
তাহলে গোড়া থেকেই কারমলের রসের পেছনে লেগে ছিল উড, বললেন পরিচালক।
হ্যাঁ, স্যার, কিশোর বলল।
বেঈমান!
কারমল তাকে দেখতে পারত না, সন্দেহ করত, মুসা বলল, এলসাকে বলেছিলও সেকথা। কিন্তু এলসা বুড়োর কথায় কান দেয়নি।
হুঁ, মাথা দোলালেন পরিচালক। মনের ব্যাপারে মানুষ অন্ধই হয়। তা সে জন্যেই বুঝি এই আজব উইল বানিয়েছিল কারমল, উডের হাত থেকে তার কষ্টে অর্জিত টাকা বাঁচানোর জন্যে?
সেটা একটা কারণ, কিশোর বলল। কারমল ভেবেছিল, ধাঁধার ব্যবস্থা করলে, গুপ্তধন শিকারে জড়িত হয়ে পড়বে উড, বিয়েটা করতে দেরি হবে। হয়ত রত্ন খুঁজতে গিয়ে তার আসল রূপ এলসার কাছে ফাঁস করে দিতে পারে। আর তা-ই করেছে উড। ড্যাম সানকে সব কথা বলেছে কারমল। উডের মত একটা বাজে লোকের সঙ্গে মিশছে বলে পুত্রবধুর ওপরও বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল সে। সান অন্তত তা-ই বলেছে।
উড বুঝতে পারেনি, হেসে বলল মুসা। কি-রকম ধূর্ত লোকের পাল্লায় পড়েছে সে। প্রথমে তার অফিস থেকে কারমলের আগের উইলটা হারাল, তারপর কারমলের মৃত্যুর পর পত্রিকায় বেরিয়ে গেল আজব উইলের খবর। স্তব্ধ করে দিয়েছিল বেচারা উকিলকে।
তারমানে কি উড প্রথম উইলটা নষ্ট করেনি? পরিচালক জিজ্ঞেস করলেন।
না। কারমল করেছে। উডের অফিস থেকে চুরি করেছিল ওটা, জবাব দিল কিশোর।
পরের উইলটা উডকে দিয়ে করালে, আর তার কাছে থাকলে শিওর ওটা নষ্ট করে ফেলত, রবিন বলল, সে-কারণেই ওটা তার কাছে রাখেনি কারমল। তাকে জানায়ওনি কিছু। রেখেছিল ড্যাম সানের কাছে। অনুরোধ করে গিয়েছিল, তার মৃত্যুর পর যেন পত্রিকায় ছেপে দেয়।
কিশোর বলল, ওই উইলের খবর শুনে তো মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা হল উডের। টাকার জন্যে মাথা তখন তার এমনিতেই গরম। তার ভয় ছিল, অন্য কেউ রত্নগুলো খুঁজে বের করে ফেলবে। সুতরাং আমাদের ভাড়া করল।
তার ধারণা ছিল, রবিন বলল, রতুগুলো পাওয়ার পর আমরা যদি গোলমাল করিই, সহজেই সরিয়ে দেবে আমাদেরকে।
তারমানে তোমাদের ভাড়া করেই ভুলটা করেছে, মিটিমিটি হাসছেন
পরিচালক।
আসলে নিজেকেই পরাজিত করেছে সে, কিশোর বলল। মরেছে তার লোভের জন্য।
ওকে সন্দেহ করলে কেন? পরিচালক জিজ্ঞেস করলেন।
লম্বা দম নিল কিশোর। প্রথম সন্দেহ হল হিউগ আর বিগের কথা শোনার পর। ওরা বলল, একজনের কাছে টাকা পায় ওরা, সেই লোকই ওদেরকে বলেছে আমাদের আটকাতে। রত্নগুলো চায় সেই জুয়াড়ী লোকটা। হিউগ আর বিগ আমাদের ওপর যেমন রাখত, মিসেস কারমলের বাড়ির ওপরও নজর রাখত। বুঝলাম, জুয়াড়ীকে ওখানেই পাওয়া যাবে। আর ওখানে তখন পুরুষ তোক বলতে একমাত্র রস উড।
কাজেই, জাহাজে ওঠার আগে থেকেই আমার সন্দেহ ছিল জুয়াড়ী লোকটা রস উড। তারপর এমন একটা ঘটনা ঘটল, একেবারে শিওর হয়ে গেলাম যে সে-ই সেই লোক। কেবিনের সিলিঙে কাঁচের টুকরোর সঙ্গে পাওয়া গেল নকল উইল।
কিন্তু কি করে বুঝলে নকল? আর উডই যে ওই কাজ করেছে সেটা?
কারণ ভোরা কেমপার আমাকে বলেছে, আগের উইলটা কারমল নষ্ট করে ফেলেছে। দ্বিতীয় উইলটায় সাক্ষী দিতে ডাকার আগেই সেকথা সান আর ডোরা কেমপারকে বলেছিল কারমল। বলেছিল, চুরি করে এনে ওটা পুড়িয়ে ফেলেছে। জানিয়ে রেখেছিল এই কারণে, যদি প্রথম উইলটা আবার উদয় হয় কখনও, সেটা যে জাল ওরা যেন বলতে পারে কোর্টে। কারমলের সন্দেহ ছিল, একটা জাল দলিল তৈরি করবেই উড। তার সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হয়েছে।
আমি এসব কথা শুনে এসেছি আগেই। কাজেই জাল দলিলটা যখন সত্যি বেরোল, বুঝে ফেললাম কার কাজ। কেন রাখা হয়েছে তা-ও বুঝলাম।
বলে যাও, পরিচালক বললেন।
হ্যাঁ, খুলেই বল সব,মুসা অনুরোধ করল। একবার শুনেছি, কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি ঠিকমত। দেখা যাক এখন বুঝি কিনা।
বেশ, কিশোর বলল, বলছি। কিন্তু এতে না বোঝার তো কিছু নেই। কারমলের মৃত্যুর পর কে লাভবান বেশি হবে এটা তো জানা কথা। জাল দলিলটা যদি না বেরোয়, তাহলে দাদার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবে নরি, কারণ সে-ই একমাত্র উত্তরাধিকারী। তার অমতে তার জিনিস কেউ ছুঁতে পারবে না, এমনকি তার মায়েরও সে-অধিকার নেই।