এটা আর কি ধাঁধা হল? রবিন বলল। মানে তো সহজ! কে ভাবতে পেরেছিল, বুড়ো লোকটার এত টাকা? পাশা গড়িয়ে দাও, লুটের মাল তোমার হয়ে যাবে।
আমিও তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন অন্য কথা ভাবছি। প্রথম বাক্যটা আর কোথায় আছে, বল তো? পরিচিত মনে হয় না?
গালে আঙুল দিয়ে কয়েক সেকেণ্ড ভাবল রবিন। তারপর বলল, নাটকে। সেকসপীয়ারের ম্যাকবেথ নাটকে ঠিক এরকম একটা কথা আছে, শুধু ওখানে মানির জায়গায় রয়েছে ব্লাড়। বাক্যটা এরকমঃ ই উড হ্যাভ থট দ্য ওল্ড ম্যান টু হ্যাভ হ্যাড সো মাচ রাড ইন হিম?।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিলোর। কাকতালীয় হতে পারে না। বুঝেশুনেই লিখেছে কারমল।
ম্যাকবেথ খুব পছন্দ করত বোধহয়, মুসা বলল। কিন্তু একথাটাকে ধাঁধা মনে হচ্ছে কেন?
নইলে এরকম একটা অদ্ভুত বাক্য উইলে থাকত না। চিঠিতে লিখেছে বটে, কিন্তু ওর মত কৃপণের সব টাকা খরচ করার কথা নয়। তাছাড়া জুয়া খেলার কথা উল্লেখ করেছে।
জুয়া? রবিন বলল। এর সঙ্গে ধাঁধার কি সম্পর্ক?
ওই যে বলেছে, পাশা গড়িয়ে দাও। রোল দ্য ডাইস কেন বলল?
আল্লাহই জানে! মুসা বলল।
আমি বুঝতে পারছি। পাশা দিয়ে জুয়া খেলার সময় নেচারাল বলে খেলোয়াড়েরা। এর মানে কি?
চোখ বড় বড় হয়ে গেল রবিনের। সাত! তারমানে কারমল বলছে, সতি নাম্বার আরেকটা ধাঁধা রয়েছে।
খাইছে! বলে উঠল মুসা।কোনটা? ওই অদ্ভুত বাক্যটা? হুড হ্যাভ…
হাত নেড়ে তাকে চুপ করতে ইশারা করল কিশোর। কান পেতে কি যেন শুনল। তারপর গলা চড়িয়ে বলল, মনে হয় ওই বাক্যটাই। কিন্তু মানে বুঝতে পারছি না। আমার বুদ্ধিতে কুলাবে না। চলো অন্যদের গিয়ে সব খুলে বলি। দেখি কে কি বলে।
আমরা চেষ্টা করে দেখি না কেন? মুসা বলল। এজটাররাও নেই, শুঁটকিও নেই, কেউ আর জ্বালাতে আসবে না।
না, জোরে জোরে বলল কিশোর, আমরা পারব না। সাহায্য দরকার। এস।
কেবিন থেকে বেরিয়ে সিঁড়িব কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। চলে এল প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের সমাবেশ যেখানে হত সেখানটায়। ঢুকে গেল বিশাল জাহাজটার নীরব, অন্ধকার ডেকে।
হয়েছে, থাম, ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর। যথেষ্ট দূরে চলে এসেছি।
কি হয়েছে, কিশোর? বুঝতে পারছে না মুসা। আবোল-তাবোল কথা বলছ কেন?
করছিটা কি আমরা? রবিনও অবাক হয়েছে।
আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করব আমরা, কিশোর বলল। তারপর যাব সেখানে, যেখানে রত্নগুলো রয়েছে।
কোথায়, জানো? কিশোর বলছে দেখে রবিনও ফিসফিসিয়ে বলল। বুঝতে পারছে, গোয়েন্দাপ্রধানের মনে কোন মতলব আছে।
কিন্তু মুসা বুঝতে না পেরে জোরেই জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নিল কিশোর, কিন্তু অন্ধকার ডেকে কোন নড়াচড়া চোখে পড়ল না। বলল, ডেকের নকশায় দেখলাম, ছোট একটা লাউঞ্জ আছে কুইন জাহাজে, ওটার নাম ম্যাকবেথ রুম। রতগুলো ওখানেই আছে।
খাইছে! আমরা পারব না বলেছিলে কেন তাহলে?
বুঝতে পারবে একটু পরেই, হাতঘড়ি দেখল কিশোর। হয়েছে। চলো এবার যাই। শব্দ করবে না। আমার পেছনে থাকবে, যা যা করতে বলব, করবে।
বেড়ালের মত নিঃশব্দে আবার সমাবেশের জায়গাটায় বেরিয়ে এল গোয়েন্দাপ্রধান। কার্পেট বিছানো চওড়া সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল বি-ডেকে। নীরবে অনুসরণ করছে দুই সহকারী। বি-ডেকে নেমে স্নান আলোকিত বারান্দা ধরে হেঁটে চলল। একটা দরজার পাশের ছায়ায় এসে দাঁড়িয়ে গেল। দরজার পাল্লার গায়ে গোল জানালা।
ম্যাকবেথ রুমের একপাশের দরজা এটা, বলল কিশোর। সারভিস ডোর।
কি করব এখন? মুসা জানতে চাইল।
অপেক্ষা। এবং নজরে রাখব।
ওর কথা শেষ হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই টর্চ জ্বলে উঠল ঘরের ভেতর। একই জায়গায় থেকে আলোর রশ্মি ঘুরতে শুরু করল সারা ঘরে। আলোয় ফুটে উঠতে থাকল কতগুলো টেবিল, আর্মচেয়ার, মরচে পড়া একটা বার, দেয়ালে সাজানো প্রাচীন হেলমেট, বৰ্ম, বেদীতে বসানো স্কটিশ যোদ্ধাদের দাড়িওয়ালা আবক্ষ মূর্তি।
ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা শুরু করল টর্চধারী।
প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ছেলেরা। গাঢ় রঙের কটটেল লাউঞ্জের ওপর আলো পড়ল। টর্চ ধরে থাকা হাতটা ছাড়া টর্চধারীর শরীরের আর কোন অংশ চোখে পড়ছে না। শুধু কালো একটা মূর্তি দ্রুত সরে যাচ্ছে এখান থেকে ওখানে, প্রতিটি টেবিলের সামনে দাঁড়াচ্ছে, বারের নিচে, বর্ম আর হেলমেটগুলোর ভেতর খুঁজছে। টান দিয়ে দিয়ে খুলে নিচ্ছে দেয়ালের জিনিস, তুলে নিচ্ছে টেবিলে রাখা জিনিস, টর্চের কাছে এনে পরীক্ষা করছে, তারপর ছুঁড়ে ফেলছে।
আলো ঘুরতে শুরু করল মূর্তিগুলোর ওপর। চাপ দাড়িওয়ালা একটা ব্রোঞ্জের মূর্তির ওপর এসে থামল। ওটার মাথায় একটা রাজকীয় মুকুট। অস্ফুট শব্দ করে দ্রুত মূর্তির কাছে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা। তুলে নিল। হাতে নিয়ে ওজন আন্দাজ দেখল, একটা কেবিনে প্রায় দৌড়ে এসে ওই একটা। মুহূর্তে ঢুকে করে সন্তুষ্ট হয়ে আবার শব্দ করল সে, আনন্দ ধ্বনি।
রবিনের কাঁধ খামচে ধরল কিশোরের আঙুল। আরেকটু জোরে দিলেই আউউ করে উঠত রবিন। ফিসফিসিয়ে গোয়েন্দাপ্রধান তার কানে কানে বলল, ভেতরটা বোধহয় ফোপড়া! মনে হয় পেয়েছে!
একটা টেবিলে টর্চটা শুইয়ে রেখে আলোর সামনে ধরে [র্তির ফোকরে হাত ঢুকিয়ে দিল লোকটা। চামড়ার একটা বড় বটুয়া বের করল ভেতর থেকে। মূর্তিটা ছুঁড়ে ফেলে খুলল বটুয়াটা। হেসে উঠল একা একাই। বটুয়া হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল ম্যাকবেথ রুমের মেইন ডোর দিয়ে।